রাঢ়ের সত্যজিৎ
পুরুলিয়া যেমন বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের, সত্যজিৎ রায়ের তেমন বিশেষ কোনও জেলা বা ভূপ্রকৃতির উপরে আগ্রহ ছিল না। তাঁর ছবির, গল্পের প্রয়োজনে যখন যেমন লোকেশন প্রয়োজন হয়েছে তেমনই বেছে নিয়েছেন সত্যজিৎ। তাঁর সিনেমার জন্য সেই লোকেশন স্মরণীয় হয়ে গিয়েছে পায়ে-সরষে বাঙালির কাছে। কিন্তু যত বিখ্যাত রাজধানী, তত বিখ্যাত নয় এ হৃদয়পুর। সত্যজিতের সিনেমার জন্য জয়সলমিরের সোনার কেল্লা বিখ্যাত হয়ে গিয়েছে। অথচ ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া পশ্চিমবঙ্গের জেলার স্মৃতিতে তেমন ভাবে সত্যজিৎকে খুঁজিনি। যেমন পুরুলিয়ার জয়চণ্ডী পাহাড়। হীরক রাজার দেশের উদয়ন পণ্ডিত লুকিয়েছিলেন এখানেই। অথচ সেই লোকেশনে সত্যজিতের শুটিং নিয়ে তেমন লেখালেখি এ পর্যন্ত হয়নি। স্থানীয় মানুষের দীর্ঘ চেষ্টার পরে সেখানে ছোটখাট ভ্রমণকেন্দ্র হয়েছে। ও দিকে আবার ‘অভিযান’-এর নরসিং-এর বিচরণক্ষেত্র কল্পিত শহর হলেও তার লোকেশন রাঢ়বঙ্গেরই আর এক জেলা বীরভূমে। বীরভূমের দুবরাজপুর-সংলগ্ন এলাকায় শুটিং হয়েছিল এ ছবির। বছর ষাটেক আগেও সংখ্যালঘু ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানদের কী চোখে দেখা হত তার একটা মানবিক প্রামাণ্য চেহারা এ ছবিতে ধরা আছে। সমাজতত্ত্বের এই প্রসঙ্গে গবেষণা করতে গেলে যে পুরুলিয়া, বীরভূমের মানুষের ইতিহাস খুঁজে দেখতে হবে সে তো স্বাভাবিক। কিন্তু বিশেষ জেলার ভূগোল তার মানুষ-সমেত কী ভাবে উঠে আসে সত্যজিতের ছবিতে তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে কমই। কেউ কি এগিয়ে আসতে পারেন না? ঠিক যে ভাবে ‘নিমতিতায় সত্যজিৎ’ নামে একটি বই প্রকাশিত হয়েছিল!
লালগড়ের কথা
পৃথিবীর সর্বত্র ভাষার মৃত্যু ঘটছে। ভারতে জীবিত ভাষার সংখ্যা ৭৮০টি। কিন্তু তার মধ্যে কয়েকটি এখন মৃতপ্রায়। মানুষ যদি কোনও ভাষায় কথা না বলে তাহলে শুধু ব্যাকরণ লিখে কোনওভাষাকে বাঁচানো যায় না। নারীমুক্তি নিয়ে কী ভেবেছিলেন ভারতীয় চিন্তাবিদরা? এমনই কিছু প্রবন্ধে সমৃদ্ধ লালগড় থেকে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকা ‘সুস্বন’ এর ইংরেজি নববর্ষ সংখ্যা। মেদহীন তথ্যভিত্তিক সহজ বাংলায় পত্রিকা সাজিয়ে তোলার জন্য সম্পাদক প্রশংসার দাবি রাখেন। পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে, ‘‘লালগড় জঙ্গল থেকে লুপ্ত হয়ে গেছে পিয়াশালের মতো বৃক্ষ, সূর্য শিশিরের মতো অতি ক্ষুদ্র পতঙ্গভুক গুল্ম। করম, কেঁদ প্রভৃতি গাছগুলি প্রায় বিলুপ্তির পথে...’’ লাল মাটির এই সাহিত্য পত্রিকা শুধু সাহিত্য চর্চাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। গাছেদের হত্যালীলা বন্ধের দাবি জানিয়েছে দৃঢ় ভাবে।
উপন্যাসে নীলকর
‘‘অন্ধকারে না জানি কীসের নেশায় হাতড়ে বেড়ায় তাঁদের অতীত।’’ দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী গ্রাম মঙ্গলগঞ্জ ভাল আছে তো? রাজরোষে বাজেয়াপ্ত নাটক নীলদর্পণের পটভূমি এবং নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রের বাড়ি দু’টোই ছিল সীমান্তবর্তী এলাকায়। বিট্রিশ আমলে নীলকরদের অত্যাচারের অতীত এবং স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের যন্ত্রণার মেলবন্ধনে দিয়েই তৈরি হয়েছে বারাসতের বাসিন্দা পলাশ পোদ্দারের লেখা উপন্যাস ‘ভাল নেই মঙ্গলগঞ্জ’। শুরুতেই তিনি সীমান্তবর্তী গ্রামের বেদনার কথা তুলে ধরেছেন। নীলকরদের অত্যাচারের কাহিনি তুলে ধরেছেন লেখক। অলকাভ নিয়োগীর প্রচ্ছদ প্রশংসনীয়।
রবীন্দ্র চর্চা
সম্প্রতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করল আরামবাগের অন্যতম সঙ্গীত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ‘হিন্দোল’। শহরের রবীন্দ্রভবনে আয়োজিত এই অনুষ্ঠান ছিল নাচ, গান, নাটক, নৃত্যনাট্য। ১৯৮৫ সালে স্থাপিত হওয়ার পর থেকেই আয়োজক সংস্থা আরামবাগের সংস্কৃতিচর্চার অন্যতম মুখ হয়ে উঠেছে। সংস্থার অধ্যক্ষা যূথিকা মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “শহরের বিভিন্ন পেশায় মানুষ এবং শুভানুধ্যায়ীদের সহযোগিতায় সংস্কৃতিচর্চা করার সুযোগ পাচ্ছি।”
বসল মূর্তি
সম্প্রতি ডায়মন্ডহারবার ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের নুনগোলা পাড়ায় প্রবীণ নাগরিকদের উদ্যোগে বসল রানি রাসমণির কংক্রিটের মূর্তি। ৫ ফুটের এই মূর্তিটি তৈরি করেছেন প্রবীণ নাগরিক শুভেন্দু শাসমল। তিনি বলেন, ‘‘মূর্তির পাদদেশে লাগানো পাথরে রাসমণির জীবনের অনেক তথ্য লেখা রয়েছে।’’
অন্য গোস্বামী
লেখাও আমার যেন ঘুমের বালিশ/ যেন দ্রুত মাঠ থেকে সান্ধ্য-গানে ফেরা/ ধুলোমগ্ন ত্রিভুবনে পদশব্দ তার যেন স্বপ্ন মাঠময়....../ যেন ছেঁড়াছেঁড়া...
নিজস্ব কাব্যভাষা নিয়ে বাংলা কাব্য সাহিত্যে উজ্জ্বল এই কবি, মলয় গোস্বামী। শেষ সত্তরে আর্বিভূত কবি শৈশব থেকেই সংস্কৃতির মধ্যে দিয়ে চলেছেন। আবৃত্তি, অভিনয়, নাট্য পরিচালনা, ছবি আঁকা, একই সঙ্গে চলেছে আজও। সম্প্রতি প্রকাশ হল তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘নিহত তারার আলো।’ যেন বাংলার আর এক পূর্ণেন্দু পত্রী। বাংলা-সাহিত্য-সুর-শিল্পের সৌরজগতের সমস্ত বৃত্তে পত্রীর মতই স্বচ্ছন্দ যাতায়াত মলয়েরও। বাবার কাছে শিখেছেন ছন্দের জাদু ও বাঁশের বাঁশি। কবিতা লেখার আগেই লিখেছেন নাটক ও গল্প। ১৯৭২ সালে ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ নাটকে অভিনয় করবার সময় শিল্পের বিষয় তাঁর ভেতরে তোলপাড় তোলে। সত্তরের মধ্যভাগ থেকে গানে সুর দিতে শুরু করেন। এখনও তা বহমান। যদিও তাঁর সব পরিচয় ছাপিয়ে আজ তিনি কবি। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘স্মৃতিতে সময়ে ছুঁড়ি অলৌকিক জাল,’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৯ সালে। আশির দশকের পাঠক ও সমালোচকদের কাছে তাঁর কবিতা ছিল অতীব প্রিয়। তখনই লিখেছিলেন, ‘কে বলে ছন্দে লিখি? পশুর মতন গন্ধে লিখি।’ কাব্য প্রেমিকদের মুখে-মুখে ফিরতো এই কবিতা পঙক্তি।
নব্বইয়ের দশকে পূর্ণিমা গোস্বামী ছদ্মনামে অজস্র নারীবাদী কবিতা লিখে তিনি বাংলা কবিতা জগতে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। কিন্তু বহুমুখী প্রতিভার ওই কবি হঠাৎ করে কেন যেন প্রকাশবিমুখ হয়ে নিজেকে নির্জনে লুকিয়ে ফেললেন, কবি তা আজও প্রকাশ করেননি। সীমান্ত শহর বনগাঁর বাসিন্দা মলয় গোস্বামী কিন্তু আজও সৃষ্টিশীল। প্রকাশিত উপন্যাস ন’টি। বিগত আট বছর ধরে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় ছোটগল্প প্রকাশ হচ্ছে। ওই লেখাই তাঁর সংসারের দিনগুজরানের মালিক। অথচ একটা সময় মলয় সর্বভারতীয় প্রকাশন সংস্থার বাংলা ম্যাগাজিনে সাংবাদিকতা করেছেন। কলকাতায় চাকরি করবেন বলে ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে কলকাতার কাছে ভাড়া বাড়িতে এক যুগেরও বেশি সময় কাটিয়েছেন। এখন অবশ্য বেছে নিয়েছেন ইছামতী নদী পাড়ে গোপন নির্জন বাতাসকে। সেখানেই দিন রাত এক করে চলে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, ছবি আঁকার পাশাপাশি সঙ্গীতচর্চা। ষাটোর্ধ্ব মলয়ের রবীন্দ্রসঙ্গীতের একটি অ্যালবামও প্রকাশিত হতে চলেছে। ১৯৯৭ সালে শক্তি চট্টোপাধ্যায় স্মৃতি পুরস্কার ছাড়াও ঝুলিতে রয়েছে বহু পুরস্কার। মলয়ের কাছে পাঠকের একমাত্র কৌতূহল, এক সময় বাংলা ভাষার প্রত্যেকটি উল্লেখযোগ্য পত্র পত্রিকা এবং দৈনিকপত্রে যিনি লিখেছেন অসংখ্য গদ্য, কোন অভিমানে তিনি এমন অজ্ঞাতবাসে? এর উত্তর হিসেবেই কি কবি সাম্প্রতিক কাব্যগ্রন্থের এক কবিতায় লিখেছেন,
‘‘কে আজ বাড়াবে আলো ! সে কি আজ, বাড়ি ফিরে আসে?
আলো-অন্ধকারে থাকি।’’
কিছু কিছু আড়ালে আভাসে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy