Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

শিল্পের জমিতে জোরকদমে আলু-পেঁয়াজ ফলছে রঘুনাথপুরে

শিল্পের জন্য জমি কিনে এখন সেখানে আলু-পেঁয়াজের চাষ করছে শিল্পসংস্থা! রাজ্যে শিল্প মানচিত্রের অন্যতম মুখ হিসেবে পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরকে তুলে ধরতে চায় তৃণমূল সরকার। সেখানেই শিল্পের জন্য নেওয়া প্রায় ১০০ একর জমির একাংশে শুরু হয়েছে চাষাবাদ। কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় অবিলম্বে চাষ বন্ধ করে শিল্প তৈরির দাবিতে প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েছেন বাসিন্দারা। কিন্তু শিল্পসংস্থার তরফে বলা হচ্ছে, রাজ্যের বেহাল শিল্প পরিস্থিতির জন্যই কারখানা তৈরির কাজ এগোতে পারেনি তারা।

রঘুনাথপুরে শিল্পের জন্য কেনা সেই জমি।  —নিজস্ব চিত্র

রঘুনাথপুরে শিল্পের জন্য কেনা সেই জমি। —নিজস্ব চিত্র

শুভ্রপ্রকাশ মণ্ডল
রঘুনাথপুর শেষ আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০২:০৭
Share: Save:

শিল্পের জন্য জমি কিনে এখন সেখানে আলু-পেঁয়াজের চাষ করছে শিল্পসংস্থা!

রাজ্যে শিল্প মানচিত্রের অন্যতম মুখ হিসেবে পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরকে তুলে ধরতে চায় তৃণমূল সরকার। সেখানেই শিল্পের জন্য নেওয়া প্রায় ১০০ একর জমির একাংশে শুরু হয়েছে চাষাবাদ। কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় অবিলম্বে চাষ বন্ধ করে শিল্প তৈরির দাবিতে প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েছেন বাসিন্দারা। কিন্তু শিল্পসংস্থার তরফে বলা হচ্ছে, রাজ্যের বেহাল শিল্প পরিস্থিতির জন্যই কারখানা তৈরির কাজ এগোতে পারেনি তারা।

প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রের খবর, প্রায় আট বছর আগে রঘুনাথপুর ১ ব্লকের নতুনডি পঞ্চায়েতের লছমনপুর মৌজায় পর্যায়ক্রমে প্রায় একশো একর জমি কিনেছিল কলকাতার শিল্প সংস্থা গগন ইন্ডাস্ট্রিজ। ওই সংস্থার অধীন মোট তিনটি ছোট সংস্থার নামে জমিটি কেনা হয়েছিল। বামফ্রন্ট আমলে যেখানে শ্যাম স্টিল প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ করেছিল রাজ্য শিল্প উন্নয়ন নিগম, ঠিক তার পাশেই পুরুলিয়া-বরাকর রাজ্য সড়ক ঘেঁষা এই জমি। এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, শিল্প উন্নয়ন নিগম যে পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দিয়ে শ্যাম স্টিলের জন্য জমি অধিগ্রহণ করেছিল, সেই দামেই গগন ইন্ডাস্ট্রিজকে তাঁরা জমি বিক্রি করেছিলেন। বিঘা প্রতি জমির দাম ধরা হয়েছিল কমবেশি এক লক্ষ টাকা। পরবর্তী কালে শিল্প কারখানায় কাজে পাওয়ার আশাতেই কম দামে জমি ছেড়ে দিয়েছিলেন বলে তাঁদের দাবি।

জমিতে কারখানা হল না কেন? শিল্পসংস্থাটির অন্যতম ডিরেক্টর বিনয় অগ্রবাল জানাচ্ছেন, ওই এলাকায় তাঁরা ইস্পাতের কাঁচামাল তৈরির কারখানা গড়ার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। ঝাড়খণ্ড, দুর্গাপুর এবং পুরুলিয়ার নিতুড়িয়ায় তাঁদের স্পঞ্জ আয়রনের কারখানা রয়েছে। বিনয়বাবুর কথায়, “বর্তমানে ইস্পাতের বাজার মন্দা। রাজ্যে শিল্পের পরিস্থিতিও অন্য রকম। তাই এখনই ওই জমিতে কারখানার জন্য বিনিয়োগ করতে ভরসা পাচ্ছি না।” তাই জমি ফেলে না-রেখে চাষাবাদ করছেন। তাঁর কথায়, “আমাদের জমির পাশেই কারখানা গড়ার কথা ছিল শ্যাম স্টিলের। কিছুটা দূরেই ছিল জয়বালাজি গোষ্ঠীর প্রকল্প। তারাও শেষ পর্যন্ত কারখানা গড়েনি। এই অবস্থায় আমরা কী ভাবে ঝুঁকি নেব?”

শিল্প মহল বরাবরই বলে আসছে, রাজ্য সরকারের জমি অধিগ্রহণ না-করার নীতি যেমন এক দিকে শিল্পের ক্ষতি করছে, তেমনই প্রতিবন্ধক হয়ে দেখা দিচ্ছে রাজ্যের শিল্পবিরোধী ভাবমূর্তি। পশ্চিমবঙ্গে নতুন করে লগ্নি করতে ভরসা পাচ্ছে না প্রায় কোনও শিল্প সংস্থাই। যারা এখনও আছে, তারাও শাসক দলের নিচুতলার দাদাগিরি এবং সিন্ডিকেটের চাপের মুখে রাজ্য ছাড়ার কথা ভাবতে শুরু করেছে। আর যে হেতু বড় শিল্প আসছে না, সে হেতু তৈরি হচ্ছে না ছোট ও মাঝারি শিল্প তৈরির সম্ভাবনাও। রাজ্য সরকার বারবার ছোট ও মাঝারি শিল্পকে উৎসাহ দেওয়ার কথা বললেও ভারী শিল্পের অনুপস্থিতিতে তাদের পক্ষেও যে আশার আলো নেই, রঘুনাথপুরের ঘটনাই তার প্রমাণ।

গ্রামবাসীরা এত দিন শিল্পের আশায় থাকলেও গত কয়েক মাস ধরে সেই জমিতে আলু-পেঁয়াজের চাষ হতে দেখে হতাশ হয়ে পড়েছেন। জমি দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা সংস্থার কর্মীরাই মেশিন নামিয়ে মাটি খুঁড়ে, গভীর নলকূপ বসিয়ে চাষ শুরু করেছেন। তৃণমূল প্রভাবিত ‘লছমনপুর ল্যান্ড লুজার্স অ্যান্ড ল্যান্ড প্রোটেকশন কমিটি’ নামের একটি সংগঠন এখন বাসিন্দাদের নিয়ে প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েছে। তাদের দাবি, কারখানা হলে কর্মসংস্থান হবে, সেই আশাতেই জমি বিক্রি করা হয়েছিল, তাই শিল্পের জন্য কেনা জমিতে দ্রুত কারখানা চালু করতে হবে। কারখানা চালু না-করা পর্যন্ত ওই জমিতে স্থানীয়দের চাষ করতে দিতে হবে বলেও তারা দাবি জানিয়েছে। কমিটির সম্পাদক তথা তৃণমূল নেতা বিকাশ মণ্ডল বলেন, “রাজ্য সড়কের পাশে একফসলি ও কিছু ডাঙা-জমি কার্যত জলের দরে কেনে সংস্থাটি। এখন আলু, পেঁয়াজ চাষ শুরু করেছে ওরা। চাষের কাজেও বাইরে থেকে লোক আনা হয়েছে। স্থানীয়দের সেখানেও সুযোগ নেই।”

ঘটনা হল, তৃণমূলের একাংশ শিল্পের জমিতে চাষের বিরোধিতায় রাস্তায় নামলেও ওই জমিতে চাষের অনুমতি দিয়েছে তৃণমূল পরিচালিত নতুনডি পঞ্চায়েতই। পঞ্চায়েত কী ভাবে এই অনুমতি দিল, তা নিয়েও স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের অন্দরে ক্ষোভ জমেছে। সম্প্রতি কমিটির কিছু সদস্য ও সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠকে বসেন রঘুনাথপুরের মহকুমাশাসক সুরেন্দ্রকুমার মিনা। তিনি বলেন, “সংস্থার প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, আপাতত কিছু সমস্যার জন্য তাঁরা লছমনপুরের জমিতে কারখানা করতে পারছেন না।” রঘুনাথপুরের তৃণমূল বিধায়ক পূর্ণচন্দ্র বাউরিরও দাবি, “সংস্থাটির সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা জানিয়েছে, আপাতত কিছু সমস্যার জন্য কারখানা চালু করতে পারছে না। পরে কারখানা গড়ে স্থানীয়দের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে।”

কিন্তু বিরোধীরা প্রশ্ন তুলছেন, রাজ্যে শিল্পের বেহাল দশার জন্যই কারখানা তৈরির ব্যাপারে ভরসা পাচ্ছে না সংস্থাগুলি। মুখ্যমন্ত্রী যদি শিল্পনীতি না বদলান, তা অবস্থা বদলাবে কী করে? বিজেপির জেলা সভাপতি বিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের তাই কটাক্ষ, “মুখ্যমন্ত্রী পুরুলিয়ায় এলেই নিয়ম করে রঘুনাথপুরে শিল্প সম্ভাবনার কথা শুনিয়ে যান। কিন্তু রাজ্যের দিশাহীন শিল্পনীতির জন্যই রঘুনাথপুরে শিল্পের জমিতে এখন চাষ হচ্ছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

raghunathpur plantation
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE