Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

অভয়ারণ্য

৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক জানিবে, বিপুল জনসমর্থনের জোয়ার যাঁহাকে রাজ্যের প্রশাসনিক শীর্ষে স্থাপন করিয়াছিল, তিনি ভুলিয়াও রাজনীতির চশমাটি সরাইয়া রাখিতে পারেন না। অবরুদ্ধ রাস্তায় যখন তাঁহার কনভয় থমকাইয়া গেল, বঙ্গেশ্বরী তখন জনতার উদ্দেশে চ্যালেঞ্জ ছুড়িয়া দিলেন, বিক্ষোভের রাজনৈতিক রঙ বিচার করিলেন। বলিলেনও, তিনি বিক্ষোভের রাজনীতিরই সন্তান।

শেষ আপডেট: ১৮ মার্চ ২০১৫ ০০:০৫
Share: Save:

৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক জানিবে, বিপুল জনসমর্থনের জোয়ার যাঁহাকে রাজ্যের প্রশাসনিক শীর্ষে স্থাপন করিয়াছিল, তিনি ভুলিয়াও রাজনীতির চশমাটি সরাইয়া রাখিতে পারেন না। অবরুদ্ধ রাস্তায় যখন তাঁহার কনভয় থমকাইয়া গেল, বঙ্গেশ্বরী তখন জনতার উদ্দেশে চ্যালেঞ্জ ছুড়িয়া দিলেন, বিক্ষোভের রাজনৈতিক রঙ বিচার করিলেন। বলিলেনও, তিনি বিক্ষোভের রাজনীতিরই সন্তান। অথচ, ছাত্রছাত্রী, স্থানীয় বাসিন্দাদের বিক্ষুব্ধ মুখের আড়ালে কী বিপুল অসহায়তা লুকাইয়া আছে, তাঁহার অভিজ্ঞ চোখ সেটুকু দেখিতে পাইল না। সেই বিক্ষোভের পিছনে সিপিআইএম আছে, নাকি বিজেপি, নাকি তাঁহারই দলের বিক্ষুদ্ধ অংশ, সে প্রশ্ন যে অবান্তর, মানুষ যে সত্যই সহ্যের শেষ সীমায় দাঁড়াইয়া আছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুঝিলেন না। চার বত্‌সর মুখ্যমন্ত্রিত্বের পরেও তিনি তৃণমূলনেত্রীই থাকিয়া গেলেন। রাজ্যের সর্বাধিনায়িকা হইবার যোগ্যতা অর্জন করিতে পারিলেন না। নচেত্‌ বুঝিতেন, এক প্রবীণ সন্ন্যাসিনী ধর্ষিত হইলে মানুষ যখন পথে নামে, তখন তাহা রাজনৈতিক তাগিদ হইতে নহে, প্রশাসনের সামূহিক অপদার্থতায় বিপন্ন হইয়া নামে। তিনি প্রকৃত জননেত্রী হইলে সেই ক্ষোভের সম্মুখে নতমস্তক হইতেন। দোষ স্বীকার করিয়া সংশোধনের শপথ লইতেন। কিন্তু, ক্ষুদ্র দলীয় রাজনীতিই যাঁহার অভিজ্ঞান, তাঁহার নিকট এই পরিণতমনস্কতা অ-প্রত্যাশিত।

সত্তরোর্ধ্ব সন্ন্যাসিনীকে ধর্ষণ করা বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মাপকাঠিতেও ব্যতিক্রমী বর্বরতা, সন্দেহ নাই। কিন্তু, আজ হউক বা কাল, এমন নৃশংস বর্বরতায় পৌঁছাইয়া যাওয়া অনিবার্য ছিল। দুঃশাসনই তাহাকে অনিবার্য করিয়া তুলিয়াছে। পশ্চিমবঙ্গে প্রশাসন কথাটিই এখন সম্পূর্ণ অর্থহীন। শাসক দলের পতাকাটি সর্বাঙ্গে ঠিকঠাক জড়াইয়া রাখিতে পারিলে এই রাজ্যে কোনও অপরাধই শাস্তিযোগ্য বলিয়া বিবেচিত হয় না। ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি ইত্যাদি তো নহেই। কোনটি সাজানো ঘটনা, আর কোনটি বিরোধীদের চক্রান্ত, কোন অভিযোগকারী মাওবাদী, সবই মুখ্যমন্ত্রী বলিয়া দিয়াছেন। পুলিশ বুঝিয়া লইয়াছে, শাসক দলের ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী ভিন্ন তাহাদের আর কোনও পরিচয় নাই। তৃণমূলের ইচ্ছাময়ী নেত্রী নিশ্চয়ই ভোটের হিসাব কষিয়া দেখিয়া লইয়াছেন, ইহাতেই তাঁহার লাভ। মারা পড়িয়াছেন রাজ্যবাসী। তাঁহারা জানেন, তাঁহাদের নিরাপত্তাবিধানের জন্য কেহ নাই। ধর্ষিত হওয়া বা একেবারে খুন হইয়া যাওয়া, সবই কপাললিখন। মুখ্যমন্ত্রী বড় জোর বলিবেন, বিরোধীদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। এই অসহায়তার ব্যাপ্তি মুখ্যমন্ত্রী বুঝিবেন না। তিনি মানুষকে ভোটের সংখ্যা হিসাবে চেনেন। তিনি রাজনীতির যূপকাষ্ঠে প্রশাসনকে বলি দিয়াছেন।

রানাঘাটের স্কুলে যাহা হইয়াছে, তাহার জন্য প্রকৃত প্রস্তাবে কে দায়ী, সেই প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানসাপেক্ষ। কিন্তু প্রশাসনের অপদার্থতা ঢাকা দিতে যথারীতি ষড়যন্ত্র তত্ত্বের খোঁজ পড়িয়াছে। সম্প্রতি দেশ জুড়িয়া হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার বাড়বাড়ন্ত হইয়াছে, অস্বীকার করিবার উপায় নাই। হিন্দু মৌলবাদীরা ‘ঘর ওয়াপসি’ করাইতেছেন, বেশ কিছু চার্চ আক্রান্তও হইয়াছে। রানাঘাটের ঘটনা সেই সর্বভারতীয় প্রবণতার অংশ কি না, তাহা বুঝিতে বিস্তারিত তদন্ত প্রয়োজন। সে তদন্ত নিরপেক্ষ হইবে, পুলিশের নিকট তেমন আশা করাও দুষ্কর। কিন্তু, পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ বলিতেছে, ইহা রাজ্যের নিজস্ব সমস্যা। সার্বিক শাসনহীনতাই এই পরিণতি ডাকিয়া আনিয়াছে। এই রাজ্যে প্রশাসন মেরুদণ্ডহীন, পুলিশ কর্তব্যজ্ঞানবিস্মৃত, মুখ্যমন্ত্রী ক্ষুদ্র রাজনীতিসর্বস্ব। এই রাজ্যে অপরাধীর শাস্তি হয় না, মানুষ নিরাপত্তার শেষ আশাটুকুও ছাড়িয়া দিয়াছেন। পশ্চিমবঙ্গ এখন দুষ্কৃতীদের মুক্তাঞ্চল। হয়তো বা অভয়ারণ্য বলাই বিধেয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

editorial anandabazar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE