ইরাকের ঘটনা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রতিবেশী ছোট্ট দেশ কুয়েতের এক জনপ্রিয় কট্টর ইসলামি প্রচারক হাজাজ-আল আজমি বলেছেন এই বিপ্লব শোষকের বিরুদ্ধে শোষিত মানুষের বিদ্রোহ: ইরাকে সিরিয়ায় সর্বত্র, আমেরিকা থেকে শুরু করে দেশীয় স্বৈরাচারী শাসক সকলের বিরুদ্ধে এই অভ্যুত্থান। আজকালকার দস্তুর অনুযায়ী আজমি চট করে ‘টুইট’ করে দিয়েছেন কথাটা, তাঁর ‘ওয়ান-লাইনার’ পাঁচ লক্ষ ভক্তের কাছে পৌঁছে দশ লক্ষ কান হয়ে বহু লক্ষ মানুষকে উদ্বুদ্ধ ও প্ররোচিত করছে। সৌদি আরবের নানাবিধ নেট-প্রচারেও এই একই কথা বার বার, লাগাতার। শোষক-শোষিত সরলীকরণের পিছনে উহ্য থাকছে যে, ইরান ও সিরিয়ার রাষ্ট্রযন্ত্রে শিয়া আধিপত্য আটকানোর এই যে সুন্নি অভিযান, তার প্রাথমিক লক্ষ্য, ইরাকের ক্রমবর্ধমান শিয়া প্রভাব চূর্ণ করা, প্রধানমন্ত্রী নুরি আল-মালিকিকে গদিচ্যুত করা ও টাইগ্রিস নদী-অববাহিকা থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত যে অঞ্চলকে প্রাচীন ইতিহাসে ‘লেভান্ত্’ বলে বোঝানো হত, সেখানে সুন্নি ইসলামকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা। বস্তুত, যে জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসআইএস এই অভিযান চালাচ্ছে, তার পুরো নামটা ঠিক কী, তাই নিয়ে যখন নানা রকম মতভেদ, একটি মত অনুযায়ী নামটির প্রকৃত অর্থ, ‘ইরাক ও ‘লেভান্ত্’-এ ইসলামের প্রতিষ্ঠা বাহিনী’।
এই সংগ্রাম যে ঠিক শোষক-শোষিতের নয়, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে কি এই সংগ্রাম সরাসরি শিয়া বনাম সুন্নির? সেটাও বড্ড সরল ঠেকছে না? মুশকিল হল, প্রবলপরাক্রান্ত আইএসআইএস ইরাকের বহু অংশ দখলে আনার সঙ্গে সঙ্গে সীমান্ত পেরিয়ে সিরিয়াতেও প্রসারিত হচ্ছে, স্বৈরাচারী সিরীয় প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের প্রবল দমনপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী জনসমাজকে নতুন করে ভরসা দিচ্ছে। আর তার সুযোগে এই সরল বাণীর জোরদার প্রচার চলছে। কখনও কখনও সরলতা তার মনোহারিণী চটক দিয়ে জটিল পরিস্থিতির উপর মায়াঞ্জন বুলিয়ে দেয়, যাতে মনে হয় ঘটনাটা যেন এমনই এতই সরল, স্পষ্টাস্পষ্টি দুই সমাজের যুদ্ধ।
বিষয়টা অত সরল বা স্পষ্ট নয়। ঠিকই, সিরিয়া ও ইরাক, দুই দেশেই এই মুহূর্তে প্রধান শাসক শিয়া গোষ্ঠীভুক্ত। কিন্তু সিরিয়ার শিয়া স্বৈরাচারীটি শিয়া-পরিচিতির থেকে স্বৈরাচারী-পরিচিতিতেই বেশি অপ্রিয়, সুতরাং তাঁর বিরুদ্ধে সংগঠিত যে বিক্ষুব্ধ জনসমাজ, তাকে সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু ছকে ভাগ করা মুশকিল। অন্য দিকে, ইরাকের শাসক আল-মালিকি গত বছর কয়েক শিয়া পরিচয়েই শাসন করে এসেছেন, তাই ইরাকের বিক্ষোভ-অভিযানে শিয়া-সুন্নি বিভেদ প্রথম থেকেই স্পষ্ট। আল-মালিকি যে গোষ্ঠী-শাসন চালিয়েছেন, তার প্রধান পৃষ্ঠপোষক থেকেছে ইরান, প্রয়োজনে পরিত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই দুই পক্ষই কিন্তু খোলা গলায় আল-মালিকির শিয়া-বাড়াবাড়ির কথা বলে; প্রথম পক্ষ গর্বিত উচ্চারণে, দ্বিতীয় পক্ষ ঈষত্ বিরক্তি ও ভর্ত্সনা সহযোগে। মার্কিন বাহিনী ইরাক থেকে সরে যাওয়ার পর ক্ষমতার রাশ হাতে পেয়েই আল-মালিকি সেনাবাহিনী সহ প্রতিটি রাষ্ট্রীয় বিভাগে প্রত্যক্ষ ভাবে নিজের ব্যক্তিগত প্রতাপ এবং পরোক্ষ ভাবে শিয়া প্রাধান্য স্থাপন করে এসেছেন, নিশ্চিত করেছেন, নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে যাতে সামরিক অভ্যুত্থানের সম্ভাবনাটুকুও না থাকে। বিচারবিভাগ, শিক্ষাব্যবস্থা, নাগরিক প্রশাসন, এমনকী ব্যাঙ্কেও, নিজের গোষ্ঠীর লোকদের বসিয়ে তাদের হাতে অ-পছন্দের (অর্থাত্ অ-শিয়া) মানুষদের উপর অত্যাচার চালানোর বিরাট ক্ষমতা দিয়েছেন। নির্বাচন কমিশন, সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক এবং দুর্নীতি-নিরোধক কমিশন: এদের নাকি এমন করে আগাপাশতলা তৈরি করেছেন যাতে আগামী একশো বছরে তার ফাঁক দিয়ে মাছি (অর্থাত্ কোনও সুন্নি) গলতে না পারে। মার্কিন বকুনি কাজ দেয়নি, কেননা চির-মার্কিন-শত্রু প্রতাপান্বিত প্রতিবেশী ইরানের কৃপাদৃষ্টি সতত সজাগ থেকেছে আল-মালিকির প্রতি।