নাগরিক সমাজ। গাজায় আক্রমণের প্রতিবাদে। তেল আভিভ। ২৬ জুলাই, ২০১৪। ছবি: এপি
বন্ধুর সমালোচনা করলেই কি সেটা শত্রুতা হয়ে যায়? সুষমা স্বরাজকে এই হিতোপদেশ-মার্কা প্রশ্নটা করে অবশ্য খুব লাভ নেই, আলোর মতো স্পষ্ট যে বিদেশমন্ত্রী বন্ধুর সমালোচনায় বিশ্বাস করেন না। সমালোচনা যদি করতেই হয়, তবে তাকে বন্ধুর দল থেকে সোজা বার করে দিয়ে শত্রু-তালিকায় ঢুকিয়ে দেওয়াতেই বিশ্বাস রাখেন। তাই গাজা-প্রশ্নে ইজরায়েলের দায়দায়িত্ব বিষয়ে পার্লামেন্টে হইচই শুরু হলে সুষমা সপাটে থামিয়ে দেন, কেননা, ‘বন্ধু-দেশ’ বিষয়ে কোনও ‘অমর্যাদাকর’ উল্লেখ চলে না, চলবে না।
অথচ ঠিক দু’দিন পরেই রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার কমিশনের মঞ্চে ইজরায়েলের অন্যায্য সামরিক আক্রমণ বিষয়ে তদন্তের প্রস্তাবে অন্যান্য ‘ব্রিকস্’ দেশের (ব্রাজিল, রাশিয়া, চিন, দক্ষিণ আফ্রিকা) সঙ্গে ভারতও ‘হ্যাঁ’ ভোটই দিল। কিন্তু দেশের মাটিতে, দেশের আইনসভায় উল্টো ছবি। দেখা গেল, গাজায় নিহতের সংখ্যা যতই তিন-অঙ্ক ছাড়িয়ে চার-অঙ্কে পৌঁছক, নিহত শিশুর সংখ্যা একশো ছাড়িয়ে দুশোর কোঠায় ছুটুক, ভারত ইজরায়েলের প্রতি কোনও বার্তা দিতে মোটে রাজি নয়। ইজরায়েল প্যালেস্তাইনের মধ্যে যতই কুরুক্ষেত্র হোক, দিল্লি মুখ খুলতে নারাজ।
নতুন কিছু নয়। ইউপিএ আমল থেকেই এই ধারার অতিসতর্ক দুই-কুল-রাখা বিদেশ নীতি দেখে আসছি আমরা। যার ভাল নাম, ‘রিয়ালিস্ট’ বা বাস্তববাদী বিদেশ নীতি। আমরা দেখেছি, মায়ানমারের সামরিক সরকার যখন বিদ্রোহীদের উপর প্রবল দমন নীতি চালাচ্ছিল, গণতন্ত্রকামীদের উপর এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে সজোর প্রতিবাদ উঠছিল বিশ্ব জুড়ে, ভারত সুকৌশলে কোনও মন্তব্য না করে বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিল। মায়ানমার প্রতিবেশী দেশ, স্বার্থের বন্ধন অনেক, বিশেষত চিন যখন ঘাড়ের কাছেই নিঃশ্বাস ফেলছে। সুতরাং বাস্তববাদ। দেখেছি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে যখন সংকটের মেঘ ঘনিয়ে উঠছিল, পারস্য উপসাগরে মোতায়েন হচ্ছিল মার্কিন রণজাহাজ, দিল্লি কিছুতেই পক্ষ নিতে রাজি হল না, সে দিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ওয়াশিংটনের শত উপরোধেও। তার কারণ: ইরান থেকে গ্যাস-পাইপলাইন আসার কথা ভারতে, সেই মূল্যবান অর্থনৈতিক বন্দোবস্তের কোনও ক্ষতি যেন না হয়। এই বাস্তববাদকেই নাম দেওয়া হল উত্তর-নেহরুবাদ। প্রথম প্রধানমন্ত্রী আবেগবশেই আদর্শ-বশ হয়ে পড়েছিলেন, এবং তাঁর আদর্শচালিত বিদেশ নীতির উত্তরাধিকার ভারতের অনেক ক্ষতি করেছে, এই যুক্তিতে সেই নতুন অনাদর্শবাদ ব্যাখ্যা করা হয়েছিল।
সব ‘বাদ’-এরই মতো, উত্তর-নেহরুবাদও ক্রমে অসঙ্গতির ফাঁদে পড়ল। ইরান বা মায়ানমারের ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান কারও ভাল লাগুক, মন্দ লাগুক, তার যুক্তি ও ব্যাখ্যা বুঝতে অসুবিধে হয়নি। এ বার ইজরায়েলের ক্ষেত্রে কিন্তু সেই অসুবিধেটা খুব তীব্র ভাবে অনুভূত হচ্ছে। প্রথমত, ভারতের এ বারের অবস্থানে অন্তর্বিরোধের ছায়া গভীর। এই রাষ্ট্রপুঞ্জে বসে এক রকম ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে, এই পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে অন্য রকম বলা হচ্ছে। আবার আরও এক রকম শোনা গিয়েছে আগে। বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্র আকবরুদ্দিন মাসখানেক আগে বলেছিলেন, গাজায় দু’পক্ষকেই সংযত হতে হবে, বিশেষত গাজা সীমান্ত পেরিয়ে ইজরায়েলের মধ্যে অনবরত যে জঙ্গি-হানা চলছে, দ্রুত সেটা থামা দরকার। ইজরায়েলের আক্রমণও কিন্তু চলছিল তখন। মন্ত্রকের চোখে সেটা তত ভয়ানক ঠেকেনি।
দ্বিতীয়ত, সব অন্তর্বিরোধ অতিক্রম করে যে বার্তা অথবা যে বার্তাহীনতা স্পষ্ট, সেটা বেশ ভাবায়। গাজায় যা ঘটছে, তার প্রেক্ষিতে চুপ করে থাকাই বাস্তববাদ? জঙ্গি হানা যত ভয়ানক, যত অন্তহীন হোক, দিনের পর দিন নিরীহ জনগোষ্ঠীকে মেরে উজাড় করে ফেলা যে অপরাধ, সেটা না বলে মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে রাখাই তা হলে বাস্তববাদ? জঙ্গিদের আমরা জঙ্গি বলি, কেননা তারা বাছবিচার না করে আক্রমণ করে। রাষ্ট্রও যদি একই কাজ করে, তবে তাকেও অন্যায়কারী বলতে হবে: এই সহজ কথাটা বলা বাস্তববাদে বারণ? এত মানুষকে অকারণে মেরো না, এটা বলা কেবল নেহরু-মার্কা আবেগ-বাদ? আর কিছু নেই?
তৃতীয়ত, ইজরায়েল ও প্যালেস্তাইন, উভয়ের সঙ্গেই যদি বন্ধুত্ব থাকে, তবে তো দুই তরফেই বাস্তববাদ দেখানোরও দায় থাকে। সে দিক থেকে ভারতের অবস্থানটা বেশ একতরফা বাস্তববাদ নয় কু? না হলে, কোনও বন্ধু-দেশের উপর এমন অনিঃশেষ বিমানহানায় বাস্তববাদীর কাজ হল কেবল অন্যমনস্ক থাকা? মায়ানমার বা ইরানের সঙ্গে এ বারের প্যালেস্তাইন সংকটের সঙ্গেও এ বারের ঘটনার বড় একটা তফাত আছে। তফাতটা হিংসার মাত্রায়। প্রতি বারই তো আর বোমায় বোমায় একের পর এক স্কুলবাড়ি কচিকাঁচা-পড়ুয়াসুদ্ধ উড়ে যায় না, হাসপাতাল চুরমার হয়ে ইনটেনসিভ কেয়ারের শয্যালগ্ন রোগীদের পুড়ে মরতে হয় না। পরিস্থিতির মাত্রা বিচার করাও এক ধরনের বাস্তববাদ। আর সেটা না করতে পারা হয় অকর্মণ্যতা, নয় সুবিধাবাদ।
চতুর্থত, গোটা দুনিয়ার বিদেশদর্শনই তো বাস্তববাদকে বেছে নিয়েছে, বিশেষত গত দশকের সেই ইরাক যুদ্ধের পর। অন্যান্য রাষ্ট্রের চরিত্র পাল্টানো বিদেশ নীতির কাজ নয়, অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ‘ম্যানেজ’ করাটাই কাজ: মার্কিন প্রতিরক্ষাবিশারদ, জর্জ ডব্লিউ বুশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রকে ডেপুটি সেক্রেটারি (২০০১-০৫) পল উলফোউইট্জ-এর এই সূত্র অতলান্তিকের দু’পারেই ভারী প্রভাব ফেলেছে। তা, সেই সব দেশও তো ইজরায়েলকে নানা রকম বার্তা দিয়েছে, সংযত হতে বলেছে। এরা ইজরায়েলের সঙ্গে শেষ অবধি মিত্র-সম্পর্কেই আবদ্ধ রয়েছে এবং থাকবে, তাতে তো তাদের সতর্কবার্তা পাঠাতে অসুবিধা হচ্ছে না! সে সব দেশে কোথাও মানুষ ইজরায়েল রাষ্ট্রের প্যালেস্তাইনে ‘অকুপেশন-পলিসি’-র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ দেখাচ্ছেন, কোথাও চলছে ইজরায়েল নামক ‘সন্ত্রাস-রাষ্ট্র’-এর মুণ্ডপাত। ভারতেরই কাঁধে তবে সব বাস্তববাদ-এর ভার? যে ইজরায়েল রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য হওয়ার জন্য ভারতের আবেদনকে সমর্থন করে না, সেই ‘বন্ধু’র প্রতি ভারত এতটাই ‘কমিটেড’, যে এমন ধ্বংসলীলা সম্পর্কেও একটা আপত্তি-বার্তা পাঠানো যায় না?
কূটনৈতিক দুনিয়ায় ইজরায়েল অতীতে মোটেও ভারত-প্রিয় বলে পরিচিত ছিল না। আরব দুনিয়ার বাইরে ভারতই প্রথম প্যালেস্তাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা পিএলও-কে স্বীকৃতি দেয়। প্যালেস্তাইনের ‘স্টেটহুড’ স্বীকার করে ১৯৮৮ সালে। গল্পটা পাল্টায় ১৯৯২ থেকে, মুক্ত অর্থনীতির আগমনের সঙ্গে সঙ্গে। ইজরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন শুরু হয়। পরিস্থিতি আরও পাল্টায় ১৯৯৮-এর পর। পোখরান বিস্ফোরণের পর যখন নিরাপত্তা পরিষদ ভারতের বিরুদ্ধে ভর্ৎসনা প্রস্তাব নেয় ও ভারতের বিরুদ্ধে অস্ত্র-নিষেধাজ্ঞা ঘোষিত হয়, ইজরায়েল তাতে গলা মেলায়নি। পরবর্তী তিনটি সরকারের আমলে এ দেশে ইজরায়েলি অস্ত্র আমদানি বিপুল পরিমাণে বাড়ে। ইজরায়েলের সঙ্গে সুসম্পর্ক ভারতের পক্ষে জরুরি। গোটা পশ্চিম এশিয়ায় একক গণতন্ত্রের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম গণতন্ত্রের মিত্রতা দরকার বইকী। ইসলামি সন্ত্রাস প্রশ্নেও ভারত-ইজরায়েল বোঝাপড়া না হলেই নয়। শুধু বাজপেয়ী বা মোদী সরকার নয়, ইউপিএ-র দুই সরকারেরও সেটা বিলক্ষণ মাথায় ছিল।
কিন্তু অর্থনৈতিক স্বার্থে আরব দুনিয়া তথা বৃহত্তর পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গেও তো ভারত বাঁধা। সৌদি আরব, ইরান, ইরাক থেকে যে খনিজ তেল ও অন্যান্য আমদানি আসে, প্যালেস্তাইনকে চোখের সামনে ধ্বংস হতে দেখেও ভারতের নির্বিকার ঔদাসীন্য সে সব দেশকে খুশি করার কথা নয়। মনে রাখতে হবে, কত লক্ষ ভারতীয় আরব দেশগুলিতে কাজ করেন। সুষমা স্বরাজের মূল বক্তব্যে তাই ভুল নেই, শ্যাম ও কুল দুইই জরুরি। মধ্যমপন্থা বিনা গতি নেই। কিন্তু মধ্যমপন্থা নিতে হলে কোনটা মধ্য-অবস্থান সেটা নির্ণয় করা এবং সেই অবধি হেঁটে যাওয়ার সাহস থাকাও জরুরি। জেদের বশে এক দিক ঘেঁষে চললে এবং সেটাকেই মাঝামাঝি বলে দাবি করলে অন্যরা হাসবে, নিজের উদ্দেশ্যও শেষ অবধি সিদ্ধ হবে না। ঠিক যে ভাবে রাষ্ট্রপুঞ্জে মানবাধিকার কমিশনের প্রস্তাবে একটা ভোট দেওয়া গেল, তেমন ভাবেই পার্লামেন্টে একটা নিন্দা প্রস্তাব নিলে ইজরায়েলের অস্ত্রচুক্তি বাতিল হয়ে যেত বলে মনে হয় না।
তা ছাড়া রাষ্ট্র ও সমাজের একটা পার্থক্য আছে। ইজরায়েলের অভ্যন্তরে যে বহু নাগরিক তাদের রাষ্ট্রের নির্বিচার আক্রমণ সমর্থন করছেন না, আন্তরিক ক্ষোভে দগ্ধ হচ্ছেন, তার প্রমাণ ইন্টারনেট খুললেই পাওয়া সম্ভব। ২৬ জুলাই তেল আভিভ-এ প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের সামনে ঘটল বিশাল প্রতিবাদী সমাবেশ, হাজার তিনেক মানুষ যোগ দিলেন। গণতান্ত্রিক দেশ ইজরায়েলে এই নাগরিকদের কোনও গুরুত্বই নেই, এটা বলা যায় না। আসলে ইজরায়েলের মধ্যেও আর একটা ইজরায়েল আছে, যাঁরা হয়তো খুশিই হতেন বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রটি তাঁদের ক্ষোভকে সম্মান দিলে! আর যদি ধরে নিই, নাগরিক সমাজ-টমাজ নয়, ইজরায়েল রাষ্ট্রেরই সমর্থক (‘বন্ধু’) হিসেবে প্রতিভাত হতে চায় দিল্লি, তাতেও একটা কথা থেকে যায়। ইজরায়েলের অস্ত্র রফতানির প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ এ দেশেই আসে। এই বিরাট বাজারের প্রতি ইজরায়েলও নিশ্চয়ই যথেষ্ট স্বার্থমনস্ক! ভারতের এত প্রত্যয়হীনতায় ভোগার দরকার কী?
দিল্লির মনে রাখা উচিত, নীতি তৈরির সময় স্বার্থের দিকে মনোযোগ দেওয়ার অর্থ নীতি থেকে আত্মপ্রত্যয়টাকে ছেঁটে বাদ দেওয়া নয়! সে ক্ষেত্রে যেটা পড়ে থাকে, তাকে তখন আর বাস্তববাদ বলা যায় না, বলতে হয় নিছক সুবিধাবাদ। আর, যে বন্ধুতায় সমালোচনার একটি বাক্যেরও জায়গা থাকে না, সেটাকেও আর বন্ধুতা বলা যায় না। বলতে হয়, মোসাহেবি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy