মুসলিম সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় রীতি নমাজ পাঠ।
স্বাধীনতার পর সাত দশক পার করে আজ আমরা ১৭ কোটি ভারতীয়কে স্রেফ তার ধর্ম-পরিচয়ের পরিসরটুকুর মধ্যে গুটিয়ে আনতে পেরেছি। প্রায় প্রতি দিন দেশের কোথাও না কোথাও গণপ্রহারে হত্যা, গোমাংসে নিষেধাজ্ঞা, নাগরিকপঞ্জির মতো আরও সব প্রাতিষ্ঠানিক প্রকরণ দিয়ে দূরে ঠেলে এত দিনে আমরা, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষরা ‘মুসলমান’কে প্রায় অবমানবের পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে ফেলতে পেরেছি। কী খেতে হবে, কী পরতে হবে, কী বলতে হবে, কেমন আচরণ করতে হবে, এমনকি বাচ্চারা বাড়ির বাইরে স্কুলে বা খেলার মাঠে মোসলা, মোল্লা, সন্ত্রাসবাদী, পাকিস্তানি শোনার পরেও কী ভাবে শান্ত থাকবে— এই এখন এক জন ভারতীয় মুসলমানের সর্ব ক্ষণের চিন্তা। অভিজাত, সম্পন্ন, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত সব মুসলমানকে এই একটাই চিন্তা এক কাতারে এনে দাঁড় করিয়েছে। ‘চিন্তা’ কথাটা এখানে এমন একটা মারণ-অবস্থার জন্য লঘু প্রয়োগ হয়ে গেল নিশ্চয়ই। প্রাত্যহিক আতঙ্কের কালো চাদর যেন ভারতের তাবৎ মুসলমানকে ঢেকে ফেলেছে। রাজনীতি ও সংবাদমাধ্যম সর্বদা সমাজের মুখ হিসেবে কয়েক জন মোল্লা-মৌলানাকে সামনে নিয়ে আসে। সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজ সেই প্রতিরূপেই মুসলমানকে দেখতে চায়। অন্য রকম হলেই তাকে শুনতে হয় ‘তোমাকে ঠিক মুসলমানের মতো লাগে না।’ ‘অপরতা’র এই প্রক্রিয়া তাকে প্রতি দিন সমাজের মূলধারা থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে।
‘অপরতা’র ইতিহাসটা দীর্ঘ। তবু মেলামেশা তো ছিল। এক সঙ্গে অনেকটা পথ চলায় তত অসুবিধে ছিল না এত দিন। কিন্তু অবস্থা এখন এতটাই খারাপ যে রক্তক্ষরণ হয়েই চলেছে। ঘৃণার পরিবেশের সবটা সামাজিক সমস্যা নয় বলেই মনে করেন ইংরেজির অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আবুল হাসনাত। বহরমপুরবাসী এই প্রবীণ বলছেন, সমস্যা যত না সামাজিক তার চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক। এই সঙ্কটের সময়েও রাজনৈতিক দলগুলি বিশেষ কিছু করছে না। রাজনীতির সুযোগ নিতেই তারা ব্যস্ত।
রাজ্যের সব চেয়ে বড় খারিজি মাদ্রাসা, বর্ধমানের মেমারি জামিয়া ইসলামিয়ার অধ্যক্ষ কারি শামসুদ্দিন আহমেদ বললেন, ‘‘কখনও ভাবিনি দেশে এই রকম একটা ঘৃণার পরিবেশ তৈরি হবে। আমাদের রাজ্যে ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরেও এমন পরিস্থিতি হয়নি। আসলে রাজনৈতিক দলগুলোর কোনও সদিচ্ছা নেই। তারা এই পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে ভোট গোছাচ্ছে।’’ দূর দূর গ্রাম থেকে আসা ইমাম-মৌলানাদের সঙ্গে তাঁর প্রায় প্রতি দিন কথা হয়। তাঁরাও কম আতঙ্কে নেই। তবে গ্রামের পরিবেশ এখনও যেন অনেকটা ভাল বলে মনে করেন মঙ্গলকোটের হাবিব। কর্মসূত্রে এই তরুণ ব্যবসায়ীর কলকাতায় বাস হলেও গ্রামে তাঁর নিত্য যাতায়াত। কলকাতায় রাস্তা-ঘাটে, ট্রামে-বাসে প্রসঙ্গ ছাড়াই মুসলমানের প্রতি শিক্ষিত মধ্যবিত্তের যে ঘৃণা বর্ষিত হতে থাকে তা রীতিমতো শঙ্কার। ১৯৯২-৯৩ সালে সঙ্কটময় সময়ে মুসলমানরা মঙ্গলকোট বাজারে হিন্দু দোকান বয়কট করতে শুরু করেন। এক উদ্যোগী মুসলিম দু’পয়সা লাভের আশায় একটা মিষ্টির দোকানও খুলে ফেলেন। কিন্তু বহু দিনের পুরনো ময়রার দোকানের মিষ্টির স্বাদ যার মুখে লেগে আছে, মুসলমান মিস্ত্রির রসগোল্লা তার মুখে রুচবে কেন? কিছু দিনের মধ্যেই মিটমাট হয়ে সব স্বাভাবিক হয়ে যায়। আজকেও সে গ্রামে অবস্থা খারাপ নয়। কিন্তু শহরের মানুষের বিবাদ-বিরোধ তো মনের গভীরে, তা মেটাবে কে?
এই ঘৃণার আগুনে ঘি ঢালছে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো। নদিয়ার পলশুন্ডা হাই স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আবদুর রউফ দেখতে পাচ্ছেন, চার পাশে দ্রুত বদলে যাচ্ছে মানুষের শরীরী ভাষা। রাস্তাঘাটে নিরাপত্তার অভাব বোধ হচ্ছে। এত দিনের পরিচিত প্রতিবেশ অচেনা ঠেকছে। একই ভাবে শঙ্কার কথা বললেন লালগোলার বাসিন্দা কথাসাহিত্যিক নীহারুল। তাঁর মনে হচ্ছে, খোলামেলা জায়গাগুলো কমে যাচ্ছে। কাছের বন্ধুরা দূরের হয়ে যাচ্ছে। দেশপ্রেম, জাতীয়তাবোধ এমনকি তাঁর ভারতীয়ত্বও প্রশ্নের সামনে। ট্রেনে বাসে একা রাজ্যের বাইরে যেতে ভয় করে। অথচ নীহারুলের এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। তাঁর মনের মতোই বাড়ির দরজাটাও চিরকাল প্রশস্ত, হাট করে খোলা। এ হেন উদার, মুক্তমনা লেখককে শুধু তাঁর নামের কারণে শঙ্কিত হতে হবে কেন?
মুসলমানের এমনই এক বিকৃত ছবি সোশ্যাল মিডিয়া আর কিছু সংবাদমাধ্যম এঁকে দিচ্ছে, যার ছাঁদে আপামর মুসলমানকে চেনার চেষ্টা করছে সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজ। উপায়হীন একটা সামাজিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে নাগরিক মুসলমান সমাজ আজ কোণঠাসা। তার দায় যেমন এড়াতে পারে না শিক্ষিত হিন্দু সমাজ, তেমনই রাজনৈতিক দলগুলোও। অথচ মুসলমান তো কোনও অনড় একশিলা বস্তু নয়। সে অনেক কিসিমের। ‘ভারতীয় মুসলমান’ অভিধার ছাঁচে ফেলে তাকে একটা গণ্ডিতে বেঁধে ফেলা হচ্ছে। এ দিকে মুসলমান বাহাত্তরটি ফেরকায় (উপসম্প্রদায়) বিভক্ত। তার বাইরেও রয়েছে শরিয়তি ও মারিফতি। তাদের বিস্তর মতভেদ, বললেন আবদুর রউফ। বাংলার সমাজের স্বাভাবিক বাঁধনগুলোই এর ফলে আলগা হতে বসেছে। উত্তরবঙ্গের এক সমাজকর্মী হামিদার অভিজ্ঞতা, ‘‘ভারতীয় মুসলমানের উভয়সঙ্কট। বাইরে বেরোলে ‘জাতীয়তাবাদ’ আমাদের গলায় ঝুলিয়ে ঘুরতে হয়। আর সমাজের ভিতরে একই রকম করে ‘ইসলাম’ গায়ে জড়িয়ে রাখতে হয়। কোনও পক্ষেরই বিন্দুমাত্র সহিষ্ণুতা নেই।’’
এ রাজ্যে যে আমরা বসে রয়েছি সুপ্ত আগ্নেয়গিরির ওপর, তার দায় অবশ্যই সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজকে নিতে হবে। তবে দক্ষিণ ২৪ পরগনায় সোনারপুরের কাছে কয়েকটি স্কুল ও বিএড কলেজের কর্ণধার মুন্সি আবুল কাশেম মনে করেন, মুসলমানের দায়ও কম নয়। তাঁর বক্তব্য, ‘‘সত্তর বছরেও আমরা আমাদের শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার মধ্যে কাউকে ঢুকতে দিইনি। মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থায় অন্য সম্প্রদায়ের ঠাঁই নেই। অথচ খ্রিস্টান মিশনারিদের শিক্ষা তো সবার জন্য। আমরা তা পারিনি। সমান সমান করতে না পারলে সম্প্রীতি হবে না। আর সম্প্রীতি ভিক্ষা করে পাওয়া যায় না, অর্জন করতে হয়।’’ কিন্তু মাদ্রাসায় তো মাত্র চার শতাংশ ছেলে পড়তে যায়! তাঁর কথা, ‘‘সংখ্যাটা বড় বিষয় নয়। মাদ্রাসা ব্যবস্থা আসলে এই সমাজের মনোভঙ্গির প্রকাশ।’’ তিনি সব সম্প্রদায়ের দানের টাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালান। এমন এক মানুষকেও শুনতে হয়েছে আরবের টাকা পাওয়ার অপবাদ।
এই পরিস্থিতিতে রীতিমতো শঙ্কিত প্রখ্যাত মৌলানা এবং ইসলাম ধর্মবেত্তা অশীতিপর গোলাম আহমাদ মোর্তজা। তিনি মনে করেন, এখন যা চলছে তাতে যে কোনও সময় দাঙ্গা লেগে যেতে পারে। তাঁর ভরসা এই বাংলার হিন্দুসমাজের বহু উদার ও মুক্তমনের মানুষদের ওপর, ‘‘তাঁরাই আমাদের ভরসা। কেবল তাঁরাই পারেন আমাদের বাঁচাতে। যেমনটা ঘটেছে অতীতে।’’
কিন্তু আমরা তো দেখছি, মেরুকরণ যত তীক্ষ্ণমুখ হচ্ছে, এই মানুষগুলির সংখ্যা কমছে। মুক্তমনা মানুষ হুমকির মুখে কোণঠাসা হচ্ছেন। নানা ভাবে তাঁদের কাজের পরিসরও সঙ্কুচিত হচ্ছে। তাঁরা অবশ্য থেমে নেই। কাজ চলছে নানা ভাবে। মুসলমান পড়শির সঙ্গে চেনাজানা করার জন্য ‘নো দাই নেবার’ বা ‘টক টু আ মুসলিম’, কত উদ্যোগই তো উদ্ভাবন করছেন সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজের মুক্তমনা মানুষেরা। তা দিয়ে কি কিছু এগোল? না কি তার মধ্যে মুসলমানকে আরও ‘অপরতা’র দিকে ঠেলে দেওয়া হল অজান্তেই? কেন ‘মুসলমান’-এর সঙ্গে কথা? মানুষের সঙ্গে নয় কেন? তা হলে কী ভাবে ‘অপরতা’র গ্লানি মুছে হাত ধরা যাবে পড়শির?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy