ঘেরাও হয়ে আছেন অধ্যক্ষ সনৎ বসু। প্রেসিডেন্সি কলেজ, ১৯৬৬
প্রেসিডেন্সি কলেজে কী হয়েছিল, কী হয়নি
১৯৬৬ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষ সনৎ বসুকে ঘেরাওমুক্ত করতে পুলিশি অভিযান ও তার ফলাফল সম্বন্ধে অসীম চট্টোপাধ্যায় (‘শিক্ষায়তনে গণতন্ত্র...’, ২২-১০) কিছু উক্তি করেছেন। ঘেরাওমুক্তির দু’দিনই পুলিশ বাহিনী আমার নেতৃত্বে কাজ করেছিল, কেননা আমি ওই এলাকার ডেপুটি কমিশনার ছিলাম। সেই সূত্রে কয়েকটি কথা।
অমল সান্যাল (প্রেসিডেন্সি) কলেজ ইউনিয়নের সম্পাদক ছিলেন না। প্রেসিডেন্সি কলেজের ইউনিয়ন ওই সময় পিসিএসও বা এসএফআইয়ের দখলে থাকত। প্রথমটি এ-জাতীয় কাজকর্মের অনেক ঊর্ধ্বে। আর পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আমায় বলেছিলেন, আমরা যখন অধ্যক্ষকে দ্বিতীয় বার ঘেরাওমুক্ত করি, তখন তিনি আর কয়েক জন এসএফআই ছাত্রনেতার সঙ্গে প্রেসিডেন্সির মেন গেটের উল্টো দিকের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আমাদের সব কাজ লক্ষ করেছিলেন। তিনি বার বার বলেছেন, ওই ঘেরাওয়ের সঙ্গে এসএফআইয়ের কোনও বারই কোনও যোগ ছিল না।
প্রেসিডেন্সি কলেজের মতো প্রতিষ্ঠানে পুলিশ পাঠাতে মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেনেরও প্রচণ্ড আপত্তি ছিল। তিনি ও আমরা অনেকেই ভেবেছিলাম, যারা ঘেরাও করেছে, অন্যান্য অধ্যাপক এবং ছাত্রেরা তাদের ঘেরাও তুলতে রাজি করাতে পারবেন। রাত্রি দশটা পর্যন্ত তা হল না। মুখ্যমন্ত্রী তখন পুলিশ কমিশনার পি কে সেনকে বললেন, আপনি পুলিশ পাঠান, কিন্তু একটি ছাত্রও যেন কোনও শারীরিক আঘাত না পায়, আর কোনও ছাত্রকে যদি সরাবার জন্য গাড়িতে তুলতে হয় তা হলে থানায় নিয়ে গিয়ে যেন তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। দু’বারই এই রকম আদেশ ছিল। আমার কলকাতার পুলিশের সহযোগীদের ধন্যবাদ, তাদের সহায়তায় আমি এই প্রায় অসম্ভব কাজ করতে পেরেছিলাম। দু’বারের এক বারও কোনও ছাত্রকে মারতে বা ধরতে হয়নি। ৩৯ জন ছাত্র গ্রেফতার হন ও সাত দিন পরে জামিন পান— এ কথাগুলি ঠিক নয়।
অমল সান্যালের কব্জি ভাঙার অভিযোগটিও ঠিক নয়। প্রথম বার যখন অধ্যক্ষকে ঘেরাওমুক্ত করি, তিনি গাড়িতে উঠে চলে যাওয়ার সময় তাঁর গাড়ির চার দিকে দাঁড়িয়ে এক দল ছেলে অতি কুৎসিত ভাষায় স্লোগান দিতে থাকে। এমনকী তাঁকে এক জন বিখ্যাত কংগ্রেস নেতার জারজ সন্তান বলে বার বার চিৎকার হতে থাকে। অধ্যক্ষ অবাক চোখে চেয়ে থাকেন, যেন তাঁর বিশ্বাসই হচ্ছিল না, তাঁর ছাত্ররা তাঁর বিরুদ্ধে এই রকম স্লোগান দিতে পারে। যে ছেলেটি এই গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছিল, অন্যরা তাকে ‘অমল’ বলে ডাকছিল। পরের দিন আমি যখন টেলিফোনে এডুকেশন সেক্রেটারি, আমার ভূতপূর্ব অধ্যাপক ভবতোষ দত্তকে ঘটনার বিবরণ দিই, তিনি বলেন, ‘কী আশ্চর্য, জানো নিরুপম, ছেলেটি কৃষ্ণনগরের বিখ্যাত সান্যাল বাড়ির ছেলে, মাধ্যমিকে দ্বিতীয় হয়েছিল...’
পুজোর ছুটির পরে অধ্যক্ষ সনৎ বসু যখন দ্বিতীয় বার ঘেরাও হন, ছেলেরা তখন তাঁকে হেয়ার স্কুলের মাঠে বসিয়ে রাখে। আমি খবর পেয়ে একা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাই। প্রথমে ছেলেরা আমাকে দেখা করতে দেয়নি। পরে দূর থেকে আমি ওঁর সঙ্গে কথা বলি। ছেলেদের আমি বলি ওঁকে ওঁর ঘরে যেতে দিতে। দু’চার বার কথা বলার পরেই অমল সান্যাল আঙুল উঁচিয়ে আমাকে বলে, ‘আপনি এখনই এখান থেকে বেরিয়ে যান।’
বিমান বসু দেখেছি চিরকালই অত্যন্ত সাহসী। আমি যখন মুখ্যমন্ত্রীর অনুমতি পাওয়ার পরে কিছু ফোর্স নিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজের মেন গেট দিয়ে ঢুকছি, তখন বিমানবাবু একলা এসে দু’হাত বিস্তার করে আমাদের সামনে দাঁড়ান। আমি কিছু বলবার আগেই কন্ট্রোল রুম থেকে আমি যে ফোর্স পেয়েছিলাম তাঁদের এক জন এসি জোরে ধাক্কা দিয়ে তাঁকে সরিয়ে দেন। তিনি মাটিতে পড়ে যান, কিন্তু লাঠির ঘায়ে তাঁর মালাইচাকি ভেঙে গিয়েছিল, এ কথা সত্যি নয়। আমরা দু’তিন জন তাড়াতাড়ি তাঁকে তুলে ধরি। ওসি জোড়াসাঁকো এবং আরও দু’তিন জন অফিসার তাঁকে কলেজের বাইরে নিয়ে যান। তার পর আমরা আমাদের কাজ করি, অর্থাৎ অধ্যক্ষকে ঘেরাওমুক্ত করি। পরে আমি যখন ডিআইজি আইবি বা পুলিশ কমিশনার বা আইজি এবং বিমান বসু শাসক দলের এক জন মাননীয় সদস্য, তাঁর সঙ্গে আমার বহু বার দেখা হয়েছে। তিনি কখনও মালাইচাকি ভাঙার কথা বলেননি।
প্রেসিডেন্সি কলেজের কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরিটি ছিল আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের অতি প্রিয় কর্মস্থল। বলতে গেলে তাঁরা সারা জীবনটিই তিনি এখানে কাটিয়েছিলেন। ল্যাবরেটরিটি একদম কলেজ স্ট্রিটের পাশে। অধ্যক্ষের দ্বিতীয় বার ঘেরাওমুক্তির পরের দিন যখন কলেজে, স্বাভাবিক ভাবেই, কোনও পুলিশ নেই, তখন ঘেরাওয়ে অংশগ্রহণকারী ছাত্রেরা ল্যাবরেটরিতে ঢুকে প্রচণ্ড ভাঙচুর চালাতে থাকে। আমরা খবর পেয়ে ওখানে ছুটে যাই ও দেখি, ল্যাবরেটরিটির প্রভূত ক্ষতি করা হয়েছে। রসায়নের বিভাগীয় প্রধান প্রতুলচন্দ্র রক্ষিত আমার কাছে অভিযোগ করেন, ‘আপনারা যদি কিছু পুলিশ পাহারা রেখে যেতেন তা হলে এই বিরাট ক্ষতি হত না।’ এর পরেই প্রেসিডেন্সির মেন বিল্ডিং ও বেকার ল্যাবরেটরিতে চব্বিশ ঘণ্টা পুলিশ পাহারার বন্দোবস্ত করা হয়।
প্রেসিডেন্সির গেটের সামনে কেউ মাসের পর মাস মাদুর পেতে বসে আছে, এ কথাটিও সত্য নয়। এ রকম বসে থাকলে লালবাজার থেকে তৎক্ষণাৎ তাদের সরাবার ব্যবস্থা হত। এলাকার ভারপ্রাপ্ত ডিসি হিসেবে প্রায় রোজই ওখান দিয়ে আমায় যাওয়া-আসা করতে হত। আমি এক দিনও এ রকম কোনও দৃশ্য দেখিনি।
নিরুপম সোম। কলকাতা-৩১
শাহি ইমাম মোটেও ঠিক কাজ করেননি
‘ইমামের অনুষ্ঠানে ব্রাত্য মোদী, আমন্ত্রিত শরিফ’— এই সংবাদে (৩১-১০) আমি এবং আমার মতো মুসলিম সম্প্রদায়ের আরও বহু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ ব্যথিত।
নতুন শাহি ইমাম শাহবান বুখারির অভিষেক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ না জানানো তাঁদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। কিন্তু পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানানোর তীব্র নিন্দা করছি। ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের খাতিরে নওয়াজ শরিফকে শাহি ইমাম আমন্ত্রণ করতেই পারেন, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হিসাবে করলে দেশের প্রধানমন্ত্রীকে বাদ দেওয়া একান্ত নিন্দনীয় বলে মনে করি।
ভারতবর্ষের সঙ্গে পাকিস্তানের এখনও বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। পাকিস্তানি জওয়ানদের হাতে সীমান্ত এলাকায় প্রতি দিন নিরীহ ভারতবাসীদের প্রাণ যাচ্ছে। ঠিক সেই সময় ভারতের মতো ধর্মনিরপেক্ষ দেশে বাস করে পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানানোর তীব্র বিরোধিতা করছি। আমার সীমিত জ্ঞানে ইমামের এই রকম কোনও অভিষেক অনুষ্ঠান ইসলাম ধর্মে অনুমোদিত আছে বলে জানা নেই। অথচ উক্ত অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ করায় সমগ্র ভারতবাসীর কাছে ভুল বার্তা যাবে।
এখানে আর একটি কথা বলা দরকার। শাহি ইমাম সমগ্র মুসলিম সমাজের একমাত্র প্রতিনিধি নন। ইসলাম ধর্মে একনায়কত্বের কোনও জায়গা নেই। ভারতে রাজনৈতিক কারণে একটি সম্প্রদায়ের উপরে অবিশ্বাস্য ঘৃণা দানা বাঁধতে শুরু করেছে। ইসলাম ধর্মে দেশপ্রেমকে ইমানের অঙ্গ বলা হয়েছে। অর্থাৎ দেশকে না ভালবাসলে পুরোপুরি ইমানদার অর্থাৎ ঈশ্বরে বিশ্বাসী হওয়া যায় না।
একরামুল বারি। আইনজীবী, কলকাতা হাইকোর্ট
সংযোজন
বোলান গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখায় (‘যে যখন...’, ৪-১০) অনবধানবশত একটি লাইন বাদ পড়ে গিয়েছে।
সেটি ছিল: ‘এপিডিআর-এর বীরভূম জেলা সেক্রেটারি শৈলেন মিশ্র আমার সঙ্গী ও পথপ্রদর্শক ছিলেন।’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy