Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

টপলেস মসিহা

উরিয়েঃ, কী দিলাম! এর আগে হিট কোটেশন ছিল: হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? আমাকে আদালতে যেই জিজ্ঞেস করল, আমি হিন্দু না মুসলিম, কী উত্তরটি ঝাড়লাম? ‘ভারতীয়।’ দিক-দিগন্ত কাঁপিয়ে পলিটিকাল কারেক্টনেস হাঁপিয়ে প্রকাণ্ড ক্ল্যাপ পড়বে ভেবে চাদ্দিকে তাকিয়ে দেখি, ও হরি, ব্যাটাদের মিনিমাম শিল্প-উসখুসুনিই নেই। বিচারক বললে, ‘ভারতীয়’ কোনও জাত নয়, আপনার জাত কী? আমি কি মচকাই?

শেষ আপডেট: ০৩ মে ২০১৫ ০০:১৫
Share: Save:

উরিয়েঃ, কী দিলাম! এর আগে হিট কোটেশন ছিল: হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? আমাকে আদালতে যেই জিজ্ঞেস করল, আমি হিন্দু না মুসলিম, কী উত্তরটি ঝাড়লাম? ‘ভারতীয়।’ দিক-দিগন্ত কাঁপিয়ে পলিটিকাল কারেক্টনেস হাঁপিয়ে প্রকাণ্ড ক্ল্যাপ পড়বে ভেবে চাদ্দিকে তাকিয়ে দেখি, ও হরি, ব্যাটাদের মিনিমাম শিল্প-উসখুসুনিই নেই। বিচারক বললে, ‘ভারতীয়’ কোনও জাত নয়, আপনার জাত কী? আমি কি মচকাই? ফটাস করে সেকেন্ড প্রগাঢ় সংলাপের ট্রিগার টিপলেম, বললাম, আমি হিন্দুও, আবার মুসলিমও। আমার বাবা মুসলিম, মা হিন্দু। লে, এ বার কী করবি কর। আসমুদ্রহিমাচল ফ্রিজ করে গেল। কী অবিশ্বাস্য গভীর, অসাম অসাম্প্রদায়িক, মানুষের মর্যাদার কথা ভেবে ভেবে ইয়াপ্পি ইনসমনিয়া হয়ে যাওয়া এই প্রজ্ঞা! তবু ব্যাটারা তালি দিলে না। বয়েই গেছে। সমস্ত কাগজে আমার এই তুখড় উপলব্ধির কথা বড়কা বড়কা হরফে। পরের ফিল্মে ঠিক ক্লাইম্যাক্সে নিপুণ সেঁধিয়ে দেব। তখন বক্স অফিস ঝনঝনানির চোটে কোর্টের বেঞ্চির হাড্ডি গুঁড়ো। আরে, অভিনেতার আবার ধর্ম কী? তার ধর্ম মানুষের ভেতরের পরতগুলো উন্মোচন করা। সেটা অতটা না পারলেও, কথায় কথায় শার্ট খুলে ফেলে বাইরের মাসকুলার বডি-টাকে উন্মোচন করা। উফ, কী একখান সিগনেচার বাগিয়েছি বলো তো?

পুরুষশাসিত সমাজে সবচেয়ে সুবিধে পায় কারা? সুন্দরী মেয়েরা। ছোটকা ছোটকা জামা পরে ঘুরবে, কোমর হিলা কে নাচবে, আর লোকে আহা-বাহা পাঁইপাঁই ছুটবে। আমি কী করলাম? উতরোল উত্তেজ-মার্কেটের সঙ্গে সমানে সমানে লড়ে যেতে, বললাম, তুমি যা পারো না, আমি সেও ভি পারি। সেন্সর কিস্যু বলতে পারবে না জেনে, শটে শটে টপলেস হয়ে গেলাম। আমার মা’কে মেরেছিস? টপলেস হয়ে পেটাব। পটলের দাম বেশি নিচ্ছিস? দাঁড়া জামা খুলি, মারব। প্রেম? জামা খুলে গান গাইব। লেঙ্গি? জামা খুলে বিরহে ঝাঁপাব। মহিলাদের তোল্লাই দেওয়ার জমানায়, পুরুষ হয়ে এমন টপলেস বিউটি বারংবার লোকের সামনে এমত টিআরপি-কুড়ানি আইটেমে পরিণত করা মুখের কথা? আই মিন, যে–সে গতরের কথা? শুধু শুধু জিমে যাই না বাবা। ফিলজফি আছে।

অ্যাক্টররা ইন্টারভিউয়ে কী গুল মারে! মুখে হ্যান এক্সপ্রেশন দিলাম, ত্যান এক্সপ্রেশন দিলাম। জিনিসটা কী, তা-ই ভাল বুঝতে পারি না। মানুষ যে পরিস্থিতিতেই পড়ুক, তাকে ভূতেই ধরুক আর সে লটারিই জিতুক, মুখ তো একই রকম থাকবে রে বাবা। কাঠের মতন। তা হলে একটা লোক কী করে তার মনের কথা বোঝাবে? কেন, খালি-গা হয়ে। তার অত বড় গায়ে কি অনেক বেশি এক্সপ্রেশন ধরবে না, নাক-চোখ-ঠোঁটের ভিড়ওলা একটা গোল্লাপানা মুখের তুলনায়? অভিনয়ের জগতে এই আশ্চর্য তত্ত্ব অবধি আমিই এনেছি। কী বলব আমাকে? স্তানিস্লাভস্কির বাবা? আইজেনস্টাইনের মা? গুনে শেষ করতে পারি না, ক’টা অস্কার ডিজার্ভ করি। আর লোকে কিনা অন্য গবাদের অভিনেতা বলে চিল্লায়।

আমার প্রথম কথা, অভিনয়টা লোকে করছে কেন ভাই? নিশ্চয় মানুষের জন্যে। ছাগলের জন্যে তো নয়। তা হলে কে সবচেয়ে ভাল অভিনেতা? সিম্পল: সবচেয়ে বেশি মানুষ যাকে চাইছে। তা, আমার ছবি-প্রতি রেটটা যদি এই মহাদেশে সর্বাধিক এক্সএক্সএল হয়, ধারেকাছে কেউ না থাকে, তা হলে এই দেশের সেরা অ্যাক্টরটা কে হল বাওয়া? কত্ত দেখলাম! ওই যে একটা আছে, ডায়ালগ বলতে পারে না বলে ইচ্ছে করে ডেলিভারির সময় তোতলায়, একটা আবার মেথড-অ্যাক্টর এয়েচে, বাজার ধরতে ন্যাংটো হয়ে অকুস্থলে রেডিয়ো ঢেকে পোজ দেয়, এগুলো অভিনেতা? ছোঃ!

তা ছাড়া কী স্বার্থপর! নিজের টাকায় শুধু নিজে খায়। আর আমি? সেট-এ থুত্থুড়ে বৃদ্ধা দেখা করতে এল, তার দুঃখের পাঁচালি ফোকলা মাড়ি গলে ফুরোতে না ফুরোতে তার নাতিকে আমার কাজে ঢুকিয়ে নিলাম! হরিশ্চন্দ্র এর চেয়ে স্পিডে দান করতে পারতেন? এই ভাবে অন্যের দুঃখে নাগাড়ে চোখের জল ফেলে ফেলে যে লোকটা নিজের টোপলা লালচে গাল দুটো ক্রমাগত ওয়াশ করে নিচ্ছে, তার দিকে কিনা লোকে পাঁক ছোড়ে! অবশ্য যিশুকেও বেইমানি হজম করতে হয়েছে। আমাদের লাক-টাই খারাপ!

সিধে বাত বলি? যদি আমি সব লেভেলে শ্রেষ্ঠ হই, তাইলে আমার কুছ খাস প্রিভিলেজ তো বনতা-ই হ্যায়, তাই না? আমি কোটি টাকা কামাব, কোটি পাবলিকের আইডল হব— আর আমার অধিকারগুলো হবে সাধারণ মানুষের সমান? অ্যাবসার্ড! আমি রামাশ্যামার সঙ্গে লাইন দিয়ে রেশন নেব? না কি, আগে বড়লোকরা যেমন বেড়ালের বিয়ে দিত, গোলাপজলে শৌচ সারত, সেই তুঙ্গে চড়ে, এট্টু নিষিদ্ধ জানোয়ার শিকার করব, ওট্টু বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে ক’টা প্রাণী পিষে দেব? এ তো জলের মতো ব্যাপার, ভাই। তোমার যেগুলো ওয়াও-ফ্যান্টাসি, সেগুলো আমার কাছে পানসে বাস্তব হয়ে, অ্যাক্কেরে বোর! আমায় তো আমার স্ট্যান্ডার্ডের আমোদ খুঁজতে হবে! তাতে যদি সিভালাইজেশনের আপত্তি থাকে, তাকে সে আপত্তি সংবরণ করতে শিখতে হবে! আদালতকে শিখতে হবে আমায় বেকসুর ছেড়ে দিতে। মানুষকে শিখতে হবে, আমি যখন মদ খেয়ে টাট্টু ছোটাব, আমার রাস্তায় পাঁজরা এলিয়ে না ঘুমোতে। আরে, ছুটকোছাটকা দোষের ঠেলায় আমি যদি আজ জেলে যাই, দেশের কী হবে? কে তাকে মস্তি দেবে? কে ম্লান মূক মুখে স্মাইলি টাঙাবে? কে তার পেটের ভুখ ভোলাবে? এই ভেবেই তো আমার হেঁচকি উঠছে। আমি মহান সমাজকর্মী, পরিত্রাতা। শিকারি না ওটা ড্রাইভার ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? কান্ডারি বলো উড়িছে ফানুস, গর্বিত মেগাস্টার! এ তো কমন সেন্স, বোতলের জিন যখন তুফানি-বর দেয়, বেশি ঢক্কন খুলে দেখতে নেই ইয়ার!

লেখাটির সঙ্গে বাস্তব চরিত্র বা ঘটনার মিল থাকলে তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত, কাকতালীয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE