Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

ফুটপাথ কাহার

প্রয়াত সুভাষ চক্রবর্তী নাকি বলিতেন, মৃত মানুষকে বাঁচাইয়া তোলা ব্যতীত তাঁহার অসাধ্য কোনও কাজ নাই। কথাটির মধ্যে সত্যের মিশেল ছিল— হাজার হউক, তিনি জ্যোতি বসুকে বসাইয়া ‘হোপ ৮৬’ দেখাইয়াছিলেন।

শেষ আপডেট: ১২ জানুয়ারি ২০১৭ ০০:১৮
Share: Save:

প্রয়াত সুভাষ চক্রবর্তী নাকি বলিতেন, মৃত মানুষকে বাঁচাইয়া তোলা ব্যতীত তাঁহার অসাধ্য কোনও কাজ নাই। কথাটির মধ্যে সত্যের মিশেল ছিল— হাজার হউক, তিনি জ্যোতি বসুকে বসাইয়া ‘হোপ ৮৬’ দেখাইয়াছিলেন। কিন্তু, তিনিও কলিকাতার ফুটপাথকে হকারমুক্ত করিতে পারেন নাই। তাঁহার হাতে ফুটপাথে যে সূর্যোদয় ঘটিয়াছিল, তাহা অস্তমিত হইতে সময় লাগে নাই। তাঁহার আমলে যেমন ছিল, কলিকাতা এখনও তেমন আছে— ফুটপাথে হকার, অতএব পথচারী ও যানবাহন রাস্তায় পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। এই পত্রিকার সাম্প্রতিক সমীক্ষায় নূতন করিয়া স্পষ্ট হইয়াছে, প্রভাবশালী নেতা ও প্রশাসনের কর্তাদের মন জুগাইয়া চলিতে পারিলেই ফুটপাথে মৌরসিপাট্টা নিশ্চিত। রাস্তার ধারে ফুটপাথ নামক পরিসরটি রাখিবার প্রথা যে নিছক অকারণ নহে, অথবা তাহার অস্তিত্বের কারণ যে ব্যবসায়িক কেন্দ্র হইয়া উঠা নহে, এই কথাটি কলিকাতার অভিভাবকরা স্বীকার করিবেন না। কেন, সেই উত্তর বহুচর্চিত। তাঁহাদের আপত্তিকে আমল দিবার বিন্দুমাত্র কারণ নাই। ফুটপাথের একমাত্র অধিকার পথচারীর। তাঁহাদের সেই অধিকার ফিরাইয়া দেওয়া আবশ্যক। কোনও সভ্য শহরে এই দাবিটি করিবার প্রয়োজনই হয় না‌, কারণ ফুটপাথ বেদখল হওয়ার সম্ভাবনা সেখানে কল্পনাতীত। কলিকাতায় দাবিটি তীব্র ভাবে পেশ করা জরুরি।

যাঁহারা ভোটের রাজনীতির তাগিদে হকার উচ্ছেদের বিরোধী, তাঁহাদের আপত্তি অগ্রাহ্য করিলেও চলিবে। কিন্তু, সেই সংকীর্ণতার বাহিরেও প্রশ্ন উঠিবে। কেহ বলিতে পারেন, ফুটপাথে যাঁহারা ব্যবসা করেন, তাঁহারা বাধ্য হইয়াই করেন। উচ্ছেদ করিলে তাঁহাদের না খাইয়া মরিতে হয়। পথচারীর হাঁটিবার অধিকার আর হকারদের রুজির অধিকারের মধ্যে কোনটি অগ্রগণ্য? প্রশ্নটি আবেগমথিত, এবং ভুল। সরকার অথবা প্রশাসন হকারদের রুজিরুটি রক্ষায় চিন্তিত হইতেই পারে। বস্তুত, অন্যান্য বহু চিন্তার তুলনায় এইটি অনেক কম ক্ষতিকারক চিন্তা। কিন্তু, সেই রুজি নিশ্চিত করিবার পন্থা ফুটপাথ দখল করিতে দেওয়া নহে। হকারদের জন্য নির্দিষ্ট অঞ্চলের ব্যবস্থা হউক। বস্তুত, কলিকাতায় তেমন বাজার একাধিক গঠিত হইয়াছে। হকারদের সেই বাজারে পুনর্বাসন দেওয়া হউক। প্রয়োজনে, দিল্লিতে যেমন কন’ট প্লেস অঞ্চলকে গাড়িমুক্ত করিবার চিন্তা চলিতেছে, কলিকাতাতেও কিছু নির্দিষ্ট এলাকা হকারদের জন্য নির্ধারিত হউক। কিন্তু, তাহার বাহিরে কোনও ফুটপাথে এক জন হকারকেও বসিতে দেওয়া চলে না। সেই ক্ষেত্রে নির্মম ও ব্যতিক্রমহীন উচ্ছেদই দাওয়াই।

কেহ বলিতে পারেন, ফুটপাথে দখলদার যে শুধু হকাররাই, তাহা নহে। বহু গৃহহীন পরিবার কলিকাতার ফুটপাথকেই নিজেদের পাকাপাকি ঠিকানা বানাইয়া লইয়াছে। এবং, তাঁহাদের অধিকাংশই রাজ্যের বাসিন্দা নহেন, বহিরাগত, ভিন্‌ রাজ্য হইতে কলিকাতায় আসিয়াছেন। তাঁহারা যে রাজ্যের নাগরিক, তাঁহাদের দেখভাল করিবার দায়ও সেই রাজ্যেরই। বাংলার নিজস্ব সমস্যার বোঝা যথেষ্ট, পড়শির বোঝা বহিবার সামর্থ্য তাহার নাই। এই দখলদারদের স্ব স্ব রাজ্যে প্রেরণ করাই বিধেয়। স্পষ্ট করিয়া বলা প্রয়োজন, এই আপত্তিটি বাল ঠাকরের ভিন্‌ রাজ্যের লোক খেদাইবার রাজনীতি হইতে গোত্রে পৃথক। খাটিয়া জীবিকা অর্জন করিবার জন্য গোটা দেশ এক অভিন্ন বাজার। সেই ক্ষেত্রে রাজ্যের ভৌগোলিক সীমারেখা কোনও বিভাজিকা হইতে পারে না। বস্তুত, অন্য অনেক রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ এই বাজারের প্রশ্নে চিরকালই উদারতর অবস্থান লইয়াছে। কিন্তু, কলিকাতার ফুটপাথবাসীরা সেই বাজারের অংশ নহেন। তাঁহারা উৎপাদনশীল নহেন, বোঝাবিশেষ। সেই বোঝা বহিবার দায় পশ্চিমবঙ্গের নাই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE