উরিয়েঃ, কী দিলাম! আগের রাত থেকে রিহার্সাল করা ছিল অবশ্য। ‘মম কো মং মিল গয়া!’ ‘মম কো মং মিল গয়া!’ আরেট্টু হলে বলে ফেলছিলুম , মংমঙামং লগ গিয়া রে! বললেই হত, ঠেকাচ্ছে কে! আমি বলে কথা! যেমন বক্তৃতায় নয়া নয়া পাঞ্চলাইন, তেমনি ভোটে ঢিশুঁয়া নক-আউট পাঞ্চ! যা বলব, হেদিয়ে হাততালি সাপ্লাইয়ের লোক মজুত! আরে, ইম্পর্ট্যান্ট সভায় অন্য লোকে কথা বলতে উঠলেই কোরাসে প্যাঁক দিয়ে বসিয়ে দেয়। মন্ত্রী-ফন্ত্রী কিস্যু রেয়াত নেই। বাওয়া, ভারতের শ্রেষ্ঠ বক্তা, নতুন জমানার প্রবক্তা। এমন ‘পান’ কেউ পারবে? কপি-রাইটার হলেও ফাটিয়ে দিতাম। চায়ের স্টল দিলে তো কথাই নেই!
আরও মজা, এই মহাকাশ-মস্তানির পুরোটাই অন্যের প্ল্যান, অন্যের ভাবনা। আমি জাস্ট ঠিক সময়ে লাফিয়ে পড়ে ক্ষীরটা চেট্টেপুট্টে! ইতিহাসের লগনচাঁদা ছানা হলে এমনই বিনিপয়সায় জ্যাকপট! মনমোহন বহুত মিটিং-ফিটিং বাগিয়ে প্রাণান্ত দাড়ি চুলকে যা ভাঁজল, আমি জাস্ট চটকদার বক্তিমে প্রিপেয়ার করে তা সাবড়ে দিলাম। এ রকমটা অবশ্য বহুদ্দিন হয়ে আসছে। ঠাকুমার ঝুলি পড়িসনি? একটা রাজকন্যা ঘেমেনেয়ে রাজপুত্তুরের গা থেকে লাখ লাখ ছুঁচ তুলল, তার পর চোখের দুটো বাকি রেখে চান করে আসতে গেছে, কোত্থেকে কে ছুট্টে এসে জাস্ট ওই দুটো টুকুস টুকুস তুলে, রানি হয়ে বসে গেল। বিধান রায় মেট্রোর সব পরিকল্পনা এঁকেছকে গেলেন, বামফ্রন্ট স্লাইডিং ডোরের গ্ল্যামার পুইয়ে একসা। আবার লালবুদ্ধ কলকাতা এয়ারপোর্টটাকে দেখে ছেঃ ছেঃ বলে আফশোস-মাথা নেড়ে ঝিংচ্যাক বানাবার ফরমায়েশ হিসেবনিকেশ শেষে সবে জিরোচ্ছেন, মমতা ধাঁ করে আবির্ভূত এবং সিলিঙে রবীন্দ্রনাথের ইকড়িমিকড়ি লাগিয়ে এমন ঢং, যেন কবে থেকে বালিশের পাশে ব্লুপ্রিন্ট নিয়ে ভোঁসভোঁস!
একটাই প্রবলেম হচ্ছিল, যখন বুঝলাম ব্যাপারটা বেহদ্দ ডাউনমার্কেট। কিন্তু মাথায় আমার এমন গ্রে ম্যাটার চনচন, সেটাকে তুরন্ত টুইস্ট মেরে স্লোগানালাম, কম খরচে নাসার বাবা! এ দেশে লোকে খরচা কমাবার জন্যে সেকেন্ডহ্যান্ড জাঙিয়া কিনতে ভি রাজি, তক্ষুনি নেত্য করতে লাগল! সত্যি, কম পয়সায় বিয়ে করতে লোকে সাড়ে তিন পাক ঘুরে থেমে যাচ্ছে, তা বলে লো-বাজেট মহাকাশচর্চা! কার্ল সাগানেরও লিখতে পেন কেঁপে যাবে! আমি অ্যায়সা হাঁকড়ে চালালাম, কাগজগুলো হেডলাইন দিয়ে হাল্লাক: হলিউড ফিলিম ‘গ্র্যাভিটি’র চেয়ে কম খরচায় নভো-কিস্তিমাত! কেরানি-ফ্যামিলিও ভাবছে, তার মানে আজ বাদে কাল ক্যালরব্যালর লাগিয়ে মান্থলি কেটে থুতু ফেলতে ফেলতে ডেলি কা ডেলি মঙ্গল। জন-গগন-যোজনা!
কিন্তু আসলি বাত, সস্তায় পুষ্টিকর বলে বিজ্ঞানে কিস্যু হয় না। নাসার চেয়ে এত কম খরচে ব্যাপার কমপ্লিট, কারণ নাসার যানগুলো যে ক্ষমতা নিয়ে যায়, এ তার অর্ধেক নিয়েও যায়নি। ওরা হয়তো নিয়ে গেল সবসুদ্ধু ১১৫ কেজি, এ নিয়ে গেছে ১৫ কেজি। এই যানটা কিস্যুটি করবে না, মঙ্গল ঘিরে বোরিং পাক মারবে, খুব গ্রাম্ভারি ঢঙে দেড় বচ্ছর পর থুতনিতে ভর রেখে হয়তো কনক্লুডাবে, গ্রহটি দেখে কেমন যেন মনে হতিছে লালবর্ণ! আর আমরা অমনি আঙুল খুলে ‘ভি’-পেখম, কম পয়সায় ঠিক নলেজ, ভাবা যায়! কিউরিয়সিটি মঙ্গলের মাটি দাবড়ে ঘুরবে-ফিরবে, খুঁড়বে-শুঁকবে, সে বিরাট কিছু পাবে না, আর আমাদের ভারতীয় বস্তুখান বহুত দূর থেকে আবছা টুউউকি মেরে আচম্বিতে আখাম্বা ইউরেকা দাবড়াবে, এটা বিশ্বাস করতে একটু বেশি আশাবাদ আর অনেকটা নির্বুদ্ধিতার ককটেল দরকার। নেশাবাদ, বলা যায়। দেশপ্রেমের নেশা, অলীক কাণ্ড পেত্যয় যেতে ভালবাসার নেশা।
আর এ দেশটাই তো ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু’ সাইনবোর্ড গলায় লটকে খঞ্জনি বাজাচ্ছে! এখানে কম্পিউটার এসেছে, তক্ষুনি লগে লগে হাত ধরে কম্পিউটারাইজ্ড কোষ্ঠীবিচারও। ল্যাপটপ নিয়ে জ্যোতিষীরা টিভি চ্যানেলে বসে বলে দিচ্ছেন কুপিত রাহু তোমার বউয়ের ফিগার নষ্ট করিল, গোমেদ পরলেই ক্যাটরিনা। লোকে চেটেপুটে ঢেকুর তুলছে। তা হলে সেই সতত মিরাক্ল-প্রত্যাশী, দিবাস্বপ্নপ্রবণ, আবেগ-আঁকড়া, কমব্রেনুয়া জনগোষ্ঠীর কাছে ‘হাতখরচে কেল্লা ফতে, চলছে ভারত স্বর্ণরথে’-র ফ্যান্টাসি-পুরিয়া বেচে ঠিক করিনি? আরে বাবা, যার ক্যানসার সারাতে পারব না, তাকে একটা মাদুলি তো গছাব! তার মধ্যে যদি ভরে দিই পেট্রিয়টিক পাউডার! এই মহান দেশে যে লোকটা খেতে পায় না, সে পাকিস্তানের সঙ্গে ওয়ান-ডে’র দিন ভিক্ষে অফ নেয়। সে ফ্ল্যাগাঞ্চলে যুক্তি খাপ খুলবে কি, সিঁটিয়ে থরথর। সতেরোটা বাচ্চাকে টেলিস্কোপের সামনে তেরঙা ব্যাজ পরিয়ে খোনা সুরে অ্যান্থেম গাইয়ে দেব, ব্যস, সিনিকেরও চোখ ডবডব করবে। অন্তত, নখ খুঁচিয়ে ডবডব করাতে হবে। কে আমায় দাপিয়ে ধমকাবে, ‘চান্স নিয়ে দেখিই না ইয়ার’ প্লাস ‘এমন কেন সত্যি হয় না আহা’-র ওপর ভিত্তি করে জনগণের সাড়ে চারশো কোটি টাকা আরবিট অরবিটে উড়িয়ে দেওয়ার অধিকার কারও নেই?
কে সেই বস্তাপচা কম্নিস আপত্তি শানাবে, এই টাকায় লাখ লাখ লোক খেয়ে বাঁচত, গ্রামে গ্রামে পোঁতা যেত নিপুণ টিউকল, গড়ে দেওয়া যেত রাস্তা, ইশকুল? কে টুসকি মারবে: পাঙ্গা নিলেই যদি, ওরা যে মানের জিনিস পাঠায়, এগজ্যাক্ট তেমনটাই ছুড়ে দিতে হত ওদের নাসার ডগায়, তবে হতে রিয়েল ডন? কে ঘোষণা করবে, এতে আমও গেল ছালাও গেল? টাকাও নষ্ট, ভাল কাজেও লাগল না? কেউ না। ভারতবাজির ছাপ্পা পড়ে গেছে, মিডিয়া হাউহাউ করে আমার জয়গান গাইছে। এরোপ্লেনেও কাজ করি, ষোলো ঘণ্টা না খেটে শুতে যাই না। পুরো জিনিসটা অ্যাড-এর মসৃণ স্লিকতায় চলছে। টিং কো টং মিল গয়া। টিংটিংটিটং!
লেখাটির সঙ্গে বাস্তব চরিত্র বা ঘটনার মিল থাকলে তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত, কাকতালীয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy