নির্বাচনের তিন দিন আগে এক কথা বলিয়া জয়ী হইবার পরে কোনও নেতা তিন রাত্রি কাটিবার আগেই সম্পূর্ণ বিপরীত কথা বলিলে যদি কেহ বিস্মিত হন, তবে বুঝিতে হইবে, নির্বাচনী গণতন্ত্রের মহিমা তাঁহার অজানা থাকিয়া গিয়াছে। ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বিনিয়ামিন নেতানিয়াহু ভোট-প্রচারের শেষ পর্বে ঘোষণা করিয়াছিলেন, স্বতন্ত্র প্যালেস্তাইন রাষ্ট্র তিনি মানিয়া লইবেন না। স্বাধীন প্যালেস্তাইন প্রতিষ্ঠার যে প্রক্রিয়া দীর্ঘ দিন ধরিয়া চলিতেছে, তাহা এই ভাবে সরাসরি নাকচ করিয়া দেওয়ায় নেতানিয়াহু কেবল স্বদেশে নয়, দুনিয়া জুড়িয়া প্রবল সমালোচনার সম্মুখীন হইয়াছিলেন। অতঃপর নির্বাচন, এবং সমস্ত জনমত সমীক্ষাকে ভুল প্রমাণিত করিয়া তাঁহার লিকুদ পার্টি প্রধান প্রতিপক্ষ জায়নিস্ট ইউনিয়নের তুলনায় ছয়টি আসন বেশি পাইয়া সরকার গড়িবার দৌড়ে অগ্রবর্তী, প্রধানমন্ত্রীর আসনে নেতানিয়াহুই ফিরিয়া আসিতেছেন। এবং প্রায় তৎক্ষণাৎ তাঁহার মন্তব্য: ইজরায়েল ও প্যালেস্তাইনকে লইয়া ‘দুই-রাষ্ট্র’ সমাধানে তাঁহার সমর্থন আছে, তবে এখনই তাহার রূপায়ণ সম্ভব নহে। ‘ইতি গজ’টুকু অর্থহীন, এখনই স্বাধীন প্যালেস্তাইনের পতাকা উড়াইবার দিবাস্বপ্ন প্যালেস্তিনীয় নেতা মাহমুদ আব্বাসও দেখেন না। ঘটনা ইহাই যে, নেতানিয়াহু রাতারাতি ডিগবাজি খাইলেন।
এবং বুঝাইয়া দিলেন, একটি বহুধাবিভক্ত গণতান্ত্রিক পরিসরে নির্বাচন নামক যুদ্ধটি কী ভাবে লড়িতে হয়, তাহা তিনি উত্তম রূপে শিখিয়া লইয়াছেন। পশ্চিম এশিয়ার একমাত্র যথার্থ গণতন্ত্র ইজরায়েলে রাজনীতির পরিসর বহুবিভক্ত। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিলাসিতা রাজনীতিকদের নাগালের বাহিরে, জোট বিনা গতি নাই। লিকুদ পার্টির নেতা নেতানিয়াহুর নির্বাচনী সাফল্যও জোটের মাপেই ছাঁটা। ১২০ সদস্যের জাতীয় সংসদ ‘ক্নেসেৎ’-এ তাঁহার নিজের জুটিয়াছে মাত্র ৩০টি আসন, বাকিটা বিবিধ সহমর্মী এবং প্রয়োজনে ভিন্নগোত্রের দলকে শরিক করিয়া পূরণ করিতে হইবে। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও তাঁহার সাফল্য লইয়া কোনও প্রশ্ন নাই। কারণ, ইজরায়েলে দুই দফায় ছ’বছরের একটানা শাসনের পরে তৃতীয় বার ফিরিয়া আসিবার নজির বিরল, এবং প্রধানত অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধ মত প্রবল ছিল, শেষ মুহূর্ত অবধি তাহার নানা সংকেত মিলিতেছিল, তিনি নিজেও পরাজয়ের আশঙ্কা প্রকাশ করিয়াছিলেন। তাঁহার প্রত্যাবর্তন চমকপ্রদ।
এই চমকপ্রদ প্রত্যাবর্তনের পিছনে যে কৌশলটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তাহার নাম মেরুকরণ। নেতানিয়াহু জানিতেন, প্যালেস্তাইন প্রশ্নে তাঁহাকে কট্টরপন্থী অবস্থান লইতে হইবে, যাহাতে অন্য কট্টরপন্থী দলগুলির ভোট ভাঙিয়া তাঁহার ঝুলিতে আসে। ঠিক একই কারণে ইরানের সহিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিম দুনিয়ার বোঝাপড়ার উদ্যোগেরও তীব্র বিরোধিতা করিয়াছেন তিনি এবং সেই বিরোধিতা জানাইতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আপত্তি সত্ত্বেও মার্কিন কংগ্রেসে ‘আমন্ত্রিত’ হইয়া আটলান্টিক পার হইয়া ইরানের সহিত প্রস্তাবিত চুক্তিটিকে ‘খারাপ চুক্তি’ বলিয়া গাল পাড়িয়া আসিয়াছেন। এই অভূতপূর্ব দুর্বিনয়ে কেবল ওবামা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন নাই, ইজরায়েলের প্রতি মার্কিন রাজনীতির দ্বিপাক্ষিক সমর্থনের চিরাচরিত ঐতিহ্যে অন্তত সাময়িক ফাটল ধরিয়াছে, অর্থাৎ নেতানিয়াহু মার্কিন রাজনীতিতেও মেরুকরণ ঘটাইয়া দিয়াছেন! স্বভাবতই নিন্দার ঝড় উঠিয়াছে। কিন্তু জয়পরাজয়ের খেলায় নিন্দা-প্রশংসা অপ্রাসঙ্গিক। তিনি দ্যূতক্রীড়া-উত্তর দুর্যোধনের প্রতিধ্বনি করিতে পারেন: জয় চেয়েছিনু, জয়ী আমি আজ। এখন তাঁহার সম্মুখে অন্য লড়াই। এক দিকে জোট সরকার গড়িবার লড়াই, অন্য দিকে সমস্যাসঙ্কুল শাসনের কাজ চালাইবার লড়াই। সুতরাং ‘প্যালেস্তাইন নৈব নৈব চ’ হইতে অতি দ্রুত ‘প্যালেস্তাইন এখনই নহে’। দ্বিচারিতা? অবশ্যই। অনৈতিক? নিশ্চয়ই। কিন্তু যতক্ষণ ভোটদাতারা তাহা মানিয়া লইতেছেন, ততক্ষণ ভোটপ্রার্থীদের কী আসে যায়?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy