প্রাথমিক উত্তর: না। ২০০৫ সালে ওঠা মামলার যে রায় সুপ্রিম কোর্ট নয় বছর পর দিল, তাতে আপাতভাবে কোনও নতুন কথা নেই। ঠিক, ভারতীয় রাষ্ট্র নাগরিকের সমানতার উপর গুরুত্ব দেয়, ধর্মীয় আচারের স্বাধীনতাকেও গুরুত্ব দেয়। এই দুই দিক রক্ষা করে চলার মধ্যে নিশ্চয়ই একটা সংকট আছে। কিন্তু সেই সংকটের সমাধানটাও অজানা ছিল না। মোটের উপর জানা ছিল, শরিয়ত আদালত যে ফতোয়াই ঘোষণা করুক, তা মানা বা না-মানাটা ঐচ্ছিক, কারণ দেশের আইন ও বিচারের সঙ্গে এর কোনও যোগ নেই। সুপ্রিম কোর্ট এ বার কথাটা আবারও খোলসা করে বলল, “It is within the discretion of the persons concerned either to accept, ignore or reject it.” কথাটার মধ্যে স্পষ্ট একটা বার্তা আছে। ঐতিহাসিক বা যুগান্তকারী না হলেও এই স্পষ্টতার জন্যই এই রায় গুরুত্বপূর্ণ।
ফতোয়া কিংবা শরিয়তি বিচার তবে ‘বৈধ’ নয়। তার মানে কি এগুলি ‘অবৈধ’? তা-ও কিন্তু নয়! কোনও সম্প্রদায় কিংবা গোষ্ঠী নিজস্ব উদ্যোগে দুই ব্যক্তি বা দুই পক্ষের বিতণ্ডা মেটানোর কাজ করতেই পারে। স্থানীয় স্তরে এমন ব্যবস্থা বহু অঞ্চলেই দেখা যায়। অসমে বা অরুণাচল প্রদেশে গ্রাম-সমাজগুলিতে বিবাদ মেটানোর দায়িত্ব পালন করে থাকেন যে ‘গাঁও-বুড়া’, তাঁদের যে যুক্তিতে অবৈধ আখ্যা দেওয়া যায় না, সে ভাবেই দার-উল-কাজা’-কেও বেআইনি বলা সম্ভব না। প্রতিষ্ঠিত বিচারব্যবস্থার বিরুদ্ধতা না করে তাঁরা দৈনিক ভিত্তিতে নানা বিবাদের মীমাংসা করে থাকেন। আবার, অবৈধ না হলেও এঁদের বৈধতার সার্টিফিকেট দিয়ে ‘সমান্তরাল বিচারব্যবস্থা’ও বলা যায় না, কারণ দেশের আদালতের সঙ্গে এই ব্যবস্থাপনার কোনও সম্পর্কই নেই, রাষ্ট্রীয় বিচারব্যবস্থা এই সব স্থানীয়, গোষ্ঠীগত বা সম্প্রদায়গত স্তরগুলির বহু ঊর্ধ্বে একক ও অবিসংবাদিত।
বৈধ-অবৈধের মাঝে এই তৃতীয় পরিসর ভারতীয় ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এখানেই এ ব্যবস্থার শক্তি। এখানেই তার দুর্বলতা। প্রতি দিনের দিনযাপনে বিবাদভঞ্জনের এই বিকল্প পদ্ধতি তার ক্ষেত্র ও পদ্ধতির উপর নির্ভর করে কখনও শক্তি হয়ে ওঠে, কখনও দুর্বলতায় পরিণত হয়। দার-উল-কাজা’র মতো যে ব্যবস্থা শ্বশুর-ধর্ষিতা ইমরানাকে স্বামীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পত্রপাঠ ধর্ষক শ্বশুরকে বিয়ে করতে বলে, সেই ব্যবস্থাই আবার জমিজমা জ্ঞাতিগোত্র বিবাদ প্রত্যহ শান্তিপূর্ণ ভাবে মিটিয়ে দেয়, কোনও খবরই তৈরি হয় না। বহু মুসলমান নিয়মিত সেই বিচারের দ্বারস্থও হয়। অত্যাচার-অনাচারের সম্ভাবনা সত্ত্বেও তারা অমন বিচার চায় কেন? কেননা কাজি বা মৌলবির কাছে বিচার চাইতে খরচও কম, নথিপত্রও লাগে কম, বিচার দ্রুত নিষ্পন্নও হয়। আধুনিকতার নিরপেক্ষতা ও নৈর্ব্যক্তিকতা মজুত থাকা সত্ত্বেও সেই আধুনিকতার হ্যাপা নিতে যদি মানুষ অরাজি হয়, তা হলে কী করণীয়, দার-উল-কাজা নিয়ে বিষোদ্গারের আগে প্রগতিবাদীদের সেটাও ভাবতে হবে বইকী।
আসলে, বৈধ-অবৈধ বিতর্কের থেকে অনেক বেশি জরুরি— এই পরিসরটাকে সম্পূর্ণ ভাবে ঐচ্ছিক ও মুক্ত রাখার বন্দোবস্ত। যদি কোনও নাগরিক নিজ ইচ্ছায় এ পথেই সমস্যার সমাধান চায়, এবং সেই সমাধানে তৃপ্ত থাকে, তবে সম্ভবত রাষ্ট্রের বাবারও সাধ্য নেই তাতে বাদ সাধে। কিন্তু এই ‘চাওয়া’ ও ‘তৃপ্ত থাকা’র প্রশ্ন দুটো দেড়শো শতাংশ গুরুতর। ভারতীয় সংবিধান যদি সবার উপরে ব্যক্তির অধিকারকেই স্থান দিয়ে থাকে, যদি ব্যক্তির পছন্দের যুক্তিতেই বৈধ-অবৈধের মাঝে আলো-আঁধারি পরিসরটা রক্ষা করা হয়, তা হলে অন্তত এটুকু নিশ্চিত করতে হবে যে, কারও ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেন তাকে এই বিচারের অন্তর্গত না করা হয়, কারও পছন্দের বিরুদ্ধে এই বিচারের রায় মানতে বাধ্য না করা হয়। মানার প্রশ্নটা যেন সত্য ও পূর্ণ অর্থেই ব্যক্তিগত স্বীকৃতির উপর নির্ভর করে।
এ প্রশ্ন উঠলেই অবশ্য শরিয়তি বিচারের সামনে একটা হিমালয়প্রমাণ প্রশ্নচিহ্ন (বিস্ময়চিহ্নও) বসে যায়। কেননা, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিচার চাইতে যায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ছাড়া অন্য কেউ, যারা নিজেদের সেই সম্প্রদায়ের মুরুব্বি বলে মনে করে। ইমরানার কাহিনিটাই ধরা যাক। তিনি, তাঁর স্বামী বা শ্বশুর ছাড়া বিষয়টিতে কারও প্রত্যক্ষ স্বার্থ ছিল না। কিন্তু তাঁরা কেউ বিচার চাইতে যাননি, গিয়েছিলেন গ্রামের অন্যান্যরা, যে অন্যান্যদের ‘ইমান’ নষ্ট হতে বসেছিল এই ভ্রষ্টাচারে। বিচারের রায়ও ইমরানা বা তাঁর স্বামীর মনঃপূত হয়নি, তাঁদের তা মানতে বাধ্য করা হচ্ছিল।
এখানেই অঞ্চলগত, সম্প্রদায়গত বা গোষ্ঠীগত পরিসরের ব্যাপক অভ্যন্তরীণ অত্যাচার ও অনাচারের সুযোগ। নাগরিক অধিকারের মোড়কে অন্যদের নাগরিক অধিকার পেষণের জবরদস্ত বন্দোবস্ত। (অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পেষণযোগ্য সেই ‘অন্য’ নাগরিকরা নারী।) সমাজের এই নিহিত পেষণ ভাঙাটা রাষ্ট্রের অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য। বৈধ-অবৈধের বিচার ছাড়িয়ে তাই অনেক বড় হয়ে ওঠে একটা অন্য প্রশ্ন: কী ভাবে সমাজের মধ্যেকার পরিসরটাকে জিইয়ে রেখেও সেই পরিসরের অ-গণতন্ত্রটাকে নিকেশ করা যায়।
কঠিন প্রশ্ন। তত্ত্ব বা বাস্তব, কোনও ক্ষেত্রেই এর সহজ উত্তর নেই। কিন্তু চেষ্টা করে যাওয়া ছাড়া রাস্তাও নেই। এমনই একটা রাস্তা স্পষ্ট হল সুপ্রিম কোর্টের রায়ে। গুরুতর একটি কথা বলা হয়েছে এখানে: দেশের আইনমতে, যে ফতোয়া জারি করছে সে অবৈধ নয়, ফতোয়া জারি করাটাও অবৈধ নয়, কিন্তু ফতোয়া জোর করে কার্যকর করার চেষ্টা সম্পূর্ণ অবৈধ, দেশের আইনে শাস্তিযোগ্য। অর্থাৎ, যার উপর ফতোয়া জারি হল, তার সেই ফতোয়া অস্বীকার করার নাগরিক অধিকার রক্ষা করা কর্তব্য, কোনও জবরদস্তি চলবে না। এত গুরুত্বপূর্ণ কথাটা এত স্পষ্টত আগে বলা হয়নি। এই জন্যই কিন্তু রায়টি শেষ বিচারে অবশ্যই ‘ঐতিহাসিক’!
শিক্ষার অবকাশ, সামাজিক চলাচলের সুযোগ যে দেশে এত কম, নারী-পুরুষ বৈষম্য এত বেশি, সেখানে কি এই মুক্তির পথটুকু সমাজের অত্যাচারিত, নির্যাতিতদের কাছে পৌঁছবে? দেশের কোণে কোণে ইমরানারা কি জানতে পারবেন, শরিয়তি আদালত যা-ই বলুক, পুরুষতন্ত্র ও ধর্মতন্ত্রের হাত থেকে তাঁদের রক্ষা করার জন্য দেশের আইন-অস্ত্রাগার প্রস্তুত? সে অস্ত্রের সাহায্য নিতে তাঁরা আসতে পারবেন তো ঠিক সময়ে? এই সব ভয়ানক সংশয় রয়েই গেল। তবু, অধিকার ও মুক্তির দিকে তো প্রবাহিত হতেই হবে। হয়তো তারই ঢেউয়ে ঢেউয়ে প্রান্তিক বা পেষিত ‘ব্যক্তি’ এক দিন ‘সম্প্রদায়’কে প্রতিহত করার জোর পাবে।
হয়তো সেই ঢেউয়ের ধাক্কাতেই সম্প্রদায়ের সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক আরও গতিশীল (ফ্লুইড) হবে। সম্প্রদায়ের আইডেন্টিটির আশ্রয়টা রেখেও সম্প্রদায়ের নিষ্পেষণের মোকাবিলা সম্ভব হবে। কী ভাবে? সম্প্রদায়ের মধ্যে এক রকমের অভ্যন্তরীণ বহুত্ব তৈরির মাধ্যমে। মুসলিম সমাজের ইমান কীসে রক্ষিত হয়, কীসে নষ্ট হয়, তা নিয়ে নানা মত ও পথ সৃষ্টির মাধ্যমে। মুসলিম পার্সোনাল ল’ বলে যে নিয়মকানুন প্রচলিত, তার হদিশ আজও রয়ে গিয়েছে সমাজের একটি ছোট অংশের কুক্ষিতে, কাজি-মুফতি-মৌলবিদের ছোট্ট গণ্ডিটায়। তাঁরা যা জানেন ও বোঝেন, সাধারণ মুসলিম সেটা জানেন না। শহুরে শিক্ষিত মুসলিম কোরআন-হাদিশ-শরিয়তের সঙ্গে যথেষ্ট পরিচিত হন না। তাই সম্প্রদায়ের প্রশ্নে দার-উল-কাজা’র প্রতাপ অপ্রতিহত হয়। ব্যক্তির বিপন্নতা বাড়তে থাকে। এটা শুধু মুসলিম সমাজের কথা নয়। সব সমাজেই রক্ষণশীলদের হাতে ধরা থাকে ‘শাস্ত্র’ বিচারের রশি। সেই রশি কাটতে প্রয়োজন হয় মাঝামাঝি কিছু মানুষের, যাঁরা যুগের সঙ্গে সমাজের পরিবর্তন ঘটাতেও রাজি, আবার সমাজের ভিত্তি যে শাস্ত্রবিচার, সে বিষয়েও যথেষ্ট জ্ঞানী। তখনই তৈরি হয় সম্প্রদায়ের মধ্যেকার অনেকগুলি স্তর। আর সেই স্তরে স্তরে বিন্যস্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যক্তি খুঁজে নিতে পারেন তাঁর নিজস্ব পছন্দের অবস্থানটি।
অর্থাৎ? সমাধানের পথটা লম্বা। সম্প্রদায়ের নিজস্ব কার্যক্রমগুলি সরাসরি বেআইনি করে দেওয়ার শর্টকাটটা যেহেতু নৈতিক এবং ব্যবহারিক দুই দিক থেকেই কঠিন, তাই সমাধান খুঁজতে হবে অন্য পথে। সম্প্রদায় থাকুক, তার বিচারও থাকুক, কিন্তু সেই বিচারের পাশাপাশি আরও নানান বিকল্প আচারবিচার সম্প্রদায়ের মধ্যেই চলুক। শরিয়তি বিচারই একমাত্র বিচার নয়, এমনকী ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের জন্যও নয়, এই জায়গাটা তৈরি করাই তাই প্রধান লক্ষ্য হওয়া জরুরি।