লেখক পেরুমল মুরুগান মৃত। পুনর্জন্মে তাঁর বিশ্বাস নেই। এক সাধারণ শিক্ষক, পি মুরুগান নামেই তিনি বেঁচে থাকবেন এ বার থেকে। তাঁকে একা ছেড়ে দিন।’— এ কথা নিজ ফেসবুকে লিখলেন লেখক স্বয়ং। মুরুগান তামিল ভাষার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক লেখক, যিনি ইতিমধ্যে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারের মনোনয়ন তালিকায় রয়েছেন। গত ২৬ ডিসেম্বরে তাঁর পঞ্চম উপন্যাস ‘মাধোরুবাগান’ (অর্ধেক রমণী) নিষিদ্ধ করার ডাক দিয়ে তাতে আগুন জ্বালিয়ে তাঁকে গ্রেফতারের দাবি তুলেছিল তাঁর শহর থিরুচেঙ্গুড়ুর স্থানীয় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ ও আঞ্চলিক দলিত সম্প্রদায়। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার বদলে লেখককে নিজ বাসস্থান ছেড়ে চলে যেতে পরামর্শ দেয় পুলিশ। আঠারো দিন টানা বিক্ষোভে বন্ধ থাকে মুরুগানের নিজের শহর এই অভিযোগে যে, ওখানকার দলিত গোষ্ঠীর একটি ন্যক্কারজনক উপস্থাপনা হয়েছে ওই উপন্যাসে, এবং তার ফলে হিন্দু রমণীর সম্মানহানি হয়েছে। অর্থাত্ একসঙ্গে আঘাত লেগেছে দলিতত্বে ও হিন্দুত্বে। তার ফলে, সংবিধানের ১৯(১)(ক) ধারা মোতাবেক ব্যক্তির মতপ্রকাশের যে অধিকার আছে, প্রশাসনের আছে সেই অধিকার সুরক্ষিত রাখার দায়, দায়িত্ব নেওয়ার আছে লেখক ও তাঁর পাশে থাকা ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী সমাজকে সুরক্ষা দিয়ে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা করা— এ সব কার্যক্ষেত্রে দূর অস্ত্। সেটাই হয়, কেননা দেশটা ভারতবর্ষ। প্রশাসনের পক্ষে এক শুল্ক আধিকারিকের দায়িত্বে বিক্ষোভকারী ও মুরুগানের মধ্যে শান্তি চুক্তি হয়, সেখানে গোষ্ঠী ভাবাবেগে অনিচ্ছাকৃত আঘাত লাগার জেরে লেখককে দিয়ে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইয়ে মুচলেকা নিয়ে নেওয়া হয়।
যখন জঙ্গি আক্রমণে মৃত সহকর্মীদের রক্ত মুছে শার্লি এবদো দফতর খুলে ফের কার্টুন ছাপাল, তখন তা কথা বলার স্বাধীনতাকে পুনর্জন্ম দিল। তেমন কোনও সম্ভাবনা না দেখতে পেয়ে লেখক মুরুগান এ ভাবে ‘আত্মঘাতী’ হলেন। এই অভিব্যক্তিকে আমরা যেন শুধু শিল্পীর নাজুক অভিমান বলে ভুল না করি, ধরে না নিই যে, মুরুগান আর কোনও দিনও কলম ধরবেন না, ক্ষতিপূরণ দিয়ে সব প্রকাশকের থেকে সব বই তুলে নেবেন, এমন ঘোষণা করলেন। তিনি ও তাঁর স্ত্রী সরকারি চাকুরে, ওই গঞ্জেই মুরুগানের জন্মকর্ম, বেড়ে ওঠা। ভিটেমাটি ছেড়ে তাঁর পক্ষে শুধু এ কারণেই নির্বাসন নিয়ে গুপ্ত বাসস্থানে চলে গিয়ে আরব্ধ কাজ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, কারণ তাঁর কাজ ওই অঞ্চল নিয়েই। আর তাই অন্যত্র বাঁচতে গেলে বা সেখানেই থেকে অন্য কিছু নিয়ে লিখতে হলে, জীবন মৃত্যুবত্ই।
পেরুমল মুরুগান গত ১৭ বছর ধরে সরকারি আর্ট কলেজে তামিল পড়ান। অনেক ধ্রুপদী তামিল গ্রন্থ তিনি সম্পাদনা করেছেন। যে অঞ্চলের কথা বলছি— কোঙ্গুনাড়ু— মুরুগান সেই অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষাবিশেষজ্ঞ, সে ভাষার অভিধান রচয়িতা। থিরুচেঙ্গুড়ু এলাকায় পূজিত দেবদেবীদের নিয়ে নানা কাল্ট, রিচ্যুয়াল, লোককথা, লোকগাথা, উপকথা সংগ্রহ করে ওই অঞ্চলটির না-চর্চিত না-কথিত না-গ্রন্থিত একটি সমান্তরাল সামাজিক ইতিহাস নির্মাণের কাজ করছেন দীর্ঘদিন ধরে। এই অঞ্চলে কিছু মানুষ কেন নিজেদের ‘স্বামী কোদুথা পিল্লাই’ বা ঈশ্বরপ্রদত্ত সন্তান বলেন, তার নৃতাত্ত্বিক কারণ খুঁজতে গিয়ে মুরুগান দেখেন, তা এসেছে একটি রিচ্যুয়াল থেকে। এই মানুষগুলির কারও বয়সই পঞ্চাশের কম নয়, এবং তারা যে প্রথার সঙ্গেই যুক্ত, তা স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই অবলুপ্ত হয়ে গেছে। অর্ধনারীশ্বর শিবের বার্ষিক পূজার রথযাত্রা উত্সবে, এলাকার সন্তানহীন রমণীরা ওই কার্নিভালে যোগ দিতেন এবং পছন্দমত পুরুষের সঙ্গে মিলিত হতেন, যে সব পুরুষকে আবার ওই একটি দিনের জন্য ঈশ্বরের অবতার বলা হত। এই মিলনের সন্তানরাই ঈশ্বরপ্রদত্ত হিসেবে পরিবারে ও সমাজে মান্যতা পেত। মুরুগানের উপন্যাস এই রিচ্যুয়ালের ওপর ভিত্তি করেই। বিষয়টা ব্যক্তি-অভিপ্রায় ও গোষ্ঠীচেতনার দ্বন্দ্ব। ওই স্বাধীনতার পর পর যে সময়টা, তখনও এই রিচ্যুয়াল চলছে যেমন চলার কথা আঞ্চলিক গোষ্ঠীর জীবনে। কালী ও পোন্না বিয়ের বারো বছর পরেও সন্তানহীন, অথচ তারা এটা নিয়ে হাহাকার করার বদলে পরস্পরের প্রতি খুবই নিবেদিত। কিন্তু, পিসিশাশুড়ি, তালুইমশায় আর সমাজ তাবিচ কবজ জলপড়া ঝাড়ফুঁক কিছু করতে বাকি রাখে না। শেষে পোন্নাকে ধরে বেঁধেই পাঠানো হয় ওই রথের মেলায়, গর্ভাধান করতে। ঈর্ষা দ্বন্দ্ব ব্যক্তি-আশংকায় শেষ হয়ে যায় দম্পতির প্রেম।