বন্যাবিধ্বস্ত কেরলে উৎসবে মাতিতে পারেন নাই জনসাধারণ। ওনাম কিংবা ইদকে ঘিরিয়া প্রতি বৎসরের ন্যায় জাঁকজমক হয় নাই। তবে যতটা হইয়াছে, তাহাতেই সমগ্র দেশকে পথ দেখাইয়াছেন কেরলবাসী। জানা গেল, প্রবল বর্ষণে প্লাবিত হইয়াছিল ত্রিশূর জেলার কোচুকাড়াভু অঞ্চলের মসজিদটি। ইদ আসিয়াছিল, কিন্তু উপাসনার স্থান ছিল না, তাই সঙ্কটে পড়িয়াছিলেন মুসলমান ধর্মাবলম্বী মানুষ। তাঁহাদের ত্রাতারূপে উপস্থিত হইয়া, আপন উপাসনাস্থল পুরাপ্পুল্লিক্কাভু রত্নেশ্বরী মন্দিরটি ইদের দিন নমাজের জন্য খুলিয়া দিয়াছিলেন ত্রিশূরের হিন্দুগণ। দুর্বিষহ পরিস্থিতির মধ্যেও সহনাগরিকদের তৎপরতায় উপাসনা সম্ভব হওয়ায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়াছেন ধর্মপ্রাণ জনগণ। অপর পক্ষে, দিন কয়েক পূর্বে কেরলেই বন্যাবিধ্বস্ত মন্দির পরিষ্কার করিতে দেখা গিয়াছিল মুসলমানদের। আবার, এই ইদের পূর্বে কোড়ুনগাল্লুরের এক ত্রাণশিবিরে মুসলমানদের হাতে মেহেন্দি আঁকিয়া দিয়াছিলেন খ্রিস্টীয় সন্ন্যাসিনীরা। প্রতিটি ছবিই ভারতের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উদাহরণ হিসাবে চতুর্দিকে ছড়াইয়া দিয়াছিলেন শুভাকাঙ্ক্ষী মানুষ।
ঘটনাপ্রবাহ উদ্দীপনা জাগানোর মতো, তবে বেদনাদায়কও বটে। বেদনা জাগে, এমন ঘটনা কত দুর্লভ সংবাদ তাহা স্মরণ করিয়া। ভারতের দীর্ঘ ইতিহাসে সম্প্রীতিই স্বাভাবিক। অথচ তাহাকে আজ বলপূর্বক স্মরণ করাইতে হইতেছে। সমাজমনোবিজ্ঞানী আশিস নন্দী এক বার লিখিয়াছিলেন, সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে শিরোনামে থাকা অযোধ্যা কিন্তু অতীতে এমন ছিল না। প্রার্থনার উদ্দেশ্যে বাবরি মসজিদে যাইবার সময় বৈরাগীদের অনুরোধে জুতা খুলিয়া রাখিতে হইত নমাজিদের। জুতার দেখভাল করিতেন বৈরাগীরাই। উপরন্তু, নমাজিরা জুতা সংগ্রহ করিতে ফিরিয়া আসিলে, তাঁহাদের হাতে প্রসাদ তুলিয়া দেওয়া হইত। মথুরায় কৃষ্ণ জন্মস্থান মন্দির সংলগ্নে একটি মসজিদ অবস্থান করে। কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের সহিত অবস্থিত জ্ঞানবাপী মসজিদ। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে চলিতে থাকে দুই ধর্মের উপাসনা। সঙ্কট হয় না। ইদানীং, অতি জাতীয়তার কালে এই সকল ঘটনা স্মরণ করা এবং উহাতে শরণ লওয়া আবশ্যক। যাঁহারা দেশের ঐতিহ্য ভুলিয়া সংঘর্ষে মাতিয়াছেন, তাঁহাদের বুঝাইয়া দেওয়া প্রয়োজন, ইহাই ভারত।
সময় সঙ্কটের, সন্দেহ নাই। তাই মন্দির চত্বরে ইদের নমাজের ঘটনা জানিবার পর প্রশ্ন জাগে, ইহা সত্য ঘটনা তো? শুভাকাঙ্ক্ষা জাগাইবার উদ্দেশ্যে ভুয়া প্রচার নয় তো? মনের গভীরে অবিশ্বাস বাসা বাঁধিয়াছে, শুভ ঘটনাও যেন বিশ্বাস করিবার সাহস হয় না। ইতিহাসের আলোকে যাহা এত দিন স্বাভাবিক বলিয়া প্রতীয়মান হইতেছিল, বর্তমানের আলোকে তাহাই যেন কারসাজি ঠেকে। এই অবিশ্বাসময় বাস্তবে দাঁড়াইয়া শুভ ঘটনাগুলি বার বার স্মরণ করা দরকার। কিছু দিন পূর্বে মালয়েশিয়ার গুরুদ্বার সাহিব বেরচাম ইপোতে দেখা গিয়াছিল, এক মুসলমান যুবক উপাসনার জন্য মসজিদ খুঁজিয়া না পাওয়ায়, সহসা শিখ ধর্মস্থান দেখিয়া তাহাতেই প্রবেশ করিয়া নিশ্চিন্তে নমাজ পড়িয়াছেন। এ সব দেখিয়া বলিতে ইচ্ছা করে, অধুনা অবিশ্বাসের বাতাবরণ নির্মিত হইলেও সম্প্রীতিই হইল চিরকালীন বাস্তব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy