Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

উদার হিন্দুধর্মের কথা যাঁদের মনে আছে

এক জন হিন্দু যে সহনশীল কিংবা ধর্মনিরপেক্ষ নাগরিক হতে পারেন, নারীস্বাধীনতায় বিশ্বাসী, জাতপাতে অবিশ্বাসী মানুষ হতে পারেন, সেই কথাটা বলার লোক যেন চারপাশে ক্রমেই বিপজ্জনক ভাবে কমে যাচ্ছে।এক জন হিন্দু যে সহনশীল কিংবা ধর্মনিরপেক্ষ নাগরিক হতে পারেন, নারীস্বাধীনতায় বিশ্বাসী, জাতপাতে অবিশ্বাসী মানুষ হতে পারেন, সেই কথাটা বলার লোক যেন চারপাশে ক্রমেই বিপজ্জনক ভাবে কমে যাচ্ছে।

সর্বমঙ্গলা। উৎসবের এই মিলন কি হারিয়েই ফেলব?

সর্বমঙ্গলা। উৎসবের এই মিলন কি হারিয়েই ফেলব?

পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০৪
Share: Save:

আজকাল যদিও এ সব বিষয় নিয়ে কেউ কথা বলে না। ধর্ম বা স্পিরিচুয়ালিটি নিয়ে কথাবার্তা বলাটা আউট অফ ফ্যাশন। তবু চারপাশের ঘটনাক্রম দেখে সম্প্রতি কথাটা তোলার একটা তাগিদ তৈরি হচ্ছে। তিরিশ বছরের আমেরিকা প্রবাসকালে মাত্র এক বার দেশে ফিরে দুর্গাপুজো দেখার সুযোগ হয়েছে। উৎসবের অপার আনন্দের, প্রাণভরা আন্তরিকতার শরিক হওয়ার, জনারণ্যে মিশে যাওয়ার রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হয়েছে। বাকি ঊনত্রিশ বছর বিদেশ বিভুঁইয়ে অন্য রকম কেটে গিয়েছে।

প্রথম কয়েকটা বছর পুজোর দিনগুলোতে কলকাতায় ফোন করে টেলিফোনটা কানের ওপর জোর করে চেপে ধরে পাশের বাড়ি পুজোর ঢাকের আওয়াজ শুনতাম। তাও বেশি শোনা হত না, কারণ দশ মিনিট ফোন করতে পঁচিশ তিরিশ ডলার লাগত। তখন গরিব ছাত্র। অত টাকা কোথায়? তখন তো ইন্টারনেটও নেই, স্কাইপও নেই।

পরে নিউ ইয়র্ক রাজ্যের রাজধানী অলবানি শহরে থাকার সময়ে সেখানকার দুর্গাপুজোয় ভালো করে অংশ নেওয়ার সুযোগ হল। নিজে বাঙালি ক্লাবের প্রেসিডেন্ট হয়ে এক বছর পুজো অর্গানাইজও করা গেল। হইহই, গানবাজনা, নাটক, খিচুড়ি, মাংস, দেশের স্বাদ বিদেশে। তবে দুধ আর ঘোলে যত ফারাক, এখানেও তেমন। প্রথম ফারাক, প্রবাসের নিজস্ব নিয়মে, পুজোর সব দিন এখানে পুজো নয়, উইকএন্ডে পুজো।

তার পর গত পনেরো বছর ধরে অনেক পুজো, অনেক মন্দির, পশ্চিমবঙ্গের অভিবাসীদের পুজোয় যথাসাধ্য বিলাসিতা, অগ্রে চাঁদা, পশ্চাতে প্রতিমাদর্শন। মাংস খাওয়া নিয়ে ঠাকুরের সামনেই মারামারি। আবার বাংলাদেশি অভিবাসীদের মন্দিরে শান্তি। চাঁদার জুলুম নেই, সম্মান, শ্রদ্ধা, খোঁজখবর নেওয়ার চল আছে।

এই সব উৎসবের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে যে কথাটা সবচেয়ে বেশি মনে হয়েছে, তা হল আমাদের ধর্মের কথা, আমাদের সংস্কৃতি, শিল্প, সঙ্গীত, সাহিত্যের কথা সাধারণ বিদেশিরা কেউ জানেই না। অথচ খ্রিস্টান, ইহুদি ও ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে সাধারণ আমেরিকানরা অনেক বেশি কিছু জানে। প্রথম দুটিই এদেশে সম্মানিত ও সংবাদমাধ্যমে বহুল প্রচারিত। হাজার টিভি শো, সংবাদপত্র ম্যাগাজিনে অসংখ্য রচনা তাদের সম্পর্কে। খ্রিস্টমাস, ইস্টার, ইয়ম কীপুর এগুলো ছুটির দিন। ইসলামি মৌলবাদী সন্ত্রাসের সঙ্গে সঙ্গে মুসলমানরা এ দেশে নিন্দিত, এবং জাতিবৈষম্যের শিকার হয়ে উঠেছেন। ২০০১ সালের এগারোই সেপ্টেম্বরের পরে অসংখ্য নিরীহ মুসলমানকে আমেরিকার নিপীড়ন নিষ্পেষণ, জেলহাজত ও দেশ থেকে বিতাড়নের শিকার হতে হয়েছে। কিন্তু তাও, এই তিন আব্রাহামিক ধর্মের প্রতি মানুষ কিছু কিছু জানে, উদারমনের মানুষরা তিন ধর্ম বিষয়েই সহনশীল। ইদ-এর কথা এখন সবাই প্রায় জানে।

হিন্দুধর্ম সেই তুলনায়— না, ঠিক ব্রাত্য নয়, যেন অনুপস্থিত। বেশির ভাগ অহিন্দুর কাছে হিন্দুধর্মের অর্থ জাতিভেদ, বর্ণভেদ, শূদ্রের ওপর ব্রাহ্মণের অত্যাচার। হিন্দুরা প্রধানত সংস্কার, থুড়ি, কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। পৃথিবীর ইতিহাসে হিন্দুদের কী অবদান, কেউ তেমন জানে না। কৈলাস, খাজুরাহ, কোনার্ক, মীনাক্ষীপুরম-এর কথা জানেন কেবল বিশেষজ্ঞরা, ইতিহাসবিদরা। ভারতের বর্তমান যেন তৈরি হয়েছে কেবলই ভারতের ব্রিটিশ উপনিবেশ হওয়ার উপর ভর করে, বাকি সব অপ্রাসঙ্গিক, অনুপস্থিত।

চার দিন ধরে এই যে অবিশ্বাস্য ধর্ম, শিল্প, সঙ্গীতের মেলা মহামানবের এই সাগরতীরে, তার খবর পশ্চিমি মিডিয়া রাখে না। যে সব আয়োজকরা নিউ ইয়র্ক, লস এঞ্জেলেস, টরন্টো, লন্ডন, শিকাগো, হিউস্টনে দুর্গাপুজো করেন, তাঁদেরও কোনও রকম প্রচেষ্টা নেই বাকি পৃথিবীর কাছে পুজো নামক উৎসবের ছবি তুলে ধরার। এই উৎসব যে কেবলই সংকীর্ণ ধর্মাচার নয়, তার থেকে অনেকখানি বেশি, প্রায় একটা জীবনদর্শন, এ সব কথা তাঁরা নিজেরাও ভাবেন না, অন্যদেরও বলেন না। পুজো বলতে কেবল নিজেদের ফেলে-আসা দেশের অভাববোধ আর নস্টালজিয়াতে ডুবে থাকেন।

নতুন প্রজন্মের প্রবাসী হিন্দুদের নিয়ে আর এক মুশকিল। ধর্ম বা স্পিরিচুয়ালিটি নিয়ে সিরিয়াস কথাবার্তা যেহেতু ‘হিপ’ নয়, এই নতুন প্রজন্ম এক দিকে ধর্ম-জ্ঞানবর্জিত, অন্য দিকে মুসলমান-বিদ্বেষী, বর্ণবিদ্বেষী, এবং বিজেপি সমর্থক। তাঁরা হিন্দুধর্মের উদারনৈতিক দর্শন সম্পর্কে কোনও কথা শোনেননি, শুনতে নারাজও বটে। এই যদি সাধারণ ধারাটি হয়, একটা নতুন লিবারাল এলিট ধারাও আছে, যাঁরা প্রতি মুহূর্তে প্রমাণ করতে ব্যস্ত যে তাঁরা কত বেশি ধর্মনিরপেক্ষ, এবং/সুতরাং হিন্দুবিদ্বেষী।

মাঝখান থেকে হিন্দুত্ব এখন কেবলই একটা পশ্চাৎপদ, অবাঞ্ছিত শব্দ। অথচ হিন্দু ধর্ম মানেই কিন্তু সংগঠিত হিন্দুত্ব নয়, হিন্দু মৌলবাদ নয়, কোনও দিন ছিল না। বজরং দল, শিবসেনা, আর বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতিবাচক হুহুংকারই হিন্দুত্বের একমাত্র অর্থ ও পরিচয় ছিল না, আজও নয়। এক জন হিন্দু যে সহনশীল কিংবা ধর্মনিরপেক্ষ নাগরিক হতে পারেন, নারীস্বাধীনতায় বিশ্বাসী, জাতপাতে অবিশ্বাসী মানুষ হতে পারেন, সেই কথাটা বলার লোক যেন চারপাশে বিপজ্জনক ভাবে কমে যাচ্ছে। একটা হিন্দুধর্ম আছে যা সবাইকে আপনার করে নেবার কথা বলে, ‘বসুধৈব কুটুম্বকম্’ বলে, ‘যত মত তত পথ’ বলে, তা আজ বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যেতে বসেছে। যে ভারতে আর্য অনার্য দ্রাবিড় চিন শক হূণদল পাঠান মোগল একদেহে লীন হতে পেরেছে, সেই ভারতেই যে হিন্দুত্ব বিরাজ করত, করেছে, করে থাকে, কে তা জানে। কে জানে, সরস্বতীই বেদের আদি দেবী, কিংবা দুর্গা, কালী ও জগদ্ধাত্রী জগতের সবচেয়ে শক্তিমতী ও অসুরনিধনকারিণী? নারীশক্তিকে সবচেয়ে ওপরে স্থান দেওয়া হয়েছে কোন ধর্মে, তুখোড় নারীবাদীরাও ক’জন জানেন?

স্বামী বিবেকানন্দ আমেরিকা সফরে একটা মন্তব্য করেছিলেন, ‘The Hindu religion does not consist in struggles and attempts to believe in a certain doctrine or dogma, but in realizing – not in believing, but in being and becoming.’ বিবেকানন্দকে যাঁরা মৌলবাদী বলে মনে করেন, এবং বিবেকানন্দকে যে মৌলবাদীরা নিজেদের সম্পত্তি বলে মনে করেন, তাঁরা সকলে মিলে এই সমাজবাদী সন্ন্যাসীর এ সব কথাবার্তা বিস্মৃত হতে সাহায্য করেছেন। আজকাল ‘উদারতা’ বলতে আমরা ধরে নিতে শিখেছি, গঁাধী ও নেহরুর চাপিয়ে দেওয়া বহুত্ববাদ। যেন হিন্দুধর্মে উদারতা নামক বস্তুটা ছিল না, যেন হিন্দুধর্ম আর উদারনীতি চিরকাল পরস্পরবিরোধী। এই উদারনৈতিক হিন্দুধর্মে বিশ্বাস করার জন্য সোশ্যালিস্ট, কমিউনিস্ট কিছুই হতে হবে না, কিংবা এগুলোর সব কিছুই হওয়া সম্ভব।

দুর্গাপুজোর সময় আমার প্রতি বারই মনে হয়, এই উদারনৈতিক, মানবতাপন্থী হিন্দুত্বের কথা অন্যদের, আমাদের নিজেদেরও মনে করিয়ে দেওয়া দরকার। আরএসএস, এবিভিপি, বজরংবালিদের হিংসা ও ঘৃণার কোটর থেকে হিন্দুত্বকে বার করে আনা দরকার। সেই হিন্দুত্বের বিজ্ঞাপন দরকার, যেখানে ব্রাহ্মণ ও অব্রাহ্মণ একসঙ্গে বসে পাত পেড়ে খায়, যার পুজো উৎসবে প্রতিবেশী মুসলমান ও খ্রিস্টান পরিবার মহোৎসাহে যোগ দেয়। সেখানে এক জন আর এক জনকে জানার, বোঝার সেতু তৈরি হয়, সেতু ভেঙে ফেলার কর্মযজ্ঞ চলে না।

এই সেতুটা রক্ষা করতে পারলে, এবং তার কথা বাইরের পৃথিবীকে জানাতে পারলেই বোধহয় একমাত্র ধর্মান্ধতা ও চরমপন্থার হাত থেকে রেহাই-এর পথ খুঁজে পাওয়া সম্ভব। এক দিকে ধর্মের নামে বিদ্বেষ-ব্যবসা, বিদ্বেষের রাজনীতি, আর অন্য দিকে ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, ধর্মকে অস্বীকার ও অতিক্রম করার মধ্যে হিন্দু সমাজের যে অংশটা পড়ে আছে, তাদেরই দায়িত্ব এই কাজটা করা। আমার মনে হয়, আমার হিন্দুধর্ম আমার অস্তিত্ব, এটা যেমন সত্যি, আমার সেই ধর্মের বোধে লোভ, হিংসা, ঘৃণা এবং বিদ্বেষের কোনও স্থান নেই, সেটা বোঝা ও বোঝানোটাও তেমন অসম্ভব জরুরি একটা কাজ।

সেই চিরন্তন উদার হিন্দুধর্মের এক ধার্মিক হিসেবে মনে হল: এই কথাটা বলার জন্য দুর্গাপুজোর থেকে ভাল সময় আর কী-ই বা হতে পারে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE