Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

লোক ও রাষ্ট্র

দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা এই প্রথম বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সচিবালয়ে পূজা পাইলেন, তাঁহার আরাধনাকারীরা অর্ধদিবস সরকারি ছুটিও লাভ করিলেন। কিন্তু বঙ্গভূমির মা এবং মাটি স্বীকৃতিবিহীন, অন্ধকার অগোচরে রহিয়া গেল। এই বঙ্গে ভাদ্রমাসের সংক্রান্তি কেবল বিশ্বকর্মার জন্য নির্দিষ্ট নহে। দক্ষিণবঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ইহা নারীদের লৌকিক উৎসব, অরন্ধন বলিয়া খ্যাত। সেই দিন বাড়িতে চুলা ধরানো হয় না, আগের রাতে রন্ধন-করা তণ্ডুল ও মৎস্য ভক্ষণ বিধেয়। গজবাহন, গুম্ফলালিত চারি হস্তের সুদর্শন যুবক বিশ্বকর্মা এই লোক-উৎসবের তুলনায় নিতান্ত অর্বাচীন।

শেষ আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা এই প্রথম বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সচিবালয়ে পূজা পাইলেন, তাঁহার আরাধনাকারীরা অর্ধদিবস সরকারি ছুটিও লাভ করিলেন। কিন্তু বঙ্গভূমির মা এবং মাটি স্বীকৃতিবিহীন, অন্ধকার অগোচরে রহিয়া গেল। এই বঙ্গে ভাদ্রমাসের সংক্রান্তি কেবল বিশ্বকর্মার জন্য নির্দিষ্ট নহে। দক্ষিণবঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ইহা নারীদের লৌকিক উৎসব, অরন্ধন বলিয়া খ্যাত। সেই দিন বাড়িতে চুলা ধরানো হয় না, আগের রাতে রন্ধন-করা তণ্ডুল ও মৎস্য ভক্ষণ বিধেয়। গজবাহন, গুম্ফলালিত চারি হস্তের সুদর্শন যুবক বিশ্বকর্মা এই লোক-উৎসবের তুলনায় নিতান্ত অর্বাচীন। রঘুনন্দন, জীমূতবাহন বা শ্রীনাথ আচার্যচূড়ামণির ন্যায় মধ্যযুগীয় স্মৃতিশাস্ত্রকারেরা আলাদা ভাবে বিশ্বকর্মা পূজার উল্লেখ করেন নাই। চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতকের কৃষিজীবী সমাজে কারখানার দেবতার গুরুত্ব পাইবার কথাও ছিল না। পরে ব্রিটিশ আমলে বারোয়ারি দুর্গাপূজার পাশাপাশি বিশ্বকর্মার গুরুত্বও বাড়ে, নগরসভ্যতার মতাদর্শগত আধিপত্যবাদে প্রভাবিত হইয়া গ্রামের কৃষকেরা ওই দিন ঢেঁকি, দা, বঁটি, ধামা ইত্যাদি সিঁদুররঞ্জিত করিয়া পূজা করিতেন। সেই ঢেঁকিপূজা কালের প্রভাবে খসিয়া পড়িয়াছে, শিল্পহীন রাজ্যে এখন বিশ্বকর্মার আবাহন গায় শুধুই রাস্তার রিকশা স্ট্যান্ড। কিন্তু রিকশা নামক দ্বিচক্রযানটিও উনিশ শতকে এ শহরে চিনা আমদানি। দেবতার মূর্তিটিও তর্কসাপেক্ষ। বঙ্গে পূজিত বিশ্বকর্মা বয়সে যুবক, অন্যত্র তিনি শুভ্রশ্মশ্রুগুম্ফলালিত বৃদ্ধ ঋষিপ্রতিম অবয়বসম্পন্ন। সেই বিশ্বকর্মা স্বয়ং প্রজাপতি, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তাঁহারই সৃষ্টিকর্ম। এতাদৃশ গোলমেলে দুই বিশ্বকর্মার পরিবর্তে অরন্ধনের লোক-উৎসবটি দক্ষিণবঙ্গের নিজস্ব, কিন্তু একুশ শতকের নবান্ন-নথিতেও তাহার স্বীকৃতি মিলিল না।

কেহ প্রশ্ন তুলিতে পারেন, অরন্ধন দক্ষিণবঙ্গের জনপ্রিয় লোক-উৎসব, তাহা হইলে নূতন করিয়া স্বীকৃতির দরকার কেন? লোক-উৎসব নিজস্ব প্রাণশক্তিতে সরকারি সিলমোহর ব্যতিরেকেই বাঁচিয়া থাকে ঠিকই। কিন্তু স্বীকৃতি জরুরি। ছট প্রকৃতপক্ষে সূর্যের পূজা, বঙ্গসমাজে গুরুত্ব না থাকিলেও তাহা উত্তর ভারতের প্রচলিত লোক উৎসব। সেই ছট পূজা গত বৎসর মুখ্যমন্ত্রীর প্রেরণায় সরকারি স্বীকৃতি পাইলে অরন্ধনই বা পাইবে না কেন? প্রশ্নটি ছুটির নহে। বিশ্বকর্মা হইতে ঘেঁটু পুজো, ছট হইতে মাঘমণ্ডল ব্রত কোনও উৎসবেই অহেতুক নূতন ছুটির দরকার নাই। এই রাজ্যে সরকারি কোষাগারের দাতব্যে জনসমাজের সহিত সম্পর্করহিত অর্বাচীন মাটি উৎসব চলে। অথচ দক্ষিণ ২৪ পরগনার অরন্ধন, কাটোয়ার কার্তিক পুজা, শান্তিপুরের রাস উৎসব কিংবা কালিম্পং-এর ভাইটিকা বিন্দুমাত্র প্রচার পায় না। নবান্নে বিশ্বকর্মার ঢালাও প্রসাদের পরিবর্তে তথ্য ও সংস্কৃতি কিংবা পর্যটন দফতর এই লোক উৎসবগুলিকে গুরুত্ব সহকারে প্রচার করিলে বাংলার বহুমুখী সংস্কৃতি মান্যতা পাইত। বাংলা সংস্কৃতি মানে রামমোহন-রবীন্দ্রনাথ এবং উনিশ শতকী নবজাগরণের একটিমাত্র বয়ান নহে, সেখানে উচ্চাবচ অনেক বৈশিষ্ট্য লুকাইয়া আছে। সেগুলির স্বীকৃতিতেই মা-মাটি-মানুষের যথার্থ সম্মান, অন্তঃসারশূন্য স্লোগানে নহে। আর বিশ্বকর্মা কেবল কারিগরির দেবতা নহেন। পুরাণমতে তিনি রাবণের লঙ্কাপুরী, দ্বারকায় শ্রীকৃষ্ণের প্রাসাদ ইত্যাদি সুরম্য হর্ম্যরাজি নির্মাণ করিয়াছিলেন। নিজস্ব স্ত্রী-আচার বাদ দিয়া সিন্ডিকেট-অধ্যুষিত রাজ্যে অট্টালিকা নির্মাণকারী দেবতাকে ছুটির নৈবেদ্য দান, এক কথায়, ভয়াবহ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

editorial anandabazar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE