বছর কয়েক আগে আমি যখন ভারত সরকারের সংস্কৃতি সচিব ছিলাম, তখন পশ্চিমবঙ্গ ক্যাডারের তিন জন অফিসার কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রকে সচিব পদে ছিলেন। বাঙালি, কিন্তু অন্য রাজ্যের ক্যাডারের অফিসার, এমন কয়েক জন ছিলেন অর্থ মন্ত্রকে, যোজনা কমিশনে। উত্তরপ্রদেশ ক্যাডারের পুলক চট্টোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর সচিব হয়েছিলেন। ফিকি-তে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। সিআইআই-এর প্রধান ছিলেন তরুণ দাস। দু’জন নন-আইএএস সচিব ছিলেন বিজ্ঞানবিষয়ক মন্ত্রকে— এক জন পারমাণবিক শক্তি দফতরের খুবই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে, আর অন্য জন সিএসআইআর-এ। বস্তুত, সে সময় আমার এক বন্ধু দিল্লিতে বিভিন্ন দফতরে ক্ষমতার শীর্ষে থাকা বাঙালিদের একটা তালিকা তৈরি করেছিলেন। এক ডজনেরও বেশি নাম ছিল সেই তালিকায়। আর, কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বিতীয় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে প্রণববাবু তো ছিলেনই। অনেকে অবশ্য ‘দ্বিতীয়’ শব্দটির বদলে বলবেন, বহু বছর ধরে তিনিই ছিলেন মন্ত্রিসভার সবচেয়ে ক্ষমতাবান সদস্য। প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি ছিলেন, ছিলেন আরও জনাছয়েক বাঙালি প্রতিমন্ত্রী।
কিন্তু, তার পর কী হল? এক জন ‘বিশেষ সচিব’ ব্যতীত পশ্চিমবঙ্গ ক্যাডারের কোনও অফিসার— বাঙালি বা অবাঙালি— এখন আর কেন্দ্রীয় সরকারের সচিব পদে নেই। ২০১১ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে আমরা চার জন কেন্দ্রীয় সচিব পদ থেকে অবসর নেওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গ ক্যাডারের আর মাত্র এক জন সচিব হয়েছিলেন, তা-ও দু’বছরেরও কম সময়ের জন্য। কেন্দ্রে ৭৪ জন সচিবের মধ্যে এখনও তিন জন বাঙালি আছেন বটে, কিন্তু তিন জনই অন্য রাজ্যের ক্যাডারের। তাঁদের মধ্যে এক জন অল্প দিনের মধ্যেই অবসর নেবেন, আর বাকি দু’জন যে দায়িত্ব পেয়েছেন, সেটা তাঁদের যোগ্যতার তুলনায় কম। পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি উত্তরপ্রদেশ, ওডিশা, রাজস্থান বা মধ্যপ্রদেশের তুলনা করলে ছবিটা স্পষ্ট হবে। কেন্দ্রে এখন এই রাজ্যগুলি থেকে সচিব পদে আছেন যথাক্রমে ১৮, ৭, ৬ ও ৬ জন। এমনকী, জম্মু-কাশ্মীর থেকেও তিন জন সচিব আছেন কেন্দ্রে, সিকিমের মতো ছোট রাজ্য থেকেও এক জন।
আমি যখন নিতান্তই তরুণ, তখন তিন জন রায়-এর নাম শুনতাম নিয়মিত— এ কে রায়, কে কে রায় এবং এইচ এন রায়। কেন্দ্রে অত্যন্ত সম্মানিত সচিব ছিলেন তাঁরা। প্রবাদপ্রতিম সুবিমল দত্ত ও অশোক মিত্র তো ছিলেনই। গোপাল দত্ত বা বিশ্বেশ্বর চট্টোপাধ্যায়ের মতো বাঘা আইপিএস অফিসার ছিলেন। কাশ্মীর ক্যাডারের সুশীতল বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রকে সচিব পদে ছিলেন। সুবোধ ঘোষ, অমল দত্ত, এবং অতি অবশ্যই ডি বন্দ্যোপাধ্যায়, নীতীশ সেনগুপ্ত আর ভাস্কর ঘোষের কথা মনে পড়ছে। পঞ্জাবের আধা-বাঙালি এন কে মুখোপাধ্যায় সত্তরের দশকের মাঝামাঝি অন্যতম ক্যাবিনেট সচিব ছিলেন। টি এন সেশন এসে তাঁর স্মৃতি মুছে দেওয়ার আগে পর্যন্ত দোর্দণ্ডপ্রতাপ নির্বাচন কমিশনার হিসেবে এস পি সেন বর্মার নামও দিল্লিতে বহুআলোচিত ছিল। এ ছাড়াও ছিলেন দুই শর্মা সরকার ভাই, এক জন ইউপিএসসি-র চেয়ারম্যান, আর অন্য জন দেশের আইন শাখার শীর্ষে।