Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

তবু, অধৈর্যতা কি অসাধুতার চেয়েও খারাপ?

এক যে ছিল পথ; ধুলোয় আকীর্ণ, জনস্রোতে উত্তাল, গণকণ্ঠে মুখর। সেই পথের ছিল এক প্রাসাদ; উচ্চতায় আকাশ-ছোঁওয়া, কারুকার্যে উজ্জ্বল, স্থাপত্যে গম্ভীর। পথের ছিল অনন্ত বৈচিত্র, অনিশ্চিত বাঁক; প্রাসাদের ছিল নিশ্ছিদ্র নিয়ম, ক্ষমতার নিশ্চয়তা। পথের এক দিন সাধ হল ধুলোকাদাসমেত প্রাসাদে প্রবেশের, প্রাসাদেরও কি বাসনা জাগল পথে নামার?

শিবাজীপ্রতিম বসু
শেষ আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ১৬:৩৮
Share: Save:

এক যে ছিল পথ; ধুলোয় আকীর্ণ, জনস্রোতে উত্তাল, গণকণ্ঠে মুখর। সেই পথের ছিল এক প্রাসাদ; উচ্চতায় আকাশ-ছোঁওয়া, কারুকার্যে উজ্জ্বল, স্থাপত্যে গম্ভীর। পথের ছিল অনন্ত বৈচিত্র, অনিশ্চিত বাঁক; প্রাসাদের ছিল নিশ্ছিদ্র নিয়ম, ক্ষমতার নিশ্চয়তা। পথের এক দিন সাধ হল ধুলোকাদাসমেত প্রাসাদে প্রবেশের, প্রাসাদেরও কি বাসনা জাগল পথে নামার?

গত ১৩ ও ১৪ ফেব্রুয়ারি ভারতীয় গণতন্ত্রের ফলিত রূপ দেখে এমনটাই ভাবতে ইচ্ছে করে! প্রথম দিন অন্ধ্রপ্রদেশ বিভাজন-বিরোধী সাংসদরা লোকসভার ওয়েল-এ নেমে, তেলঙ্গানা-বিষয়ক প্রস্তাবের কাগজ কুটিকুটি করে, স্পিকারের মাইক ভেঙে, বাধাদানকারী সাংসদদের চোখে লঙ্কার গুঁড়ো স্প্রে করে, তাঁদের সঙ্গে মারপিট করে, এমনকী (অনেক প্রত্যক্ষদর্শীর মতে) ছুরি বার করে এমন এক সহিংস নৈরাজ্যের দৃশ্য আমাদের উপহার দিয়ে গেলেন যে এ ব্যাপারে আগেই খ্যাতকীর্তি উত্তরপ্রদেশের বিধায়করাও লজ্জা পাবেন! আর ১৪ তারিখে ভারতবাসী দেখল, দিল্লি বিধানসভায় দুর্নীতিবিরোধী জনলোকপাল বিল পেশ করতে গিয়ে, পরাজিত হয়ে আম আদমি পার্টির (আপ) মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবাল ইস্তফা দিয়ে তাঁর দলের ৪৯ দিনের সরকারের অবসান ঘটালেন।

প্রথম দিনের ঘটনায় মিডিয়া প্রশ্ন তুলল, তবে কি পথের তথা রাস্তার রাজনীতি এর পর মহামহিম সংসদে বিরাজ করবে? দ্বিতীয় দিনে বেশির ভাগ কাগজের শিরোনামের সারাৎসার: কুর্সি ছেড়ে কেজরিওয়াল ফের রাস্তায়। একটি ইংরেজি চ্যানেলে তো এই উচ্চারণ আরও তীক্ষ্ন করে ১৪ তারিখের দিনভর টানাপড়েন সম্বন্ধিত খবরের শিরোনাম দিল: রোডসাইড রিপাবলিক। তাই, ভিন্নতা থাকলেও, পর পর দু’দিন দিল্লির সংসদীয় রাজনীতিতে, লোকসভা এবং দিল্লি বিধানসভায়, যা ঘটল তা বুঝতে ‘পথ’ ও ‘প্রাসাদ’ নিছক সাহিত্যকল্পনা নয়, মিডিয়ারও ভাষা; কোনও জটিল শব্দবন্ধে নয়, সহজ কথায় সোজাসাপ্টা সংবাদ পরিবেশনই যে মাধ্যমের আদর্শ, আজ তারাও আসমুদ্রহিমাচল নতুন ভাষার সন্ধানী! রাজনীতি, কিংবা যে কোনও সামাজিক অভিজ্ঞতা, যখন তার চেনা ছক বা সীমানা পেরোয়, পেরোতে চায়, তখন এমনটাই ঘটে থাকে।

‘আপ’-এর রাজনীতি অবশ্য গোড়া থেকেই মানুষের কল্পনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, এমনকী ভাবুকমনের তত্ত্বের সীমারও প্রসার ঘটিয়েছে। ক্ষমতাবানদের সীমাহীন দাপট ও দুর্নীতিতে চিড়েচ্যাপ্টা সাধারণজন আশা করেছে চালু রাজনীতির ভণ্ড কারবারিদের মুখোশ খুলে দিয়ে জীবনযাত্রার ন্যূনতম সুযোগসুবিধা পৌঁছে দেবে ‘আপ’। মধ্যবিত্ত ভেবেছে, গুন্ডা-লুম্পেনদের বদলে রাজনীতি ফের শিক্ষিত নীতিমান মানুষদের পরিসর হয়ে উঠবে। ভাবুকজন মনে করেছে, নাগরিক সমাজ ও প্রান্তিক তথা গৌড়জনের সমাজ (তাত্ত্বিক কথায় ‘রাজনৈতিক সমাজ’) তাদের সীমানা পেরিয়ে বার্তালাপ চালিয়ে এ বার এক নতুন রাজনীতির উদ্বোধন করবে। চালু রাজনীতির বদ্ধ জলাশয় দেখে চোখ-পচে-যাওয়া মিডিয়াকুলের উৎসাহও ছিল চোখে পড়ার মতো। তাদের সৃষ্ট নানা ক্যাপশন, যেমন সরকার গড়ার অনিশ্চিতির সময় ‘পহলে আপ’, নতুন দলের ঘোষিত প্রতিশ্রুতি বিষয়ে ‘আপ কি কসম’, কিংবা সরকার প্রতিষ্ঠা হলে ‘আপ কা সরকার’, অনেক দিন মনে রাখার মতো। আর ইতিমধ্যেই সবচেয়ে ঘটনাবহুল ও স্বল্পায়ু রাজ্য সরকারের শিরোপা পাওয়া ‘আপ’-এর তুলনা এখন হিন্দি বলয়ে তো বটেই, দেশের কোথাও নেই।

এক সময় অবশ্য পশ্চিমবঙ্গের প্রথম যুক্তফ্রন্ট (১৯৬৭) সম্বন্ধেও এমন সব আখ্যা দেওয়া হত, তাদের বিরুদ্ধে শ্রেণিসংগ্রামের কথা বলে রাজনৈতিক হিংসা ছড়ানোর অভিযোগও করা হত। তবু প্রথম যুক্তফ্রন্টের আয়ুষ্কাল ছিল মাস আটেকের। এবং ১৮৭০-৭১-এর ফ্রান্স-জার্মানির (তখন প্রাশিয়া) যুদ্ধের প্রেক্ষিতে প্যারিস নগরী রক্ষার্থে মেহনতি মানুষ ও সাধারণজনের চূড়ান্ত রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামরিক প্রশাসনিক পরীক্ষানিরীক্ষার সরকার ‘পারি কমিউনের’ বয়স ছিল ৭০ দিন। কল্পনার সুদূরবিন্দুতে দাঁড়ানো কোনও পাগলও অবশ্য প্রথম যুক্তফ্রন্ট বা পারি কমিউনের সঙ্গে ‘আপ’ সরকারের তুলনা টানবে না। তবে, দ্রুত অপ্রচলিত পরীক্ষানিরীক্ষায় অবিচল সরকারের সঙ্গে স্বল্পায়ুতার যে বিধিনির্দিষ্ট যোগাযোগ আছে, তা হলফ করে বলা যায়। এমন প্রতিষ্ঠান, যেন জন্মলগ্নেই এলিয়টের ভাষায় বলা যায়, ‘ইন মাই বিগিনিং ইজ মাই এন্ড...’!

কিন্তু তবে কি ট্র্যাজেডির নায়ক হওয়া ছাড়া, কিছু কাল জনগণকে হা-হুতাশে ভাসিয়ে ফের গড্ডলিকায় ফিরতে বাধ্য করা ছাড়া এই ব্যতিক্রমী চিন্তাভাবনার নায়কদের আর কিছু করার নেই? কোনও দায়দায়িত্ব নেই? এবং এই ক্ষেত্রে ‘আপ’-এর অতি বড় সমর্থকও উঁচু গলায় বলতে পারবেন না: যা হয়েছিল, সব ঠিক হয়েছিল। প্রথম ভুল, একসঙ্গে রাতারাতি সব কিছু করে দেখাবার বাসনা। পানীয় জল থেকে বিদ্যুৎ, পথবাসীদের রাত্রিনিবাস নির্মাণ থেকে বেসরকারি স্কুল নিয়ন্ত্রণ এবং সর্বোপরি দুর্নীতি ঠেকাতে জনলোকপাল বিল প্রণয়ন নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি কার্যকর করার তর যেন সইছিল না।

এই সব কিছুই নাগরিক জীবনের জরুরি দাবি, যা পূরণের জন্য কেবল টিভিতে প্রদর্শনযোগ্য দৌড়ঝাঁপ নয়, ধৈর্য ও বিবেচনার বেশি প্রয়োজন। কেননা, গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত হল, নানা পক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ও প্রয়োজনে আন্দোলন চালিয়ে যত দূর সম্ভব সহমত নির্মাণ করে দাবি বা স্বার্থ পূরণ। সে পথে না হেঁটে, অকারণ অধৈর্যে ‘আপ’ পথ হারাল। একই ভাবে, সব দুর্নীতিবাজকে এক দিনে ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করে দেওয়ার বা জেলে পোরার হুংকারের মধ্যে শিশুসুলভ দেখানেপনা যতটা ছিল, পরিপক্বতা ততটা নয়। একই ছবি দেখা গেছে কেজরীবালের ডাকা হই-হট্টগোলে শেষ হওয়া জনতা দরবারে, এবং এরই চূড়ান্ত রূপ দেখেছি কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রীর ধর্নায়। (মুখ্যমন্ত্রীর ধর্না অবশ্য পশ্চিমবঙ্গবাসীর কাছে নতুন নয়, দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট কালে মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায় আইনশৃঙ্খলার অবনতির অভিযোগে নিজের সরকারের বিরুদ্ধেই সত্যাগ্রহে বসেছিলেন।)

কিন্তু অধৈর্যতা কি অসাধুতার থেকে, দুর্নীতির থেকেও খারাপ? এটা ঠিক, ঠান্ডা মাথায় প্রাসাদী রাজনীতির প্যাঁচপয়জার মেনে লক্ষ্যপূরণে ‘আপ’ আপাতত ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু অতি-তৎপরতার মধ্যে যে তীব্র আন্তরিকতাও ছিল, তা না দেখতে পেলে নিজেকে চক্ষুষ্মান বলি কী করে? দেখানেপনার রাজনীতি সহজেই ভর্ৎসিত হয়, কিন্তু নিয়মতান্ত্রিকতার দুর্বোধ্য (উদ্দেশ্যপ্রণোদিত?) জাল যে দিনের পর দিন দেশ ও সমাজের বিরুদ্ধে অপরাধীকে, আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্তকে আড়াল করে রাখে, সে ব্যাপারে কতটা সরব হই? আর জনকল্যাণের দায়িত্ব থেকে ক্রমশ হাত-তুলে-নেওয়া উদার নীতিকে ঢাল করে সরকার যখন দেশের বনজ খনিজ জলজ সম্পদ, এমনকী আকাশবাতাস পর্যন্ত কর্পোরেট-প্রবরদের বেচে দিতে চায়, তখন তা রুখতে ‘আপ’-এর পুলিশে ‘এফ আই আর’ দায়ের করাকে আপনার প্যাটন ট্যাঙ্কের সঙ্গে টিনের তলোয়ারের অসম লড়াই মনে হতে পারে, কিন্তু এই প্রতিবাদের প্রাসঙ্গিকতা কি একেবারে হারিয়েছে, যখন এ সব নিয়ে এক কালের বিপ্লবী আজকের দরবারি বামপন্থীরা প্রায় চোখ মুদে বসে আছেন? আর, বিধানসভায় ‘আপ’ জনলোকপাল বিল পেশ করতে সচেষ্ট না হলে আর একটি তথ্যও অনেকের অজানা থেকে যেত। তা হল, অন্য রাজ্যের তুলনায় আইন প্রণয়নে দিল্লি রাজ্যের সীমাবদ্ধতার কথা: কেন্দ্রের অনুমতি না পেলে লোকপালের মতো শক্তিশালী বিল পেশের ক্ষমতাই দিল্লি বিধানসভার নেই!

তাই, অনেক কিছুতে ব্যর্থ হলেও, ৪৯ দিনের ‘আপ’ সরকার নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির এমন অনেক সীমাবদ্ধতা নির্দেশ করে গেল, এমন অনেক প্রশ্ন জাগিয়ে গেল, যার অভিঘাত সহজে ম্লান হওয়ার নয়। জানি না, কোন রাজনীতি দিয়ে এই সব সীমানা পেরনো যাবে। কোন রাজনীতিতে, কেবল ‘দুর্নীতি’র কথা বলেই নয়, ‘নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান’ ও নানা শ্রেণির ভারতবাসীকে বহুমাত্রিক বার্তালাপে মেলানো যাবে? কী ভাবে দিল্লিবাসী নিডো টানিয়া এবং গুয়াহাটিবাসী কোনও উত্তর ভারতীয় ছাত্র তাঁদের পরিচয়ের ভিন্নতা রেখে পরস্পর শ্রদ্ধায়, বন্ধুতায় মিলবেন?

অনেকে অবশ্য এ সব অকূলপাথার ভাবনায় সময় ‘নষ্ট’ করতে চান না। চেনা চাদর আর বালিশের মতোই, চেনা রাজনীতির ছকেই যাঁরা স্বস্তিতে নিদ্রা যান, তাঁদের সুখের দিন ফিরে এল। তরলমতি নৈরাজ্যবাদী ‘আপ’ সরকারের অবসান হয়েছে। ফের কংগ্রেস আর বিজেপির চেনা মুখের ‘চেনা আলো চেনা অন্ধকার’। অতএব, ‘এ বার শান্তি/স্বস্তি এ বার/ওঁ!’

শ্রীচৈতন্য কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE