Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

কোনও ‘কিন্তু’ নেই

প্রশ্নটা ধর্মের প্রশ্ন নয়, স্বাধীনতার প্রশ্ন, সহনের প্রশ্ন। যারা এই সহনে বিশ্বাস করে না, তারা সংকীর্ণ অমুক্তির ক্লিন্ন জীব।কতগুলো মুহূর্ত আসে, যখন ‘কিন্তু’, ‘তবু’, ‘আসলে’, ‘হয়তো’ এই সব শব্দ একেবারে অর্থহীন। ব্যাখ্যা, যুক্তি, তর্ক, সবটাই নিছক অজুহাত। একটা প্রাথমিক এবং অলঙ্ঘনীয় মূল্যবোধে ভর করা ছাড়া কিছুই করার থাকে না তখন। ফরাসি কার্টুন পত্রিকা শার্লি এবদো-র অফিসে মৃত্যুহানা এমনই একটা মুহূর্ত। এক কথায় ও এক মনে একে ঘৃণা করা ছাড়া কিচ্ছু করার নেই। নয়তো পড়ে থাকে একটাই সম্ভাবনা। ওই ঘৃণ্যতার পাশে দাঁড়ানোর অজুহাতের সম্ভাবনা।

সেমন্তী ঘোষ
শেষ আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০১৫ ০১:১২
Share: Save:

কতগুলো মুহূর্ত আসে, যখন ‘কিন্তু’, ‘তবু’, ‘আসলে’, ‘হয়তো’ এই সব শব্দ একেবারে অর্থহীন। ব্যাখ্যা, যুক্তি, তর্ক, সবটাই নিছক অজুহাত। একটা প্রাথমিক এবং অলঙ্ঘনীয় মূল্যবোধে ভর করা ছাড়া কিছুই করার থাকে না তখন। ফরাসি কার্টুন পত্রিকা শার্লি এবদো-র অফিসে মৃত্যুহানা এমনই একটা মুহূর্ত। এক কথায় ও এক মনে একে ঘৃণা করা ছাড়া কিচ্ছু করার নেই। নয়তো পড়ে থাকে একটাই সম্ভাবনা। ওই ঘৃণ্যতার পাশে দাঁড়ানোর অজুহাতের সম্ভাবনা।

কথাটা শুনতে সোজা। তবু বোধহয় অত সোজা নয়। যে হানাদাররা বিনামেঘে নেমে এসে এলোপাথাড়ি গুলিতে লাশের পাহাড় গড়ে, যে করেই হোক তাদের ঠেকাতে হবে, দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নিন্দা করতে হবে, এর যে কোনও ব্যত্যয় হতে পারে না, আপাত-পরিচিত অনেকের কথা শুনেই সেটা টের পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ এটাই কিন্তু মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার প্রাথমিক মূল্যবোধ বলে গণ্য হওয়ার কথা ছিল! মতভেদ যতই তীব্র হোক না কেন, প্রাণঘাতের মূল্যে মীমাংসা হতে পারে না: এই মূল্যবোধ একেবার স্পষ্ট ও ঋজু হওয়ার কথা ছিল। এই মূল্যবোধে কোনও ‘কোয়ালিফায়ার’ বা শর্তসাপেক্ষতা থাকে না, আইডেন্টিটি বা ধর্ম থাকে না, প্রাচ্য পাশ্চাত্য সীমারেখা থাকে না। সুতরাং... অর্থাৎ... বুঝতে হবে... ভাবতে হবে..., এ সব শর্ত নিয়ে আগেও আলোচনা হয়েছে, পরেও আলোচনার সময়-সুযোগ আসবে। কিন্তু অন্যায়কে অন্যায় বলার আগেই যাঁরা সেই শর্তে পা দিচ্ছেন, তাঁরা বাহানার আবডাল বানাচ্ছেন, প্রাথমিক মূল্যবোধটি লঙ্ঘন করছেন।

ঠিক একই সঙ্গে, এই অন্যায়কে অদ্ব্যর্থ ও অব্যর্থ ভাষায় নিন্দা করতে গিয়ে অন্যায়কারীদের বিশেষ একটা আইডেন্টিটি মনে করে তাদের সঙ্গে সেই আইডেন্টিটি-র আরও অন্যান্য মানুষের তুলনা বা সংযোগেরও প্রশ্ন উঠতে পারে না। শুধু অর্থহীন নয়, সেটা ভয়ানক অন্যায়। অন্যায়কারীরা অন্যায় করার সময় যে যুক্তি ব্যবহার করছে, তার মধ্যে ইসলামের যোগ আছে বলেই অন্যায়কারীর ‘ব্র্যাকেটে’ নানা দেশের নানা ভাষার নানা মতের মুসলিমকে ঢুকিয়ে দেওয়া যায় না। এটাও প্রাথমিক মূল্যবোধেরই প্রশ্ন। নৃশংসতা সহ্য না করার মতোই গুরুতর, নৃশংসতার কারবারিদের থেকে অন্যদের আলাদা করার কাজটা। অথচ শার্লি এবদোর ঘটনার পর এই মূল্যবোধও লঙ্ঘিত হচ্ছে।

শার্লি এবদো যে তীব্র ব্যঙ্গের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল, তার পক্ষে বা বিপক্ষে বহু যুক্তি তৈরি করা যায়। আমি বা আমার মতো অনেকেই শার্লি-র মতে বিশ্বাসী নই, শার্লি হতে চাই না, কেননা, ওই ধরনের তীব্র ব্যঙ্গের আঘাত তৈরি করাটা সুচিন্তা বলে মনে হয় না। আমরা অনেকেই মনে করি যে, যদিও শার্লির ব্যঙ্গের আরও অন্য টার্গেট ছিল, তবু নিয়মিত মহম্মদ বা ইসলাম ধর্ম ইত্যাদি নিয়ে তীক্ষ্ণ কার্টুন তৈরি করার মধ্যে একটা বিপদ ছিল, আছে, থাকবে। ‘বিপদ’ বলতে বোঝাতে চাই: আঘাত দিয়ে, রাগিয়ে দিয়ে, অনেক মানুষকে সরিয়ে দেওয়ার, ক্ষুব্ধ করার কথা। আর কিছু নয়।

অর্থাৎ শার্লি-র ব্যঙ্গে অনেক মানুষ নিশ্চয়ই ক্ষুব্ধ হতে পারেন, কিন্তু ক্ষুব্ধ হয়ে বন্দুক হাতে খুন করতে যেতে পারেন না। আমরা, যারা শার্লি নই, হতে চাই না, তাদেরও মেনে নেওয়ার কথা যে, ব্যঙ্গ করাটাও বাক্স্বাধীনতার একটা প্রকাশ, ব্যঙ্গের অধিকার প্রয়োজনীয় অধিকার। স্বাধীনতা, মুক্তি, গণতন্ত্রের জন্য এই অধিকার অবশ্যগ্রাহ্য। ব্যঙ্গের মার খুবই তীক্ষ্ণ, কখনও অত্যন্ত যন্ত্রণাবোধক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত, ব্যঙ্গ মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই, কেননা— কথা বা ছবি যেহেতু শারীরিক আঘাত করে না, প্রাণের প্রাথমিক শর্তটিকে লঙ্ঘন করে না, তাই তাকে সহ্য করা সম্ভব, সহ্য করা দরকার। সহ্য করা মানে নিশ্চয়ই মেনে নেওয়া নয়। যাঁর বা যাঁদের বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ, তাঁরা ক্ষুব্ধ বোধ করলে প্রতিবাদ করুন। কিন্তু প্রতিবাদের পথটাও কথায় হোক, ছবিতে হোক। আরও তীব্র, আরও বিপরীত যন্ত্রণাদায়ী কার্টুন আঁকুন। বজ্রাদপি কঠিন কথা লিখুন, বলুন। রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করুন, সংগঠনের রাজনীতি করুন। সে সব একান্তই না পারলে, তুড়ি মেরে ব্যাপারটা উড়িয়ে দেওয়াও সম্ভব। সম্ভব, কেননা, ব্যঙ্গ যারা করছে, তারা ব্যঙ্গটুকুই করতে পারে, বেঁচে থাকাটা আটকাতে পারে না। বেঁচে থাকার মধ্যে যে যন্ত্রণা, তা দিয়ে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার নীতি মেনেই প্রতিবাদ তৈরি করার কথা। এটাই বেঁচে থাকার দাম।

এই মূল্যবোধ যে একেবারেই দুর্লভ, বলা যায় না। আমি বা আমরা শার্লি হই না হই, অধিকাংশই সচরাচর জেনে থাকি যে, অন্য অনেকেই শার্লি হতেই পারেন। লন্ডনে সে দিন বহু মানুষ, প্রধানত সংবাদমাধ্যমের মানুষ, ফরাসি সাংবাদিকদের প্রতি সমমর্মিতার লক্ষ্যে রাতারাতি আয়োজনে একটি সভা করেছেন, নাম দিয়েছেন ‘উই আর শার্লি’। আবার সে দেশেই অনেকে, আমাদের মতো, তাঁদের মতের সঙ্গে একমত হননি, প্রতিবাদ করেছেন, কিন্তু ‘উই আর শার্লি’ বলার অধিকারটা মানতে অসুবিধে বোধ করেননি। ফরাসি বিপ্লবের দার্শনিক ভলতেয়ার নাকি বলেছিলেন: ‘তোমার মতটা আমি মানি না, কিন্তু তবু তোমার এই মত পোষণ করার অধিকার আমার জীবন দিয়ে রক্ষা করব।’ সম্ভবত ভলতেয়ার নিজে নন, তাঁর জীবনীকার এ কথা বলেছিলেন। সে যাই হোক, দর্শনটা কিন্তু আমাদের ছাড়েনি। গণতন্ত্র বা স্বাধীনতা বলতে আমরা অনেকেই এই মতে বিশ্বাস রাখি।

শার্লি-র ব্যঙ্গের অনেক ‘টার্গেট’ও এই বিশ্বাসে ভর দিয়ে চলেন। পোপ কনডোম হাতে ‘পোজ’ দিচ্ছেন, যিশু ক্রুশ ছেড়ে আর্তনাদ করে পালাচ্ছেন, কিংবা প্রফেট মহম্মদ ‘হাসলেই ১০০ চাবুক’ বলে শাসাচ্ছেন, এ সব দেখে অনেকেরই নিশ্চয় প্রভূত কষ্ট হয়েছে, কিন্তু তাঁরা সেটা অগ্রাহ্য করা উচিত বলে মনে করে অগ্রাহ্য করেছেন। আজ হঠাৎ কয়েক জন খুনি সন্ত্রাসীর অসহন দেখে তাঁরাও অসহনে ভেসে যাননি।

ভিন্নতার অধিকারেই স্বাধীনতা। তাই একই সমাজে শার্লি থাকলেও ফ্রান্স-জোড়া মুসলিমদের নিজস্ব মত ও পথ খোলা রাখতে ও রাখাতে এত দিন কোনও বাধা হয়নি। আমাদের দেশেও দেখেছি, বাংলায় তসলিমা নাসরিনের তীব্র ব্যঙ্গোক্তি পড়ে অনেকে তাঁকে দেশছাড়া করতে চাইলেও অনেক মুসলিমই আবার তাঁকে নিয়ে মাথা ঘামাননি। কিংবা, মকবুল ফিদা হুসেনের আঁকা হিন্দু দেবদেবীর তির্যক-চিত্র দেখে বিরক্ত হিন্দুর সংখ্যা কম নয়, কিন্তু তাঁদের প্রত্যেকেই হুসেনকে প্রাণে মারার কথা চিন্তা করেননি। আসলে সব সময়েই দেখা যায়, চূড়ান্ত অসহনশীলতা দেখান অল্প কিছু মানুষ, অন্যরা এ নিয়ে বিচলিত হন না, বা হওয়ার দরকার বোধ করেন না। কেননা, তাঁরা জানেন, ওটা অনেক মতের মধ্যে একটা মত মাত্র, ও নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলবে।

শার্লি এবদোর প্রশ্নটা তাই ইসলামের প্রশ্ন নয়, ধর্মের প্রশ্ন নয়, সোজাসুজি মুক্তি ও স্বাধীনতার প্রশ্ন, সহনের প্রশ্ন। যারা এই সহনে বিশ্বাস করে না, প্রাথমিক মূল্যবোধ লঙ্ঘন করে, তারা সংকীর্ণ অমুক্তির ক্লিন্ন জীব। আর যাঁরা তাদের প্রশ্রয় দেন, তাদের নিন্দা করারও আগে তাদের বিশ্লেষণ করতে বসেন, তাদের মধ্যেও উঁকি দিতে থাকে সেই সংকীর্ণ অমুক্তির করাল ছায়া।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

anandabazar editorial semanti ghosh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE