এর কারণ হল, ২০১১ সালে সিপিএমের হারানো ভোট তৃণমূলের ভোটবাক্সে জমা হলেও এ বারে দক্ষিণবঙ্গের এই আসনগুলিতে তৃণমূল কংগ্রেসের হারানো ভোট সিপিএমের কাছে না এসে বিজেপির কাছে চলে গেছে। শুধুমাত্র সরকারবিরোধী এই ভোটই নয়, সিপিএমের নিজস্ব ভোটের একটা বড় অংশও সম্ভবত বিজেপিতে গেছে। ফলত, ২০০৯ লোকসভার তুলনায় গড়ে ১২ শতাংশ আর ২০১১-র বিধানসভায় তুলনায় গড়ে ১০ শতাংশ ভোট কমেছে বামফ্রন্টের। অন্য দিকে, ২০০৯ ও ২০১১-এর তুলনায় এই ২০টি আসনে সব মিলিয়ে প্রায় ১৩ শতাংশ ভোট বাড়িয়েছে বিজেপি। অবস্থা এমন যে, কলকাতার দু’টি আসন-সহ বহু দিন ধরে তৃণমূলের নিজস্ব ভোটব্যাঙ্ক ডায়মন্ড হারবারের মতো কেন্দ্রে ১০ থেকে ২০ শতাংশের উপর ভোট কমেছে তৃণমূলের। এমনকী তৃণমূল কংগ্রেসের অলিখিত রাজধানী দক্ষিণ কলকাতা আসনে প্রায় ২১ শতাংশ! অর্থাত্, এক কথায়, তৃণমূলের গড় বলতে যে অঞ্চলকে বোঝায়, সেখানেই বিজেপি বড় আকারে নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়েছে। এ-যাত্রা সেটাই বিরোধী ভোট ভেঙেচুরে আসনসংখ্যার হিসেবে শাসক দলকে বাঁচিয়ে দিয়েছে বটে, কিন্তু বিজেপির এই অভিযান বজায় থাকলে ভবিষ্যত্ কোন দিকে যেতে পারে, সেটা না বুঝতে পারার কোনও কারণ নেই।
তৃণমূলের গড়ে বিজেপির ভোট বাড়ার কারণ একাধিক। জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষিতের পাশাপাশি আছে স্থানীয় প্রেক্ষিত, অনেক ক্ষেত্রে দু’টি আবার একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। জাতীয় প্রেক্ষিত মূলত দু’টি। প্রথমটি যদি হয় মোদী-হাওয়ায় গা ভাসানো, তবে দ্বিতীয়টি হল, বামফ্রন্ট এবং তৃণমূলের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে ‘খেলোয়াড়’ হয়ে ওঠায় ব্যর্থতা। এ কথাও অনস্বীকার্য যে, রাজ্যের বহু উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, এমনকী গরিব মানুষও মোদীর তথাকথিত ‘উন্নয়ন’-এর ব্যান্ডওয়াগনে উঠে পড়তে চেয়েছেন। বেরিয়ে আসতে চেয়েছেন বনাম আর বদলার নেতিবাচক রাজনীতি থেকে, কাঁকড়া প্রবৃত্তির দাসত্ব থেকেও। অনেকটা যে ভাবে বুদ্ধবাবুর ফেরি করা উন্নয়নের স্বপ্নে ২০০৬ সালে বাঙালি সাড়া দিয়েছিল! এর পাশাপাশি সিপিএম থেকে বিজেপিতে সমর্থন সরার আর একটা বড় কারণ হল গত কয়েক বছরে বামপন্থী দলগুলির আন্দোলন-বিমুখতা ও নিজের সমর্থকদের তৃণমূলের আক্রমণ থেকে বাঁচানোর চেষ্টায় ব্যর্থতা। হাড়োয়াকাণ্ডের সময় সিপিএম নেতারা আক্রান্ত মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর বদলে প্রেস বিবৃতি দিতে ব্যস্ত থাকেন। এই অনাথ সমর্থকদের এক অংশ এত দিন তৃণমূলে চলে গেছেন। কিন্তু ক্রমশ অন্য অনেকের ঠিকানা হয়েছে বিজেপি। এটা বিজেপির কৃতিত্ব, ঠিক সময়ে ঠিক ভাবে প্রচার করে তাঁরা এই মানুষগুলোকে ভোটবাক্সে আনতে পেরেছেন।
ভোটের শেষপর্বে মোদী-মমতা দ্বৈরথ তৃণমূলকে মুসলিম ভোট পেতে সাহায্য করেছে। স্পষ্টতই, গ্রামেগঞ্জে মোদী-ভয় মুসলমানদের মমতামুখী করেছে। কিন্তু এ প্রবণতা সর্বত্র সমান নয়। সম্ভবত মুসলিমরা যেখানে যাকে বিজেপির বিরুদ্ধে সবচেয়ে সবল প্রার্থী মনে করেছেন, ভোটবাক্সে তাঁর পাশে থেকেছেন। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ বহরমপুরে অধীর চৌধুরির রেকর্ড ভোটে জেতা। বস্তুত, বহরমপুর, জঙ্গিপুর ও মুর্শিদাবাদে (মুসলিম জনসংখ্যা যেখানে কমবেশি ৬০ শতাংশ) বিজেপি বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি। দক্ষিণ কলকাতার মতো অনেক কেন্দ্রেই আবার মুসলিম ভোট কংগ্রেসের ঝুলিতে পড়েছে। সম্ভবত মুসলিম ভোটাররাও দল, প্রার্থী অনুযায়ী আসন ধরে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। পাইকারি ফতোয়ার দিন শেষ।
পশ্চিমবঙ্গের এ বারের ভোটের ফলাফল, বিশেষ করে তৃণমূলের ২০০৯ সালে জেতা ২০টি আসনের নিরিখে, দু’টি সংকেত দেয়। প্রথমত, তৃণমূল-বিরোধী ভোট বাড়ছে। দ্বিতীয়ত, বিজেপি সিপিএমের হাত থেকে মূল বিরোধী ‘স্পেস’টা অনেকখানিই নিয়ে নিয়েছে ও আগামী দিনে আরও নিতে প্রস্তুত। যেহেতু আগামী পাঁচ বছর দিল্লিতে বিজেপির একচ্ছত্র সরকার, তাই এই প্রবণতায় জলসিঞ্চন করা হবে সন্দেহ নেই। ফলে অনেক স্থানীয় নেতৃত্ব এটাকে নমো হাওয়ায় ‘ফ্লুক’ বলে উড়িয়ে দিতে চাইলেও তা হয়তো উড়ে যাবে না।
এখানেই আগামী দিনে সিপিএমের ভূমিকা ও তৃণমূলের স্ট্র্যাটেজির গুরুত্ব। সিপিএম স্বতঃসৃষ্ট রসাতলে আরও কত প্রবেশ করবে, তা তারাই জানে। কিন্তু তৃণমূলকে সম্ভবত নিজের ভোটব্যাঙ্ক বজায় রাখার পাশাপাশি গাঁ-গঞ্জেও বামপন্থীদের ওপর তৈরি করা চাপ নিয়ে দু’বার ভাবতে হবে। উদাহরণ, আরামবাগ। ২০০৯ সালে তৃণমূলের ৩৭ শতাংশ ভোট বেড়ে এ বার ৫৬ শতাংশ। আর সিপিএমের ৫৪ শতাংশ কমে ৩০ শতাংশ? পাঁচ বছর আগে যেখানে রেকর্ড ভোটে জিততেন অনিল বসু, সেখানে এ বার প্রায় একই রেকর্ডে জিত হল তৃণমূলের! বামপন্থীরা মুছে গেলে তৃণমূলের খুব খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু সেই মুছে যাওয়া স্লেটে বিজেপি যদি নিজের অঙ্ক কষতে এবং মেলাতে শুরু করে, সরকার-বিরোধী শক্তি যদি ক্রমশ তার দিকে কেন্দ্রীভূত হয়? আসানসোল স্মরণীয়। সেখানে তৃণমূলের ভোটের হার কমেছে ১০ শতাংশ, অন্য অনেক জায়গায় যার থেকে অনেক বেশি ভোট কমেও লক্ষাধিক ভোটে জিতেছেন অনেক তৃণমূল প্রার্থী। কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রায় ২৭ শতাংশ কমে যাওয়া বামফ্রন্টের ভোটের একটা বড় অংশ বিজেপিতে গিয়ে বাবুল সুপ্রিয়কে জিতিয়ে দিয়েছে। এটা সহজ হিসেব, যত বিরোধী শক্তি সিপিএম ও বিজেপির মধ্যে ভাগ হবে, ততই তৃণমূলের সুবিধা, বিশেষত দক্ষিণবঙ্গে, যেখানে কংগ্রেস তুলনায় গৌণ। আবার, উত্তরবঙ্গে এই বিরোধী ভোট ভাগটা তিন দলের মধ্যে হলেও ওখানে তৃণমূলও সাংগঠনিক ভাবে দুর্বল।
ফলে, এক রাজনীতিবিদের ভাষা ধার করে বলতে হয়, রাজ্য জয়ের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আলিসাহেবদের পাশাপাশি আলিমুদ্দিনকেও লাগবে! ২০০৬ সালে ২৩৫টি আসনে জিতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য রাজনৈতিক ভবিষ্যত্ পড়তে ভুল করেছিলেন। ফল সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম ও রাজ্যপাট হারানো। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিশ্চয়ই সিপিএমের কাছ থেকে সেই ভুল ধার করবেন না।