একটা সংকট কি খানিক কমেছে? সামরিক নিয়ন্ত্রণের ধরনটা কি পাল্টেছে?
বইটি এই সময়ে লেখার কারণটা এখানেই। ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দরাজ সহায়তায় বিশ্বের নানা প্রান্তে স্বৈরতন্ত্রী শাসন তৈরি হয়। গত এক-দেড় দশকে কিন্তু সেখানে একটা বদল ঘটেছে। সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ গভীর থাকলেও নিয়ন্ত্রণের চরিত্রটা পাল্টেছে। ‘পাক সামরিক বাহিনী’ বলতে ভারত বোঝে একটাই এস্টাবলিশমেন্ট। এটা অত সহজ নয়। আগে পাকিস্তানে যখন ‘সামরিক দখল’ ঘটেছে, পুরো বাহিনী অংশ নেয়নি, বাহিনীর একটা অংশের জন্যই দখল অভিযান হয়েছে। ১৯৫৮’য় আয়ুব খানের মার্শাল ল’-র সময়ে তাঁর সহচর গোষ্ঠীই কাজটা করেন, গোটা বাহিনী যুক্ত ছিল না।
পাক সামরিক বাহিনীও অনেক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এসেছে। পারভেজ মুশারফ প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে পরিস্থিতি যে রকম ছিল, এখন তা নেই। সেনাবাহিনীও বুঝেছে যে দেশ হিসেবে পাকিস্তান যথেষ্ট জটিল। একটা পার্টনারশিপ দরকার, অসামরিক ও সামরিক ক্ষমতার পার্টনারশিপ। মিলিটারি নিয়ন্ত্রণ এখনও রয়েছে, পরিস্থিতি না পাল্টালে ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, সেই নিয়ন্ত্রণের প্রকৃতি আগের মতোই আছে। এই বই লেখার পিছনে এটা একটা জরুরি উপলব্ধি। এখনও দেশ জুড়ে অনেক দুর্নীতি। রাজনীতির নামে বহু ভণ্ডামি। কিন্তু পাকিস্তানের রাজনীতিতে একটা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা এসেছে ২০০৮ সালে। রাজনীতিকরা, সামরিক নেতারাও, সকলেই বুঝতে পেরেছেন যে ক্ষমতার একটা সীমা থাকে। সেটাকে যত ইচ্ছা প্রসারিত করা যায় না। করলে উল্টো সংকট তৈরি হয়। একটা কমপ্রোমাইজ প্রয়োজন। পাক রাজনৈতিক এস্টাবলিশমেন্ট এখন জানে যে, নিজেদের রাজনৈতিক সংঘর্ষকে এমন বিন্দুতে নিয়ে যাওয়া উচিত হবে না যেখানে মিলিটারি হস্তক্ষেপ অবধারিত হয়, আর তাদের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে দাঁড়ায়। সামরিক বাহিনীও জানে যে, চালকের আসনে না বসে তাদের বসতে হবে চালকের পিছনের আসনে। গণতন্ত্রের জন্য এটাই প্রাথমিক শিক্ষা। প্রথম সিঁড়ি।
তুমি বলতে পারো, ইমরান খানের আন্দোলনের সময়ে রাজনীতির প্রকাশ্য মঞ্চে সামরিক বাহিনীর ঢুকে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু মনে রাখা দরকার, বিরোধী দলগুলি সেটা কিছুতেই হতে দেয়নি, তারা পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ-এর পাশে দাঁড়াতে রাজি হয়নি!
কিন্তু ইমরান খানের পিছনে কি সামরিক সমর্থন ছিল না?
ইমরান খান সত্যিই সামরিক হাইকম্যান্ডের নির্দেশে চলছিলেন কি না, বলা শক্ত। কিন্তু এটুকু বোঝাই যায় যে সামরিক হাইকম্যান্ড প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে একেবারেই পছন্দ করছিল না। একে তো মুশারফ-এর মামলা চালানোটা তাদের সামরিক স্বার্থের প্রতিকূল। প্রাক্তন বা সিনিয়র অফিসাররা ইমরান খানকে সমর্থন করেন, কারণ কোনও প্রাক্তন সামরিক জেনারেলকে এ ভাবে অপদস্থ হতে দেখা তাঁদের পক্ষে অবমাননাকর। তবে, সামরিক হাইকম্যান্ড মাঝে মধ্যে এ ভাবে নেতাদের ক্ষমতার বহর পরীক্ষা করে দেখতে চায়, যাকে বলে ‘টেস্টিং দ্য ওয়াটার্স’। ইমরান খানের সমর্থনে যদি সে দিন লক্ষ লক্ষ লোক রাস্তায় নেমে পড়ত, হয়তো ব্যাপারটা অন্য রকম হত। হয়তো মিলিটারি হাইকম্যান্ড-ও অন্য কিছু ভাবত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যখন তাঁর পক্ষে মাত্র হাজার কয়েক লোক দেখা দিল, তার অর্থটাই পাল্টে গেল। মিলিটারি কেনই বা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ চাইবে? সে তো এমনিতেই রাজনীতির অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে, সামনে না এসেই। তাদের হাতে ক্ষমতাটা আছে, কিন্তু কোনও দায় নেই...
সেই ‘দ্বৈতশাসন’-এর মতো, এক দিকে ক্ষমতা। দায় নেই। অন্য দিকে দায়। ক্ষমতা নেই।
ঠিক তাই। সেনাবাহিনী পাকিস্তানে প্রভাবশালী থেকেই যাবে। একমাত্র সময়ের সঙ্গে সঙ্গেই পরিস্থিতির বদল সম্ভব। এই মুহূর্তে পাকিস্তানের গণতন্ত্র প্রবল নড়বড়ে। কিন্তু তার মানে কি এই যে, সেটা এক্ষুনি ভেঙে দেওয়া দরকার? ‘নড়বড়ে’ গণতন্ত্রের মধ্য দিয়েই পাকিস্তানকে গণতন্ত্রের পথে এগোতে হবে। তিরিশ বছরের ইতিহাস তো এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। এই নড়বড়ে গণতন্ত্রকেও অনেকগুলো দশক দিতে হবে, তিরিশ বছর, বা আরও বেশি! তবেই বলতে পারব, পাকিস্তান পারল, না কি পারল না। তার আগে ‘ফেলড্ স্টেট’ বা ব্যর্থ রাষ্ট্র বলে চেঁচামেচি করে লাভ নেই।
ঠিক এই জন্যই, পাকিস্তানকে যে ভাবে দেখা হয়-- হয় সংকটের একটা ‘ব্লক’ হিসেবে, নয়তো একচ্ছত্র ইসলামি প্রতাপের দেশ হিসেবে, তাতে আমার এত আপত্তি। দশকের পর দশক ধরে দেশটা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই, সমানে পাল্টাচ্ছে। আমার বই-এর রাজনৈতিক ন্যারেটিভ এই পাল্টানোর ক্ষেত্রগুলোর উপর জোর দিতে চায়।
চরমপন্থী ইসলামের প্রভাবে কি রাজনৈতিক এস্টাবলিশমেন্ট আরও সংঘর্ষপূর্ণ হয়ে উঠছে?
নিশ্চয়ই। কিন্তু সেটা শুরু হয়েছে তিন দশক আগে, প্রেসিডেন্ট জিয়ার আমল থেকে। জিয়া যখন আফগান মুজাহিদিনদের ব্যাপক ভাবে পুষ্ট করতে শুরু করলেন, তখন থেকেই। তার আগে পাকিস্তান ছিল যথেষ্ট ‘মডারেট’ ইসলামি দেশ। অন্যান্য মুসলিম দেশের সঙ্গে তুলনা করেই কথাটা বলছি। লোকে ভাবে, ধর্মের উপর ভিত্তি করেই পাকিস্তান দেশটা তৈরি হয়েছিল। তাই তার আজকের এই পরিস্থিতি অবধারিত। ১৯৪৭ সালের পর আজকের ইতিহাসের মধ্যে একটা সরলরেখা টানা যায়। সুবিধেমতো ভুলে যাওয়া যায় যে এর মধ্যে এমন অনেক কিছু ঘটেছে যেটা না-ও ঘটতে পারত। অথচ সেগুলো ঘটার ফলেই কিন্তু পাকিস্তান রাজনীতি একটা বিশেষ দিকে চালিত হল, আজকের পরিস্থিতিতে পৌঁছল। তোমাদের দেশের ‘নিউজ অ্যাঙ্কর’-দের এই ইতিহাসটা ঠিক ভাবে বোঝার দরকার, পাকিস্তান বলতে ওদের মাথায় কেবল একটা স্থির, অনড় ধারণা থাকে। ২০০৭-০৮ সালের ঘটনাগুলো মনে আছে? আইনজীবীদের আন্দোলন, বিরোধী নেত্রী বেনজির ভুট্টোর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার বা মেয়েদের অধিকারের দাবি। প্রেসিডেন্ট মুশারফও কিন্তু এক ধরনের মধ্যপন্থা দিয়েই দেশ চালাতেন।