সাগরের এক পারে সেলুলার জেল, হ্যাভলক, নীলদ্বীপ, রস আইল্যান্ড। অন্য পারে দিঘা, মন্দারমণি, সুন্দরবন, হাজারদুয়ারি। আন্দামান-নিকোবরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর ঐতিহাসিক নিদর্শনকে নির্ভর করে যে ভাবে পর্যটনের বিকাশ ঘটেছে, তা দেখে যে কোনও বাঙালি পর্যটকের মনে হবে, ওরা পারে, আমরা কেন পারি না?
আন্দামানে প্রতি বছর কম করে এক লাখ পর্যটক ঘুরতে যান। বারো আনাই বাঙালি। এই তথ্য আন্দামান ট্যুর অপারেটার্স অ্যাসোসিয়েশনের। সংস্থার সহ-সভাপতি কৃষ্ণ সাহা বলেন, “পর্যটনের বিকাশে এখানকার প্রশাসন সব সময় সচেষ্ট। তার উপরেই নির্ভর করেন আন্দামান-নিকোবরের অধিকাংশ বাসিন্দা।”
পোর্ট ব্লেয়ারের একাধিক পর্যটন ব্যবসায়ী জানান, বেকার সমস্যার সুরাহার জন্য প্রতি বছর পর্যটনকে কেন্দ্র করে নির্দিষ্ট কর্মসংস্থানের পরিকল্পনা করে প্রশাসন। বেসরকারি উদ্যোগকেও উৎসাহ দেয়। হোটেল, রেস্তোরাঁ, ভ্রমণ ব্যবস্থাপকদের মান উন্নয়নের জন্য নিয়মিত নজরদারি চলে। প্রশিক্ষণও।
পর্যটকদের নজর টানতে ‘ওয়াটার স্পোর্টস’কেও এখানকার প্রশাসন বিশেষ গুরুত্ব দেয়। তাঁদের সমুদ্র তলদেশের বাহারি জগৎ দেখানোর জন্য ‘স্কুবা’র প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় স্থানীয় যুবকদের। প্রত্যেকটি নৌকো এবং ‘ওয়াটার স্পোর্টস’-এর সরঞ্জাম রক্ষণবেক্ষণে কড়া নজরদারি রাখা হয়। পর্যটকদের ‘সেফটি জ্যাকেট’ পরে জলযানে ওঠা বাধ্যতামূলক। আন্দামান ট্যুর অপারেটার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহন বিনোদ বলেন, “আমাদের প্রশাসন যে সিদ্ধান্ত নেয়, আমরা মেনে নিই। তাতে আমাদের লাভও হয়েছে।”
আন্দামান পারলে এ পারের বাংলা কেন পারে না? এই প্রশ্নের উত্তরে পশ্চিমবঙ্গের একাধিক পর্যটন ব্যবসায়ী জানান, পর্যটনে বাংলার কী আছে আর কী নেই তা নিয়ে রাজ্য প্রশাসনের কোনও তথ্য ব্যাঙ্ক নেই, পর্যটন পরিকাঠামো সংস্কারেও প্রশাসন গুরুত্ব দেয় না। তাই সেলুলার জেল নিয়ে আন্দামান যা পেরেছে, মুর্শিদাবাদ, বাঁকুড়া-বিষ্ণুপুর, মালদহ এবং কলকাতার ঐতিহাসিক সম্পদ নিয়ে তা আমরা পারিনি।
পশ্চিমবঙ্গে পর্যটনের একটা বড় ঘাটতি হল, পর্যটকদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করতে হবে তা নিয়ে এই রাজ্যে হোটেলকর্মী, গাইড, গাড়ির চালকদের প্রশিক্ষণের উপযুক্ত ব্যবস্থা নেই। রাজ্যের ট্যুর অপারেটরদের সংগঠন ‘ট্র্যাভেল এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গল’-এর কার্যকরী সমিতির সদস্য প্রবীর সিংহরায় বলেন, ‘‘আন্দামান কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল, তাই সেখানে রাজনীতি কম। পশ্চিমবঙ্গে যে কোনও কাজেই রাজনীতি এসে যায়। তা ছাড়া, পর্যটনের মতো সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রটিকে এখানকার কোনও সরকারই গুরুত্ব দেয়নি।” পর্যটন বিশেষজ্ঞ রাজ বসুও বলেন, “কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল আন্দামানে যে কোনও ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কম। প্রশাসনও অনেক বেশি সচেষ্ট।” আন্দামানের পর্যটন বিভাগের অধিকর্তা বিশ্ব কান্নাম বলেন, “পর্যটন থেকে আমাদের আয়ের একটা বড় অংশ আসে। তাই এই শিল্পটির উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা করতে আমরা বাধ্য হই।”
২০০৪ সালের সুনামির বিপর্যয় আন্দামানের পর্যটন শিল্পকে তছনছ করে দিয়েছিল। প্রশাসন সব রকমের সহযোগিতা দিয়ে এক বছরের মধ্যে ঘুরে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করেছিল। পর্যটন বাঁচাতে পরিবেশ সচেতনতার কাজে যুক্ত করা হয়েছে ভ্রমণ ব্যবস্থাপক থেকে হোটেলকর্মী, বিভিন্ন বর্গের মানুষকে। সম্প্রতি বিশ্ব পর্যটন দিবস উপলক্ষে এক দিন বিভিন্ন দ্বীপের ‘সি বিচ’ পরিষ্কার রাখার প্রতীকী অভিযানেও নেমেছিলেন পযর্টন ব্যবসায়ীরা। এখন আর আন্দামান-নিকোবরের কোনও দোকানেই প্লাস্টিকের ব্যাগ বা পলিপ্যাক পাওয়া যায় না। প্রত্যেকটি ‘সিবিচ’ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। সৈকতে ধূমপানও নিষিব্ধ।
আমরা কেন পারি না? পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন মন্ত্রী ব্রাত্য বসুর জবাব: “আমি কোনও দিন আন্দামানে যাইনি। তাই আমার কাছে ফারাকটা পরিষ্কার নয়।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy