Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

জিইয়ে রাখা হচ্ছে ভয়ের বাতাবরণ

হয়তো সত্যিই আশা ছেড়ে দেওয়ার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি আমরা। হয়তো সত্যিই মুক্তচিন্তার জন্য ন্যূনতম নিরাপত্তাটুকুও আর নেই কোথাও। তবু, যদি উঠে না দাঁড়াই আজ, এই বেঁচে থাকাও মৃত্যুরই শামিল তবে।ম ন থেকে একটা বিশ্বাস খুব দ্রুত গতিতে মুছে যাচ্ছে যে, এই পৃথিবীতে ব্যক্তিস্বাধীনতার আদৌ কোনও চলমান স্থান থাকবে কোথাও। ব্যক্তিস্বাধীনতা নামক ধারণা ও যাপন অচিরেই অতীতের উপাদান হয়ে পড়বে না, এমন প্রত্যয় থাকছে না আর।

শিকার। অভিজিৎ রায় (বাঁ দিকে) ও মহম্মদ ইখলাক।

শিকার। অভিজিৎ রায় (বাঁ দিকে) ও মহম্মদ ইখলাক।

শ্রীজাত
শেষ আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০১৫ ০০:০০
Share: Save:

I don't believe we shall ever again have any form of society in which men will be free. One should not hope for it. One should not hope for anything. Hope is invented by politicians to keep the electorate happy.

Pier Paolo Pasolini

ম ন থেকে একটা বিশ্বাস খুব দ্রুত গতিতে মুছে যাচ্ছে যে, এই পৃথিবীতে ব্যক্তিস্বাধীনতার আদৌ কোনও চলমান স্থান থাকবে কোথাও। ব্যক্তিস্বাধীনতা নামক ধারণা ও যাপন অচিরেই অতীতের উপাদান হয়ে পড়বে না, এমন প্রত্যয় থাকছে না আর।

লিখতে বসে মনে হচ্ছে, এই একই কথা গত দু’বছরে কত ভাবে লিখেছি বা বলেছি? কিন্তু একই বর্বরতার উল্টো মুখে দাঁড়িয়ে সেই একই কথা বলে চলা ছাড়া আর সত্যিই কী করণীয় আছে আমাদের? আমার অন্তত জানা নেই।

এক বছর সময়সীমার মধ্যে ব্লগার ও প্রকাশক মিলিয়ে পাঁচ জনকে প্রাণ হারাতে হল বাংলাদেশের মাটিতেই। এবং ঠিক একই ভাবে। কী তাঁদের অপরাধ আর কারা তাঁদের নিধন করে চলেছে একের পর এক, এ তথ্য এখন গোটা পৃথিবীর জানা। যা জানা নয় তা হল এই যে, এই হত্যা-পরম্পরা নির্মূল করবার উপায় কী হতে পারে। এত বার মৃত্যুদায়ী আঘাতের পরেও যেটা স্বস্তির বিষয়, ও পার বাংলার স্বাধীনচিন্তার মানুষজন ভয় পেয়ে লেখা বা বলা বন্ধ করে দেননি। যে কোনও মুহূর্তে গলায় চাপাতি’র কোপ নেমে আসতে পারে জেনেও কণ্ঠকে সরবই রেখেছেন। এর জন্য হিম্মত লাগে।

কিন্তু কত দিন? কত জন? প্রশাসনিক ভাবে কিছু করা সম্ভব কি না, আমাদের মতো সাধারণ নাগরিকেরা তা বুঝবেন না। কিন্তু যদি সম্ভব না হয়, তা হলে আমরা, এই গোটা উপমহাদেশ, আধুনিক যুগ থেকে চিরকালের মতো স্খলিত হব। প্রকৃত গণতান্ত্রিক পরিসর থেকে এমন ভাবেই বিচ্যুত হব যে, সেই আবহাওয়ায় আর ফেরা হবে না। এখন, নয়তো কখনও না। এই মূহূর্তে পরিস্থিতি এই রকমই।

কেবল প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কথা বললে চলবে কেন? এই গ্রহ আমাদের দেশকে বৃহত্তম গণতন্ত্রের স্বীকৃতি দিয়েছে। কোন ভারতবর্ষের জন্য, সেই শিরোপা? যেখানে ন্যূনতম সহিষ্ণুতা অবশিষ্ট নেই আর? আমি এখনও পশ্চিমবঙ্গে বসে স্বাধীন ভাবে কথা বলতে পারছি। হয়তো কর্নাটকে পারব না, মহারাষ্ট্রে পারব না, উত্তরপ্রদেশে পারব না। সংখ্যাগুরু উগ্রবাদীর দল আমার গলা নামিয়ে দিয়ে যাবে। মত প্রকাশের স্বাভাবিক অধিকার কি আমার দেশের বহু অঞ্চলেও বিপন্ন নয়? কখনও লেখকরা বিতাড়িত হচ্ছেন, কখনও কাজ অপছন্দ হলে মুখে কালি ছেটানো হচ্ছে, কখনও প্রবাদপ্রতিম শিল্পীর অনুষ্ঠান বাতিল হচ্ছে, আর ‘জেদ’ ধরে বসে থাকলে প্রাণ খোয়াতে হচ্ছে। এই ভারতবর্ষকে আমি কয়েক বছর আগেও চিনতাম না। আজও চিনি না।

গত কয়েক দিনের ধারাবাহিক ঘটনাগুলো এই অসহিষ্ণুতার চূড়ান্ত উদ্‌যাপন ছুড়ে দিয়েছে আমাদের মুখের উপর। সরকারি ভোজনালয়ে গোমাংসের গুজবে পুলিসি হানা থেকে শুরু করে বাড়িতে গোমাংস মজুতের সন্দেহে পিটিয়ে খুন। এ-ও তো সরাসরি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। একেবারে ব্যক্তিগত যাপনের খানাতল্লাশি। বাংলাদেশে যেটা রাষ্ট্রবিরোধী মৌলবাদীরা করছে, আমার দেশে তার অনেকটাই ঘটছে রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদতে। নীরবতাও তো এক ধরনের সম্মতি।

কিন্তু খেয়াল করে দেখলে, দু’পাশেই এক অঘোষিত নজরদারি চলছে। আর ঘোষিত ফতোয়া। তুমি কী লিখছ, তুমি কী খাচ্ছ, তুমি কোথায় যাচ্ছ... সব আমি নজরে রাখছি। সব কিছুর হিসেব থাকছে আমার কাছে। হিসেবে গরমিল হলে চাপাতি বা তলোয়ার বা নেহাত লাঠিতেই তোমাকে সরিয়ে দেওয়া হবে। তোমার রাজপথ থেকে রান্নাঘরের মানচিত্র আমিই এঁকে দেব। আমার টেনে দেওয়া রেখার বাইরে একটা পা-ও যেন না পড়ে। এই ভয়ের বাতাবরণটা জিইয়ে রাখা হচ্ছে ক্রমাগত। অভিজিতের হত্যার পরেও নিলয় নীল বা ওয়াশিকুরেরা সাহস ধরে রাখতে পেরেছেন। আবার মুহম্মদ ইখলাকের হত্যার পর সাধারণ নাগরিক সাহস না-ই পেতে পারেন। সে ক্ষেত্রে কাউকে দোষ দেওয়া যাবে না। রান্নাঘরের চাবি রাষ্ট্রের হাতে তুলে দিয়ে যদি প্রাণে বাঁচা যায়, তো ক্ষতি কী?

রাজীব হায়দার, নরেন্দ্র দাভোলকর, অনন্তবিজয় দাশ, এম এম কালবুর্গি বা সদ্য নিহত ফয়সল আরেফিন দীপন। নামগুলো একই সারিতে রাখা যায় এখন। এঁদের রাষ্ট্র আলাদা, ধর্ম ভিন্ন, প্রেক্ষিতও পৃথক। কিন্তু এঁরা প্রত্যেকেই ধর্মীয় মৌলবাদের শিকার, অথবা ধর্মকে ঢাল বানিয়ে নেওয়া কিছু ভীরু অশিক্ষিতের আক্রোশের বলি। এই উপমহাদেশে বিভাজন আসলে এখন একটাই। মুক্তচিন্তা বনাম মৌলবাদ। ধর্মের ভিত্তি আলাদা হলে মৌলবাদ বা তার প্রয়োগ আলাদা হয়ে যায় না। ধর্ম মানুষের হয়, হত্যার নয়। অতএব পুঞ্জীভূত মৌলবাদের বিরুদ্ধে সামগ্রিক মুক্তচিন্তার এই লড়াইয়ের ময়দানে এখন আমরা দাঁড়িয়ে। গোটা পৃথিবীর সামনে মাথা হেঁট হতে তো কিছু বাকি নেই, মাথা কাটা যাওয়াটাই যা বাকি।

অভিযোগ করলাম অনেকগুলো। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, মৌলবাদের বিরুদ্ধে। এ বার কিন্তু নিজেদের দিকে আঙুল তোলার সময় এসেছে। আমরা সাধারণ নাগরিকরা কত জন বুকে হাত রেখে বলতে পারব, এই অসহিষ্ণুতার চারা আমাদের মগজেও বেড়ে উঠছে না? এই ধর্মান্ধতার আঁচে আমরাও অজান্তে হাত সেঁকে ফেলছি না? খুব বেশি জন বোধহয় পারব না। প্রায় প্রত্যেকেই নিজের ভিন্ন অপর ধর্ম এবং তার অনুগামীদের প্রতি রক্তবাহিত এক দূরত্ববোধ অর্জন করে আসছি যেন। কেবল দূরত্ব হলে তবু হত। সেই দূরত্বের মধ্যে নিহিত আছে প্রশ্নাতীতভাবে ভুল বোঝা, অনেকখানি বিতৃষ্ণা এবং হ্যাঁ, ক্ষেত্রবিশেষে ঘৃণাও বটে।

নিজের মতামত ব্যক্ত করার তাগিদে ইদানীং ফেসবুককে নিয়মিত ব্যবহার করি, পাল্টা তর্ক বা আলোচনার আহ্বানও পাই প্রায়শই। আর বিস্মিত হই কিছু মানুষের নির্লজ্জ অন্ধতার গর্বিত ঘোষণা দেখে। অভিজিৎ রায়ের হত্যার প্রতিবাদে কবিতা লিখলে কিছু মানুষ এসে বলেন, এক জন হিন্দুর মৃত্যুতে প্রতিবাদ করলেন, কোনও মুসলমান খুন হলে কলম চলত কি? আবার মুহম্মদ ইখলাকের হত্যার বিরুদ্ধে সরব হলে তাঁদেরই উল্টো পিঠ বলেন, যখন হিন্দুরা কোতল হন, আপনাদের পাওয়া যায় না কেন? আর দু’দলই বলেন, কেবল আমাদের দোষই দেখলেন, ওদের কোনও দোষ নেই? এঁরা অবজ্ঞার যোগ্য, ঘৃণার নন।

অথচ এঁরাই তো ভোট দেন, সরকার নির্বাচন করেন এঁরাই। এঁরাই এখনও নিজের ধর্মের বাইরের প্রতিবেশীকে অবলীলায় ‘ওরা’ বলে বিচ্ছিন্ন করে দেন, মৌলবাদের কোপে নিহত মানুষের ধর্ম বিচার করে তবে মুখ খোলেন। এঁরা রাষ্ট্র নন, এঁরা মৌলবাদ নন। কিন্তু এঁরাই বার বার বিভাজনের বারান্দাটা হাট করে খুলে দেন, যাতে চৌকাঠ পেরিয়ে ধর্মসেনারা ঢুকে আসতে পারে।

হয়তো সত্যিই আশা ছেড়ে দেওয়ার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি আমরা। হয়তো সত্যিই মুক্তচিন্তার জন্য সম্ভ্রম তো দূর, ন্যূনতম নিরাপত্তাটুকুও আর নেই কোথাও। হয়তো সত্যিই সর্বার্থে স্বাধীন মানবজাতি এক অলীক ধারণামাত্র। কিন্তু প্রতিরোধ আর স্বপ্নও তো মানুষেরই ইতিহাসে আছে। দেরি যথেষ্টই হয়ে গিয়েছে। তবুও, যাদের প্রাণ চলে যায়নি এখনও, তারা যদি উঠে না দাঁড়াই আজ, এই বেঁচে থাকাও মৃত্যুরই শামিল তবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE