বাংলা ভাষায় কিছু শব্দ খামখা নেতিবোধক হইয়া বসিয়াছে, সম্ভবত ভাষাধৃত সংস্কৃতিটির উন্নাসিকতার দাপটেই। এমন একটি শব্দ: অনুকরণ। করণ অর্থাত্ কোনও কাজ দেখিয়া আবার সেই কাজ করিতে বসা যদি অনু-করণ হয়, তবে তাহাকে কেন যে নেতিবাচকই ধরা হইবে, তাহার হেতু খুঁজিয়া পাওয়া ভার। এ দিকে জন্মাবধি নানা জরুরি জীবনচর্যার কাজ অনুকরণের মাধ্যমেই মানুষকে শিখিতে হয়, গত্যন্তর নাই। অনুকরণ আবিষ্কারের মতো বিশিষ্ট না হইলেও অতীতে ঘটে যাওয়া ঘটনার সচেতন পুনরাবৃত্তি ঘটাইবার মাধ্যমে একটি অবস্থান লইবার যে ইচ্ছাটি থাকে, তাহা গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক যেমন, রানাঘাট স্কুলের বাইরে শতাধিক ছাত্রছাত্রী যে ভাবে ‘হোক পরিবর্তন’ প্ল্যাকার্ড লইয়া আন্দোলনে বসিল, তাহাতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘হোক কলরব’ আন্দোলনের স্পষ্ট ছায়া, তবু তাহাকে নেহাত অনুকরণ বলিয়া উড়াইয়া দিলে গভীর অন্যায় ও ভুল হইবে। ভিন্ন প্রেক্ষিতে, ভিন্ন উদ্দেশ্যে আন্দোলনের ধরনটি আবার ফিরাইয়া আনিবার এই চেষ্টায়, উপাচার্য অপসারণের মতো একটি স্থানিক বিক্ষোভের বিশেষ দাবির জায়গায় গোটা সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের প্রার্থনায় ছাত্রছাত্রীরা যে ভাবে বাড়ির আরাম হইতে বাহির হইয়া রাস্তার মালিন্যে অবস্থান লইল, তাহাতে বোঝা যায় এই আন্দোলন এক অত্যন্ত প্রাণবন্ত অনুকরণ। ইহাকেই হয়তো আন্দোলনের ‘নবকলেবর’ বলে: যাহার কলেবরটি যথেষ্ট আলাদা হইলেও অন্তর্লীন স্পিরিটটি সমতুল্য।
আরও গুরুত্বপূর্ণ যে, এই অনুকরণের মধ্যেই করণটির সার্থকতা, সম্ভবত সবচেয়ে বড় সার্থকতা। যাদবপুরের ‘হোক কলরব’ আন্দোলনের রকমসকম দেখিয়া অনেকেই তখন অবহেলায় নাক কুঁচকাইয়াছিলেন, ইহাতে কী হইবে, বড় করিয়া না ভাবিতে পারিলে এমন কলরবে কতটুকুই বা লাভ হইবে। কিন্তু আন্দোলন যে কী ভাবে নিজেকে অলক্ষ্যে নিজেকে জিয়াইয়া রাখিতে পারে, নূতন আন্দোলনের উদ্ভবের কারণ হইয়া দাঁড়াইতে পারে, সে কথা সমালোচকরা খেয়াল রাখেন নাই। প্রতিবাদ যে একটি ঘটনা নয়, একটি সংস্কৃতি, সেই শিল্পবিপ্লবের আমল হইতে নেতারা বলিয়া আসিতেছেন। কৃষক-শ্রমিকদের স্থানীয় প্রতিবাদে উদ্বুদ্ধ করিতে ‘লাডাইট’ নেতারা বলিতেন, ফুলকি হইতে আগুন ধরে, প্রতিবাদ হইতে প্রতিবাদ ছড়ায়। রানাঘাটের এই কিশোর আন্দোলনকারীদের মনে বিক্ষোভের যে অগ্নিই জ্বলিয়া উঠুক না কেন, সেই আগুনকে বৃহত্তর সমাজের সামনে লইয়া আসিবার সাহসটি জোগান দিয়াছে যাদবপুরের তরুণ আন্দোলনকারীরা।
আবার রানাঘাটের প্রতিবাদ দেখিয়া প্রভাবিত হইয়াছে কলিকাতা, প্রান্ত হইতে পুনর্বার কেন্দ্রে আসিয়া পৌঁছাইয়াছে ‘হোক পরিবর্তন’। মাও ত্সে তুং-এর আন্দোলনের ‘টপ-ডাউন’ এবং ‘বটম-আপ’-এর দ্বিমুখী সূত্রটিও ঠিক এমন আদানপ্রদানের কথাই বলিয়াছিল। ‘আরব স্প্রিং’-এও দেখা গিয়াছে, এক শহর হইতে অন্য শহরে, এক দেশ হইতে অন্য দেশে বিক্ষোভ কী ভাবে প্রসারিত হইয়াছে। আন্দোলনের এই স্বপ্রসারণশীল আগুনটিকে প্রজ্বলিত রাখার গুরুত্বটিও মাওয়ের ভাষায় চমত্কার প্রকাশিত হইয়াছিল, অলঙ্কার-সহযোগে! তিনি বলিয়াছিলেন, জলের তাপমান যদি ঠিক রাখা যায় তবে মাছ এমনিই ভাসিবে, এবং আরও মাছের জন্ম দিবে। নেতার নিকট হইতে মাছ আখ্যা পাইয়া কমরেডরা প্রসন্ন হইয়াছিলেন কি না জানা নাই, তবে পশ্চিমবঙ্গের সুকুমারমতি ছাত্রছাত্রীরা এই উপমায় হয়তো আপত্তি করিবেন না। বুঝিবেন, এই কুনাট্যপ্রিয় রাজ্যে বড় মাছেরা যখন ক্রমশই রাজনীতি-পঙ্কে আমূল আবদ্ধ হইতেছেন, সেখানে তুলনায় তরুণ মত্স্যবৃন্দের সচলতাটুকুই রাজ্যের ভরসাস্থল। গণতন্ত্র ও ন্যায়তন্ত্র, পশ্চিমবঙ্গে ক্রম-বিলীয়মান দুই বস্তুর জন্য প্রতিবাদের তরুণ সচলতাটুকুই আপাতত আশার দিশা।
য ত্ কি ঞ্চি ত্
বাঘ বলে কি মহারাষ্ট্রের বাসিন্দা নয় নাকি? গোটা রাজ্যে যখন গোমাংস নিষিদ্ধ, তখন নেহাত গায়ের ডোরার জোরে বিফ খেতে চাইলেই হল? মুম্বইয়ের সঞ্জয় গাঁধী ন্যাশনাল পার্কে বাঘ, সিংহদের জন্য বরাদ্দ হয়েছে বিশুদ্ধ চিকেন। হোয়াইট মিট তাদের তেমন ভাল লাগছে না বলেই আধিকারিকরা জানাচ্ছেন। অবশ্য, রামরাজত্ব আরও কিছু দূর এগোলে রামপাখিও জুটবে না, শাকাহারের ফরমানও আসতে পারে। তখন নিশ্চয়ই রয়াল বেঙ্গল লেজ গুটিয়ে বলবে: হাম্বা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy