Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

(ভ্যান)গার্ড

একদা বামপন্থীদের সমবেত কণ্ঠে ‘পথে এ বার নামো সাথী’ অহরহ ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হইত। পথের রাজনীতি অনুশীলনে তাঁহাদের কোনও ক্লান্তি ছিল না। অবরোধ, বিক্ষোভ, ভাঙচুর হইতে বাংলা বন্ধ ক্রমে একটি নৈমিত্তিক ব্যাপার হইয়া দাঁড়ায়, নিয়মরক্ষারও। ষাটের দশকে জ্যোতি বসু এক বার আটচল্লিশ ঘণ্টা বন্ধ-এর যুক্তি হিসাবে বলিয়াছিলেন: চব্বিশ ঘণ্টার বন্ধ-এ তেমন কাজ হয় না! সেই রাজনীতির পথে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক মহাপ্রস্থানের কাহিনি রচিত হয়, কিন্তু সেই পথই শেষ পর্যন্ত বামপন্থীদের মহাকরণ পর্যন্ত পৌঁছাইয়া দেয়।

শেষ আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:২৫
Share: Save:

একদা বামপন্থীদের সমবেত কণ্ঠে ‘পথে এ বার নামো সাথী’ অহরহ ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হইত। পথের রাজনীতি অনুশীলনে তাঁহাদের কোনও ক্লান্তি ছিল না। অবরোধ, বিক্ষোভ, ভাঙচুর হইতে বাংলা বন্ধ ক্রমে একটি নৈমিত্তিক ব্যাপার হইয়া দাঁড়ায়, নিয়মরক্ষারও। ষাটের দশকে জ্যোতি বসু এক বার আটচল্লিশ ঘণ্টা বন্ধ-এর যুক্তি হিসাবে বলিয়াছিলেন: চব্বিশ ঘণ্টার বন্ধ-এ তেমন কাজ হয় না! সেই রাজনীতির পথে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক মহাপ্রস্থানের কাহিনি রচিত হয়, কিন্তু সেই পথই শেষ পর্যন্ত বামপন্থীদের মহাকরণ পর্যন্ত পৌঁছাইয়া দেয়। তাহাতেও যে তাঁহাদের আন্দোলনপ্রিয়তায় ছেদ পড়ে, তাহা নহে। বরং নিজেরা সরকারে থাকিয়া কাহার বিরুদ্ধে আর আন্দোলন করিবেন, এই অসহায়তা হইতে তাঁহারা রাজ্যের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের বিমাতৃসুলভ বঞ্চনার বিরুদ্ধে বন্ধ বিক্ষোভের রাজনীতি জারি রাখেন।

আজ সেই পথে ‘এলায়ে পড়েছে ছবি’। সত্তরের দশকের পরে বামপন্থীরা আজ আবার বিরোধী পক্ষ। অথচ রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে তাঁহাদের দুর্দশা এমনই অতলে নামিয়াছে যে, রাস্তার আন্দোলন শুধু নয়, বামপন্থার এই পথিকরা রাস্তার ঠিকানাও ভুলিয়া গিয়াছেন। ডেপুটেশন, স্মারকলিপি জমা দেওয়া, বন্ধ সভাকক্ষে দলীয় কার্যকর্তাদের সভার বাহিরে তাঁহাদের রাজনৈতিক তৎপরতা এখন অতিবিরল। সম্প্রতি এমনই এক ডেপুটেশন দিয়া রাজভবন হইতে বাহির হওয়ার সময় বামফ্রন্টের নেতাদের এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা হইল। জনতা তাঁহাদের ঘিরিয়া পথে নামার আর্জি জানাইলেন: আপনারা আন্দোলন করুন, জনতার স্বার্থে, জনতার দুর্গতিমোচনে শাসকের বিরুদ্ধে লড়াই করুন। জনসাধারণ বামপন্থীদের আন্দোলনে নামার আর্জি জানাইতেছেন, অথচ বামপন্থীরা দ্বিধাগ্রস্ত! তাঁহাদের কেতাবে লেখা ছিল, তাঁহারা সর্বহারা শ্রেণির অগ্রবাহিনী বা ‘ভ্যানগার্ড’ হিসাবে নেতৃত্ব দিবেন, আন্দোলনে সংগঠিত করিবেন। দেখা যাইতেছে, ভ্যানগার্ড হইতে তাঁহারা ট্রেনের গার্ড হইয়াছেন। গার্ড-সাহেব তবু পিছনের কামরা হইতেও একটি সবুজ পতাকা নাড়িয়া ইঞ্জিন-চালককে অগ্রসর হওয়ার সংকেত দেন, তবে ট্রেন চলে। বামপন্থী বঙ্গীয় ভ্যানগার্ডরা তেমন কোনও সবুজ সংকেত দিতেও ভুলিয়াছেন।

জনসাধারণ চাহিতেছে বলিয়াই বামপন্থীদের রাস্তার রাজনীতিতে নামিতে হইবে, এমন নহে। সেই নেতিবাচক রাজনীতির পথ সম্পূর্ণ পরিহার্য। কিন্তু অন্য পথ রাজনীতিকদেরই দেখাইতে হইবে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ দীর্ঘকাল রাস্তার রাজনীতিকেই বিরোধী রাজনীতি বলিয়া চিনিয়াছেন। আজ যদি তাঁহাদের অন্য রাজনীতির স্বাদ অভ্যাস করাইতে হয়, তবে তাহার দায় বিরোধীদের উপরেই বর্তায়। ভাঙচুর, অবরোধ, বিক্ষোভ, বন্ধ-এর পথে নয়, যথার্থ বিরোধী আন্দোলন গড়িয়া তুলিতে হইবে গণতান্ত্রিক উপায়েই। কিন্তু তাহা রাস্তার রাজনীতি অপেক্ষা আরও অনেক বেশি পরিশ্রম ও সংগঠন দাবি করে। থাকিয়া থাকিয়া ইতস্তত বিবৃতি দান এবং রাজ্যপালদর্শনে কর্তব্য সাঙ্গ করিতে চাহিলে কোনও লাভ হইবে না। বামপন্থীদের সেই পরিশ্রম এবং সংগঠনের সামর্থ্য অন্তর্হিত হইয়াছে। বিরোধী রাজনীতির পরিসরে অন্য যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য বিকল্পও এ পর্যন্ত নাই। শাসকরা আপাদমস্তক অপদার্থতা ও দুরাচারে নিমজ্জিত। বাঙালির পূজা হয়তো বা মেঘমুক্ত থাকিবে, বাঙালির গণতন্ত্রের সেই ভরসা নাই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

anandabazar editorial
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE