নতুন বন্ধু। নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে রামবিলাস পাসওয়ান। হাজিপুর, বিহার। ছবি: পিটিআই।
বিহারের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল অনেককেই স্তম্ভিত করেছে। আসনসংখ্যার নিরিখে তো বটেই বিজেপি-র নেতৃত্বে এনডিএ পেয়েছে ৩১টি আসন, তার পর রাষ্ট্রীয় জনতা দল-কংগ্রেসের ৭টি আসন আর নীতীশ কুমারের সংযুক্ত জনতা দল আর সিপিআই-এর জোট পেয়েছে মাত্র দু’টি আসন। ভোটের অনুপাতও অবাক হওয়ার মতোই। এনডিএ-র পক্ষে যেখানে ৩৯ শতাংশ ভোট পড়েছে, সেখানে আরজেডি-কংগ্রেস পেয়েছে ২৮ শতাংশ আর নীতীশ কুমার পেয়েছেন মাত্র ১৬ শতাংশ।
যে নির্বাচনে দুইয়ের বেশি দলের মধ্যে যথার্থ প্রতিযোগিতা হয়, সেখানে আরও এক ভাবে ভোটের ফল বিশ্লেষণ করা সম্ভব— কোন দল কতগুলি আসনে প্রার্থী দিয়েছিল আর কতগুলি আসনে ‘প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বী’ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। যতগুলি আসনে দলের প্রার্থী হয় জিতেছেন, নয় দ্বিতীয় স্থান পেয়েছেন, সেই আসনগুলিতে দলকে ‘প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বী’ হিসেবে দেখা চলে। সেই হিসেবে, সংযুক্ত জনতা দল প্রার্থী দিয়েছিল মোট ৩৮টি আসনে, কিন্তু মাত্র পাঁচটি আসনে ‘প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বী’ হতে পেরেছে। সেখানে বিজেপি ৩০টি আসনে প্রার্থী দিয়ে ২৭টিতেই প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পেরেছে। আরজেডি প্রার্থী দিয়েছিল ২৭টি আসনে। প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বী ২৫টিতে। কাজেই, সংযুক্ত জনতা দলের ব্যর্থতা শুধু আসনসংখ্যার নিরিখে মাপলেই যথেষ্ট হবে না। তারা যে নিজেদের প্রধানতম বিরোধী শক্তি হিসেবে তুলে ধরতেও ব্যর্থ, এই কথাটিও একই সঙ্গে মনে রাখা প্রয়োজন।
দুটো প্রশ্নের উত্তর খোঁজা প্রয়োজন— এক, যে রাজ্যে দুটো জবরদস্ত আঞ্চলিক শক্তি, সংযুক্ত জনতা দল আর রাষ্ট্রীয় জনতা দল, রাজনৈতিক মানচিত্রে উপস্থিত, সেখানে বিজেপি এমন চোখধাঁধানো ফল করল কী ভাবে? এবং দুই, নীতীশ কুমার বিহারের পুনর্জীবনের প্রধান স্থপতি হিসেবে প্রায় সর্বজনীন স্বীকৃতি পাওয়ার পরেও তাঁর দল এত খারাপ ফল করে কী ভাবে? উন্নয়ন দিয়ে যে ভোট পাওয়া সম্ভব, ওড়িশায় নবীন পট্টনায়ক প্রমাণ করে দিয়েছেন। রাজ্যের ২১টি আসনের মধ্যে তাঁর দল ২০টি আসনে জয়ী। তা হলে নীতীশ কুমার প্রধান বিরোধী শক্তি হিসেবেও জায়গা পেলেন না কেন?
নরেন্দ্র মোদীই বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হচ্ছেন, এই কথাটি স্পষ্ট হওয়ার পর ২০১৩ সালের জুলাইয়ে সংযুক্ত জনতা দল যখন বিজেপি-র সঙ্গে জোট ভেঙে দিল, তখন দু’পক্ষই দাবি করেছিল, এতে তাদের লাভ। ১৭ বছর ধরে জোট ছিল বটে, কিন্তু কখনও তাদের সমর্থক ভিত্তি মিলেমিশে যায়নি। ধর্ম এবং জাতিগত পরিচয়ের দিক থেকে দু’দলের সমর্থকরা পৃথকই ছিলেন। জেডি(ইউ) আর বিজেপি-র জোট যে চরম বৈপরীত্যের জোট’ ছিল, সেই কথাটি এখন বহুব্যবহারে খানিক ক্লিষ্ট হয়ে গিয়েছে। জেডি(ইউ)-র সমর্থন মূলত অ-যাদব পশ্চাদপদ শ্রেণি, দলিত এবং মুসলমানদের থেকে আসত। অন্য দিকে, বিজেপি-র সমর্থক ছিল মূলত বর্ণহিন্দুরা। নীতীশ কুমার জোট ভেঙে দেওয়ার পর বিজেপি নতুন জোটসঙ্গীর খোঁজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। এমন জোটসঙ্গী, যারা অনগ্রসর শ্রেণির মধ্যে বিজেপি-র ভোটব্যাঙ্ক তৈরি করতে পারবে। বিহারে বর্ণহিন্দুর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশেরও কম। শেষ পর্যন্ত বিজেপি রামবিলাস পাসওয়ানের লোক জনশক্তি পার্টি আর উপেন্দ্র কুশওয়াহার রাষ্ট্রীয় লোক সমতা পার্টির সঙ্গে জোট করল। এই দলগুলো নিজেদের জোরে হাতে গোনা আসনেও জিততে পারত, এমন সম্ভাবনা কম। কিন্তু বিজেপি-র কাছে এদের গুরুত্ব আলাদা— যে জাতির মধ্যে এই দলগুলির সমর্থক রয়েছে, এরা সেই ভোট বিজেপির ঝুলিতে টেনে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
সিএসডিএস-র নির্বাচন-পরবর্তী সমীক্ষার ফলাফল দেখে মনে হচ্ছে, বিজেপি-র অঙ্কটা মিলে গিয়েছে। রামবিলাস পাসওয়ান যে দলিত জাতির নেতা, সেই দুসধদের ৬৮ শতাংশ এনডিএ-কে ভোট দিয়েছে। আরও তাৎপর্যপূর্ণ, বিহারের অতি অনগ্রসর শ্রেণির ৫৩ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন, তাঁরা এই বার এনডিএ-কে ভোট দিয়েছেন। বিহারের মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ এই অতি অনগ্রসর শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত, এবং তাঁরা ধারাবাহিক ভাবে জেডি(ইউ)-এর সমর্থক হিসেবেই পরিচিত। এই জনগোষ্ঠীকে বিজেপি যে নিজের দিকে টেনে আনতে পেরেছে, তার একটা বড় কারণ নরেন্দ্র মোদীর জাতিগত পরিচয়। তিনি যে নিজেই ‘অনগ্রসর শ্রেণি’র মানুষ, বিহারে নির্বাচনী প্রচারের সময় বিজেপি এই কথাটি বার বার আলাদা করে উল্লেখ করেছিল। অন্য দিকে, বর্ণহিন্দুরা প্রত্যাশিত ভাবেই বিজেপি-কে ভোট দিয়েছেন। কাজেই, বিজেপি যে অত্যন্ত ‘স্মার্ট’ ভঙ্গিতে জাতপাতের রাজনীতির তাসটা খেলতে পারে, কোনও সন্দেহ নেই। এবং, আরও একটি ‘চরম বৈপরীত্যের জোট’ তৈরি করে বিজেপি বিহারের রাজনীতিতে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠল।
তবে, বিহারে বিজেপি-র এই বিপুল জয়কে শুধুমাত্র জাতপাতের নতুন সমীকরণ দিয়ে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যাবে না। হিন্দুদের মধ্যে সত্যিই মোদী-ঢেউ ছিল। সিএসডিএস-এর সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, জাতপাতের সব স্তরের হিন্দুরাই আগের তুলনায় এই দফায় বিজেপি-র দিকে বেশি ঝুঁকেছেন। হিন্দুদের মধ্যে বিজেপি যে ভোট পেয়েছে, সেটা এই রকম— উচ্চ বর্ণ: ৭৮ শতাংশ, যাদব: ১৯, কুর্মি ও কোয়েরি: ২৬, দুসাধ: ৬৮, মহাদলিত: ৩৩। লক্ষণীয়, মাত্র দুই শতাংশ মুসলমান ভোটার পদ্মফুলে বোতাম টিপেছেন।
বিহারে মোদী-ঢেউ তৈরি হওয়ার পিছনে বিজেপি-র প্রচারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিহারে বিজেপি যে নরেন্দ্র মোদীকে তুলে ধরেছে, তিনি ইউপিএ-র আমলে তৈরি হওয়া বেকারি, মূল্যস্ফীতি, দুর্নীতির কবল থেকে ভারতকে উদ্ধার করতে সমর্থ তো বটেই, একই সঙ্গে তিনি হিন্দুদের প্রতি সহানুভূতিশীল। বিজেপি-র রাজনৈতিক বুদ্ধি এবং প্রচার-কৌশলের দক্ষতা এক আশ্চর্য পরিস্থিতি তৈরি করেছিল— জাতপাতের নতুন সমীকরণ, নরেন্দ্র মোদীর ‘উন্নয়নের দিশারি’ মার্কা ভাবমূর্তি এবং গ্রামাঞ্চলে ধর্মীয় মেরুকরণ। সবই বিজেপি-র পক্ষে গিয়েছে, এবং তারই ফল এই ঐতিহাসিক জয়।
বিজেপি-র জয়ের কারণ না হয় বোঝা গেল, কিন্তু নীতীশ কুমারের ধরাশায়ী হওয়ার ব্যাখ্যা কী? কেন তাঁর সংযুক্ত জনতা দলকে টপকে লালুপ্রসাদ যাদবের রাষ্ট্রীয় জনতা দল বিহারের প্রধান বিরোধী শক্তি হিসেবে উঠে এল? জেডি(ইউ) যখন নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার তীব্র বিরোধিতা করেছিল এবং পরে সেই প্রশ্নেই এনডিএ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল, অনেকেই ভেবেছিলেন যে তাতে বিহারের মুসলমান ভোটাররা নীতীশ কুমারের প্রতি প্রসন্ন হবেন। রাজ্যে মুসলমান ভোটারের অনুপাত ১৬ শতাংশ, কাজেই তার রাজনৈতিক গুরুত্বও অনস্বীকার্য। তার ওপর, লালুপ্রসাদ যাদব জেলবন্দি ছিলেন এবং তাঁর লোকসভা নির্বাচনে লড়ার উপায় ছিল না। কংগ্রেসও গোটা দেশেই প্রতি দিন জনপ্রিয়তা হারাচ্ছিল। কাজেই, কংগ্রেস আর লালুপ্রসাদের জোট যে আদৌ কোনও দাগ কাটতে পারে, সেটা অনেকের কাছেই অভাবনীয় ছিল। সবাই ধরেই রেখেছিলেন, লড়াই হবে বিজেপি আর জেডি(ইউ)-এর।
কিন্তু, বিহারে মোদী-ঢেউ যত তীব্র হতে আরম্ভ করল, ততই ভাঙন ধরল জেডি(ইউ)-এর প্রধান ভোটব্যাঙ্কে। মহাদলিত আর অতি অনগ্রসর শ্রেণি, দুই গোষ্ঠীই ক্রমশ বিজেপির দিকে ঝুঁকল। তাঁদের অনেকের কাছেই এই নির্বাচন পটনার নয়, দিল্লির। অন্য দিকে মুসলমানরাও জেডি(ইউ)-কে সমর্থন করবেন কি না, সেটা ভাবতে আরম্ভ করলেন। তাঁদের লক্ষ্য পরিষ্কার ছিল— তাঁরা চেয়েছিলেন, বিজেপি-র প্রার্থী হারুন। ফলে, যে কেন্দ্রে যে প্রার্থী বিজেপি-র প্রার্থীকে সবচেয়ে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে ফেলতে পারবেন, তাঁদের কাছে সেই প্রার্থীই গ্রহণযোগ্য। প্রাক্-নির্বাচনী সমীক্ষাগুলিতে যখন দেখা গেল, জেডি(ইউ) নয়, বিজেপি-র বিরুদ্ধে অপেক্ষাকৃত ভাল অবস্থানে আছে আরজেডি-কংগ্রেস, মুসলমান ভোটও সে দিকেই ঝুঁকল।
আরও একটি বিষয় জেডি(ইউ)-এর বিপক্ষে গিয়েছে। একে তাদের সমর্থকরা বহু উপ-জাতির মধ্যে ছড়িয়ে আছেন। তার ওপর তাঁদের বেশির ভাগই এমন প্রান্তিক গোষ্ঠীর মানুষ যে প্রকাশ্যে নিজেদের রাজনৈতিক আনুগত্যের কথা জানানোর সুযোগ তাঁদের নেই। কাজেই, কোন লোকসভা কেন্দ্রে জেডি(ইউ)-এর জোর কতখানি, সেটা হিসেব করে বলার কাজটা খুব কঠিন ছিল। মুসলমানরা সেই ঝুঁকি নিতে চাননি। তাঁরা আরজেডি-র দিকে ঝুঁকেছেন। আরজেডি-র সমর্থনভিত্তি মূলত যাদব ভোট। বিহারের জনসংখ্যায় তার অনুপাত ১৩ শতাংশ। এক দিকে নরেন্দ্র মোদীর নামমাহাত্ম্যে ভোটের ধর্মীয় মেরুকরণ, আর অন্য দিকে জেডি(ইউ) সমর্থকদের নীরবতা, এই দুইয়ে মিলে সম্ভবত মুসলমান ভোটব্যাঙ্কের বড় অংশকে আরজেডি-র দিকে ঠেলে দিয়েছে। নীতীশ কুমারের দল যে বিহারে প্রধান বিরোধীর মর্যাদাও পেল না, এটা তার একটি বড় কারণ।
এখন প্রশ্ন হল, লোকসভা ভোটে নীতীশ কুমার যে ধাক্কা খেলেন, সেটা কি সাময়িক, নাকি পাকাপাকি? ২০১৫ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তাঁর স্বমহিমায় ফিরে আসার আদৌ কোনও সম্ভাবনা আছে কি?
মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে পদত্যাগ করে এবং বিধানসভায় লালুপ্রসাদ যাদবের সমর্থন আদায় করতে পেরে নীতীশ একটি মোক্ষম চাল দিয়েছেন, সন্দেহ নেই। এক ঢিলে অনেকগুলো পাখি মারলেন তিনি— রাজ্যে সরকারের অস্তিত্ব বিপন্ন হতে দিলেন না, যে উচ্চবর্ণ লোকসভা ভোটে তাঁর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, এক মুশ্হরকে মুখ্যমন্ত্রী করে তাদের ওপর একটা প্রতীকী শোধ তুললেন। এবং নীতীশ-লালু একত্রে লড়লে তাঁরা ২০১৫ সালের বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ ভোট টানতে পারেন। একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে, সিএসডিএস-এর সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, বিহারের প্রায় পঁচিশ শতাংশ ভোটার এ বার জাতীয় স্তরে পরিবর্তন আনার কথা মাথায় রেখে ভোট দিয়েছিলেন। অনুমান করা চলে, তাঁদের সিংহভাগই বিধানসভা ভোটে জেডি(ইউ)-এর শিবিরে ফিরে যাবেন।
নীতীশ কুমারের সর্বভারতীয় উচ্চাকাঙ্ক্ষা জবরদস্ত ধাক্কা খেয়েছে বটে, কিন্তু বিহারে তিনি বড় জোর সাময়িক ভাবে বিধ্বস্ত। লোকসভা নির্বাচনে ভরাডুবি কোনও মতেই তাঁর রাজনৈতিক জীবনে পূর্ণচ্ছেদ টানছে না।
পটনায় ইন্টারন্যাশনাল গ্রোথ সেন্টার-এ অর্থনীতিবিদ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy