রক্ষণ-স্ট্র্যাটেজি। নরেন্দ্র মোদী (বাঁ দিকে) ও কিরণ বেদি। দিল্লি, ১ ফেব্রুয়ারি। ছবি: পিটিআই
মাইসোর নরসিংহাচার্য শ্রীনিবাস, ভারতবর্ষের সমাজতত্ত্বের পথিকৃৎ, সেই পঞ্চাশের দশকে ‘স্যানস্ক্রিটাইজেশন’ তত্ত্ব সামনে এনেছিলেন। পশ্চিমী তত্ত্ব-সমৃদ্ধ সমাজবিজ্ঞানের উল্টো পথে হেঁটে শ্রীনিবাস বলতে চেয়েছিলেন সনাতন ভারতীয় সমাজের মধ্যেকার সচলতার কথা। সেই সচলতা পরিচালিত হত বর্ণনির্দিষ্ট সামাজিক কাঠামোর আদবকায়দা মেনেই। উনি দেখাতে চেয়েছিলেন, তথাকথিত নিম্নবর্ণ/জাতির মানুষরা ‘উচ্চ জাতির’ জীবনচর্চা, ধর্মীয় রীতিনীতি অনুকরণের মধ্যেই নিজেদের পরম্পরার উচ্চস্তরে নিয়ে যেতে চান।
ছয় দশক পরে ভারতীয় সমাজ এখন অনেক বেশি সচল। সামাজিক গতিশীলতার উল্লেখযোগ্য পরিপূরক হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক ক্ষমতাবিন্যাস। রাজনীতির ময়দানে অনেক বেশি সক্রিয় হয়েছে জাতি/বর্ণ গোষ্ঠীর সংখ্যাতত্ত্ব। সামাজিক-রাজনৈতিক মূলধনের অন্যতম উপাদান হয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠতার হিসেবনিকেশ। ‘জিতনি জিস্কি সংখ্যা ভারী, উত্নী উস্কি হিস্সেদারি’: এই আপ্তবাক্য প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জাঁকিয়ে বসেছে। গোটা দেশে, বিশেষত উত্তর ভারতে, গণতন্ত্র এক নতুন অক্ষে পাক খাচ্ছে। রাজনীতির মঞ্চে ‘পিছড়ে বর্গ’-এর আত্মস্বীকৃতি আর দাপট আপাতত বিরাট। শ্রীনিবাসের তত্ত্ব যেন উল্টে গিয়ে পাল্টে গিয়েছে। নিম্নবর্ণের অবস্থান-অবদান রাজনৈতিক পরিসরে এতটাই উচ্চারিত যে তাদের জীবনচর্চা, জীবনবোধে অংশগ্রহণ, সবই হয়ে উঠছে ক্ষমতা দখলের সিঁড়ি বেয়ে ওঠার অত্যাবশ্যক শর্ত। যতই অলংকারসর্বস্ব হোক, প্রতীকী হোক, রাজনীতির ময়দানে এই প্রতীকী মূলধনের গুরুত্ব অস্বীকার করা চলে না।
স্বাধীনতার পর থেকে ২ অক্টোবর ভারতবাসী রামধুন সহযোগে মহাত্মা গাঁধী জন্মজয়ন্তী পালন করতেই অভ্যস্ত। সত্যাগ্রহ ও অহিংস আন্দোলনের মাহাত্ম্য পেরিয়ে আমরা তেমন উৎসাহ নিয়ে খোঁজ করেনি, দক্ষিণ আফ্রিকার টলস্টয় ফার্ম-এর কমিউনিটি শৌচালয়ে মোহনদাস কর্মচন্দের কর্মকাণ্ড। কমিউনিটি শৌচালয় সাফাই অভিযানের মধ্য দিয়ে উনি ভেঙে ফেলেছিলেন হিন্দু বর্ণাশ্রয়ী অভিধানের অনেক গূঢ় বাধা-নিষেধ। গত বছরের ২ অক্টোবর কিন্তু একটা নতুন জিনিস এই অভিযানের কথা মনে করাল। জাতীয় আইকন মহাত্মা গাঁধীর জন্মদিনে গাঁধী-আদর্শের অপর প্রান্তে থাকা সদ্য নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ঝাড়ু-হাতে উদ্বোধন করে বসলেন স্বচ্ছ ভারত অভিযান। সনাতন হিন্দু বর্ণসমাজে দূষণ সংবলিত নিয়ম-আচারের আধারে সুরক্ষিত যে পবিত্রতার ধারণা, তাকেই যেন এক ঝটকায় নামিয়ে আনলেন দৈনন্দিন বাস্তবের মাটিতে। সকলকে ঝাড়ু-হাতে সাফাই অভিযানে ডাক দিয়ে স্বচ্ছ ভারত গড়ার আহ্বানের মধ্য দিয়ে নরেন্দ্র মোদীর দুটি উদ্দেশ্য সাধিত হল। এক, বর্ণাশ্রমভিত্তিক সনাতনী ধ্যানধারণা ভেতর থেকে না পাল্টিয়েই দলের রাজনৈতিক প্রতীকী কার্যক্রমের মাধ্যমে নিম্নবর্ণকে আত্মস্থ করার চেষ্টা। দুই, পাঁকে ভরা রাজনীতি এড়িয়ে চলা শহুরে নাগরিক, প্রধানত উচ্চবর্ণ, সমাজের সাফসুতরো চকচকে ভবিষ্যতের স্বপ্নের সওদাগর হিসেবে তাঁর যে ঐতিহাসিক পরিচিতি, তাকে আর এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
‘স্বচ্ছ ভারত’-এর রাজনৈতিক তাৎপর্য, ক্রিয়া-কার্যক্রম যে কোনও মিশনারি সংঘের সংস্কারবাদী কর্মকাণ্ডের থেকে এখানেই আলাদা। এবং, এর মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে আমাদের বর্তমান রাজনীতির গতিপথ। গত ২ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী কেন রাজপথ থেকে নেমে রাজধানীর বাল্মীকি বস্তিতেই এলেন, ঝাড়ু-হাতে স্বচ্ছ ভারত অভিযানে? রাজধানীর সবচেয়ে আবর্জনাময় বসতি কি বাল্মীকি বস্তি? মনে রাখতে হবে, উত্তর ভারতের বর্ণব্যবস্থার সবচেয়ে পিছনের সারিতে থাকা দলিত বর্গ বাল্মীকি। বর্ণাশ্রম অনুসারে সমাজের যাবতীয় জঞ্জাল সাফাই-এর দায়িত্ব এদের হাতে। এরাই ঝাড়ুদার বা জমাদার। স্বাধীন প্রজাতন্ত্রের ছয় দশক পার করেও রাজধানী শহরে এদের বসবাস উচ্চবর্ণ/বর্গ-বর্জিত নির্দিষ্ট এক পল্লিতে: বাল্মীকি বস্তি। বুঝতে অসুবিধে হয় না, এদের কাছে টানার চেষ্টাই প্রতীকের গূঢ় তাৎপর্য।
অসুবিধে হয় না প্রতীকের সীমাটা বুঝতেও। যে দিন সাফাইরত প্রধানমন্ত্রীর ছবি ইলেকট্রনিক মিডিয়া ঘণ্টায় ঘণ্টায় ছড়িয়ে দিয়েছিল বিশ্বের নানা প্রান্তে, তামিলনাড়ুর মাদুরাইতে ঠিক সে দিনই আগুনে পুড়ে মারা যায় এক যুবতী। দলিত যুবককে বিয়ে করার অপরাধে বাড়ির লোকেরাই তাকে আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলে। প্রতীক আর তার সীমা, এই দুই খবরের মধ্য দিয়ে অর্থবহ হয়ে ওঠে। প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের ভিত্তি যে সংখ্যাতত্ত্ব, তার দাবিতেই নিম্নবর্ণ/বর্গের সঙ্গে এই প্রতীকী সখ্য।
মে ২০১৪-র জাতীয় নির্বাচনে একচেটিয়া সাফল্যের ছয় মাস পরেই আবার নির্বাচনী পরীক্ষায় বসতে হল ব্র্যান্ড মোদীকে। মহারাষ্ট্র, হরিয়ানার মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে তার জয়জয়কার দেখা গেল। ২০০৯-এর বিধানসভায় মাত্র চারটি আসন পাওয়া দল (৯.০৪ শতাংশ ভোট) এক লাফে ৯০ আসনের ৪৭টা জিতে (৩৩.২ শতাংশ ভোট) হরিয়ানায় ক্ষমতায় চলে এল। জাতপাত, সংখ্যাগুরু জাঠ ভোটারের অঙ্ক পেরিয়ে, জাঠ রাজ্যপাট টপকে অভাবনীয় ভাবে মুখ্যমন্ত্রিত্ব এল রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক নেতা মনোহর লাল খট্টরের হাতে। নির্বাচনোত্তর বিশ্লেষণে দেখা গেল মোট ভোটারের ১৯ শতাংশ দলিত শ্রেণি এককাট্টা (অধিকাংশ বাল্মীকি সম্প্রদায়ের) হয়ে যাওয়ায় এই পরিবর্তন। ২০০৯ বিধানসভার প্রান্তিক তৃতীয় স্থানাধিকারী দলটিও ২০১৪-য় ছিনিয়ে নিতে পারল রাজ্য শাসনক্ষমতা। মোদীর স্বচ্ছ ভারত প্রকল্পের অন্তত একটা উদ্দেশ্য সাধন চোখের সামনেই দেখা গেল।
মহারাষ্ট্রেও শিবসেনার সঙ্গে পঁচিশ বছরের জোট ছেড়ে একা হাতে শাসনভার তুলে নিল ব্র্যান্ড মোদী। ‘শিব ছত্রপতি কা আশীর্বাদ, চলো চলে মোদী কে সাথ’ স্লোগানে ভর করে, বিকাশ বার্তার ঝড় তুলে ম্যাডিসন স্কোয়্যারে মোদীর বক্তৃতা মরাঠি চ্যানেলে চ্যানেলে প্রচার মারফত মহারাষ্ট্র জয়ের জমি তৈরি হয়েছিল। এর পর জয়তালিকায় যুক্ত হল ঝাড়খণ্ড, জম্মু ও কাশ্মীর।
এই বিজয় নিবন্ধের মধ্যিখানে আছে লোকাল আর গ্লোবালের এক অমোঘ মিশেলের গল্প। লোকাল যদি হয় আদি পরিচয়-ভিত্তিক, সম্প্রদায়/গোষ্ঠী চেতনা উদ্ভূত প্রকল্প, গ্লোবাল হল বৃহত্তর কর্মযজ্ঞের নেটওয়ার্কে সক্রিয় আংশগ্রহণের কার্যক্রম। অলংকারসর্বস্ব, প্রতীকী জগতের বাইরে থাকে অকাট্য অর্থনীতির বাস্তব, সমাজ-বিবর্তন ও তার উপর নির্ভরশীল আশা-আকাঙ্ক্ষা। দেশের ৪৭ শতাংশ ভোটারের বয়স ৩৫ বছরের নীচে, ১৮-২৩ বয়সের কোঠায় প্রায় ১৬ শতাংশ। তথ্যপ্রযুক্তি সমৃদ্ধ এই ভোটার-সমাজ শহরমুখী। স্থবির মতাদর্শের বোঝা সরিয়ে এঁরা অনেক বেশি আত্মবিকাশমুখী। তাই কেবল সনাতন ভারত নয়, এই শহুরে বা শহরগামী ভারতকেও নিজের কাছে টেনে আনতে হবে বইকী।
আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের প্রেক্ষিতে আমাদের মনে রাখতে হবে এই চলমান চালচিত্র। লোকসভায় ৮০-তে ৭১ পাওয়া উত্তরপ্রদেশ আর বিধানসভায় ৯০-এর মধ্যে ৪৭টা আসন পাওয়া হরিয়ানার মধ্যেকার এই বিচিত্রভূমি কি সামাল দিতে পারবে ‘পূর্ণ বহুমত সম্পূর্ণ বিকাশ/দিল্লি চলে মোদী কে সাথ’ স্লোগান? দিল্লি বিধানসভা এলাকায় ২০ শতাংশ দলিত ভোটার। নির্বাচনী দিন ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই বিজেপির প্রথম সভা ছিল ‘মহাদলিত সম্মেলন’। প্রাথমিক প্রচারপর্বে বিধানসভা এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা দলিত বস্তিগুলোই প্রধান লক্ষ্য। স্বাভাবিক, কারণ স্বচ্ছ ভারত অভিযানের ‘ঝাড়ু’ই যে আবার দিল্লির প্রধান প্রতিপক্ষ আম আদমি পার্টির নির্বাচনী প্রতীকচিহ্ন। লড়াই-এর ক্ষেত্রটা ঠিক কোথায়, বোঝা কঠিন নয়। মোট ৭০টা আসনের মধ্যে সংরক্ষিত ১২টা আসন। ২০১৩-র বিধানসভায় সেই ১২টার মধ্যে ৯টা আসনই ছিল ‘আপ’-এর দখলে, শহরের প্রান্তিক, খেটে-খাওয়া, নিম্নবিত্ত শ্রেণির বৃহত্তর অংশের সঙ্গে মধ্যবিত্ত পেশাদার আর উচ্চাকাঙ্ক্ষী শ্রেণির প্রচ্ছন্ন সমর্থনপুষ্ট কেজরীবালের মুঠোয়। প্রবল মোদী-ঝড়ে লোকসভায় ৭টা আসনের মধ্যে একটাও জিততে না পারলেও ‘আপ’-এর ভোটের ভাগ কমেছিল মাত্র ৩.৬ শতাংশ: ৩২.৯ শতাংশ থেকে ২৯.৩ শতাংশ।
উচ্চবিত্ত আর মধ্যবিত্তের কিয়দংশের মধ্যে যে ভোটদানবিমুখ প্রবণতা, সেটা ধরে নিয়েও বলতে হবে, আম জনতা আর নতুন প্রজন্মের আশা-আকাঙ্ক্ষার পারদ কিন্তু ৭ ফেব্রুয়ারি বুথ-মুখীই থাকবে। রাজধানী শহর কিন্তু সেই ‘ইন্ডিয়া আগেনস্ট কোরাপশনস’-এর দিনগুলো থেকেই নতুন দিশা হাতড়ে বেড়াচ্ছে। আত্মবিকাশ আর উচ্চাকাঙ্ক্ষার অলংকৃত বাগ্মিতায় নরেন্দ্র মোদী গোটা উত্তর ভারত প্রায় জয় করে বসেছেন, সনাতন পদ্ধতি সরিয়ে রেখে নির্দিষ্ট ইলেক্টরেট-ভিত্তিক আশা-আকাঙ্ক্ষার মুখ সামনে এনেছে ‘নতুন’ বিজেপি। কিন্তু আজ নিজের তোলা স্লোগানগুলোই যেন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হয়ে ঘিরে ধরছে প্রধানমন্ত্রীকে। নতুন ভারতের আশা-আকাঙ্ক্ষা আর স্বচ্ছ রাজনীতির মূর্ত প্রকাশ হয়ে উঠতে চাইছে কেজরীবালের নেতৃত্বে ‘আপ’। যুদ্ধটা সহজ নয়।
যে সামাজিক আন্দোলনের মুখ অরবিন্দ কেজরীবাল, তারই আর এক মুখ কিরণ বেদিকে রাতারাতি দলভুক্ত করে সম্ভাব্য মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরার এই নির্বাচনী স্ট্র্যাটেজি কিন্তু বেশ রক্ষণাত্মক। বিশেষত নতুন চিন্তা-সমৃদ্ধ ‘আপ’-এর সামনে। এই রক্ষণ-স্ট্র্যাটেজিই দেখিয়ে দিচ্ছে, ভারতীয় রাজনীতির সাম্প্রতিক দায় কতটা জটিল। বোঝা যাচ্ছে, যুদ্ধক্ষেত্রটা দিল্লি বিধানসভা হলেও যুদ্ধটা আসলে আরও অনেক সুদূরপ্রসারী।
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতত্ত্বের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy