ভাত ফুটিয়াছে কি না, তাহা বুঝিতে হাঁড়ির সব কয়টি চাল টিপিয়া দেখিতে হয় না। অভিজ্ঞজনেরা দুই একটি চাল টিপিয়াই বলিয়া দিতে পারেন। রতন টাটার অভিজ্ঞতা লইয়া নিশ্চয়ই অমিত মিত্র মহাশয়ের— বাক্যে না হউক— অন্তরেও সংশয় নাই। তিনি রাজারহাটের রাস্তা দেখিয়া বলিয়াছেন, উহা যেন একটি উদীয়মান গ্রামাঞ্চল। তাহাতে নূতন ঘরবাড়ি প্রচুর হইয়াছে, কিন্তু শিল্পের দেখা নাই। রতন টাটা কথাটি রাজারহাট নামক চাল টিপিয়া বলিয়াছেন বটে, কিন্তু তাহা সমগ্র হাঁড়িটির জন্যই সত্য। শিল্পের কী হইয়াছে, তাহা বহুচর্চিত। কিন্তু, যাহাকে শহর, এমনকী মহানগর, বলিতেই বাঙালি অভ্যস্ত, সেই কলিকাতা যে প্রকৃত প্রস্তাবে একটি প্রকাণ্ড গ্রাম বই কিছু নহে, তাহা অস্বীকার করিবার কোনও উপায় নাই। কোনও সভ্য শহরের পথেঘাটে এমন কাদা থাকে না। শহর জুড়িয়া এত গবাদি এবং শূকরাদি প্রাণী থাকে বলিয়াও প্রত্যয় হয় না। কোনও শহরের পরিবহণ এমন অব্যবস্থিত নহে। কোনও শহরে সন্ধ্যা নামিলেই রাস্তাঘাট বাসহীন হইয়া পড়ে না। কলিকাতার সমস্তই গ্রামীণ। রতন টাটা, সম্ভবত ভদ্রতাবশে, তাহাকে ‘উদীয়মান’ বলিয়াছেন।
গ্রামীণতার একটি নিজস্ব চলন আছে। নাগরিক জীবন হইতে তাহার অবস্থান বহু যোজন দূরে, কিন্তু তাহাতে দূষণীয় কিছু নাই। যাহা মন্দ, তাহার নাম গ্রাম্যতা। তাহা চরিত্রে ক্ষুদ্র, ভাবনায় সংকীর্ণ, এবং ব্যবহারে কুঁদুলে। কলিকাতা নামক গ্রামটির দুর্ভাগ্য: গ্রামীণতা নয়, গ্রাম্যতাই তাহার সারাৎসার। বর্তমানে যিনি বঙ্গেশ্বরী, বিরোধী অবতারে তিনি যখন সিঙ্গুরে শবসাধনা করিতেছিলেন, তখন তিনি রতন টাটাকে তাচ্ছিল্যের স্বরে ‘টাটাবাবু’ সম্বোধন করিয়াছিলেন। বর্তমান অর্থমন্ত্রী তাঁহার নেত্রীর অসৌজন্যকে দশ গোল দিয়াছেন। বলিয়াছেন, ‘রতন টাটার মতিভ্রম হইয়াছে’। ফিরহাদ হাকিমদের মুখে হয়তো এই কথাগুলি বেমানান ঠেকে না— তাঁহারা আজীবন কলিকাতার গ্রাম্যতাতেই লালিত। কিন্তু একদা বণিকসভার কর্ণধার, শিল্পমহলের ঘনিষ্ঠ অমিত মিত্রও যখন এই অশোভন তুচ্ছতায় নামিয়া আসেন, তখন বোঝা যায়, কলিকাতার গ্রাম্যতা সর্বগ্রাসী। পশ্চিমবঙ্গে শিল্প হইবে কি না, সে প্রশ্ন ভবিষ্যতের। কিন্তু, এই রাজ্যের রাজনীতিতে যে শিষ্টতার, পরিশীলনের কোনও স্থান নাই, গ্রাম্য কোন্দলেই যে তাহার রুচি, এই কথাটি অমিত মিত্র বুঝাইয়া দিলেন। পশ্চিমবঙ্গ নামক অকিঞ্চিৎকর রাজ্যের অর্থমন্ত্রী বা পুরমন্ত্রীর কথায় রতন টাটার ইতরবিশেষ হইবে না। কিন্তু, পশ্চিমবঙ্গের ললাটে তাঁহারা যে লজ্জার তিলক আঁকিয়া দিলেন, তাহা মুছাইবে কে?
অনুমান করা চলে, রতন টাটা উপলক্ষমাত্র। অমিত মিত্রের পরুষভাষণের প্রকৃত লক্ষ্য ছিল কালীঘাট। নেত্রীর অটুট নৈঃশব্দ্য দেখিয়া অনুমান করা চলে, শ্রীমিত্রের অঞ্জলি ব্যর্থ হয় নাই— দেবী প্রসন্ন হইয়াছেন। বস্তুত, অমিতবাবু তাঁহার অন্তর্দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বীদের বেশ কয়েক গজ পিছনে ফেলিয়া দিয়াছেন বলিয়াই বোধ হয়। প্রশ্ন হইল, এই অসৌজন্য কি গত তিন বৎসরে তাঁহার মজ্জাগত হইয়াছে? না কি, ইহা কেবলই বহিরঙ্গের রূপ— অন্তরে তিনি পুরাতন শীলিত অমিত মিত্রই আছেন? দুইটি সম্ভাবনাই আশঙ্কাজনক। সত্যই যদি পশ্চিমবঙ্গের জলহাওয়ায় মাত্র তিন বৎসরে এক জন মানুষ এতখানি বদলাইয়া যান, তবে বিপদ। আর, যদি ইহা শুধুমাত্র নেত্রীকে খুশি করিবার প্রকরণ হয়, তবে আরও বিপদ। এই গ্রাম্যতার যে অতলে নেত্রীর পারিষদরা নামিতে পারেন, তাহা সত্যই অকল্পনীয়। অমিত মিত্র যাহা করিয়াছেন, তাহাও কি কল্পনা করা যাইত? বঙ্গেশ্বরী যদি তাঁহার ভক্তদের বলিতেন, তাঁহার মন্দিরে পশ্চিমবঙ্গের এই নিত্য বলি তাঁহার আর সহ্য হইতেছে না, তবে হয়তো এই রক্তপাত থামিত। কিন্তু, সে আশাও দূর অস্ত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy