Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

গরিবের স্বেচ্ছা বলে কিছু হয়?

রেবেকার জামাটি কোথায় তৈরি হয়েছিল, আমরা জানি না। হয়তো চিনে, হয়তো ভিয়েতনামে, বা হয়তো বাংলাদেশে, রানা প্লাজায়। কিন্তু, ঠিকানার সন্ধান না পেলেও ক্ষতি নেই।

দেবাশিস গুপ্ত
শেষ আপডেট: ০২ মার্চ ২০১৮ ০০:১৯
Share: Save:

বছর কয়েক আগের কথা। ইউরোপের একটা নামকরা পোশাক বিপণির গল্প। সস্তায় ফ্যাশনেবল পোশাক বিক্রিতে তার খ্যাতি। ১৯৬৯ সালে আয়ার্ল্যান্ডের ডাবলিন শহরে ব্যবসা আরম্ভ করেছিল দোকানটি, তার পর ক্রমে পৌঁছেছে অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, জার্মানি, পর্তুগাল, স্পেন, ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ডে। আর কিছু দিনের মধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও ব্যবসা আরম্ভ করবে এই বহুজাতিক সংস্থাটি। ইংল্যান্ডের এক মহিলা, রেবেকা গ্যালাহার, ওই সংস্থার এক দোকান থেকে একটি ফ্লোরাল টপ কিনেছিলেন। সেই পোশাকের ভিতর তিনি এক অপ্রত্যাশিত চিরকুট পেলেন। তাতে লেখা, ‘আমরা অমানুষিক পরিশ্রম করতে বাধ্য হচ্ছি।’ টপের ভিতরে, সঙ্গোপনে, সেলাই করা ছিল বার্তাটি। রেবেকা বলেছেন, চিরকুটটা পড়ার পর থেকে তাঁর ভিতরে এক অন্তহীন দোলাচল আরম্ভ হয়েছে। তাঁর পরিধানের সস্তা পোশাক জোগাতে সত্যিই পৃথিবীর অন্য প্রান্তে কাউকে প্রাণান্ত পরিশ্রম করতে হচ্ছে, ভেবে বিবেকের দংশন হচ্ছে তাঁর।

রেবেকার জামাটি কোথায় তৈরি হয়েছিল, আমরা জানি না। হয়তো চিনে, হয়তো ভিয়েতনামে, বা হয়তো বাংলাদেশে, রানা প্লাজায়। কিন্তু, ঠিকানার সন্ধান না পেলেও ক্ষতি নেই। তৃতীয় বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই কার্যত এক ভঙ্গিতে তৈরি হয় উন্নত দুনিয়ার জামাকাপড়, মোবাইল ফোন, কম্পিউটার থেকে খেলনা। দিনে ১৮ ঘণ্টা পরিশ্রম করে, কারখানার বেসমেন্টে একটা দশ ফুট বাই দশ ফুট ঘরে পনেরো জন ঠাসাঠাসি করে রাত কাটিয়ে চিনের বিভিন্ন কারখানায় যাঁরা তৈরি করছেন আইপ্যাড, তাঁদের মাসের মাইনে, সমস্ত ওভারটাইম সমেত, এতটাই কম যে দু’মাসের মাইনে যোগ করলেও একটা আইপ্যাড কেনা সম্ভব হয় না। কাজের সময় নিজেদের মধ্যে কথা বলা বারণ, দিনে বার তিনেকের বেশি বাথরুমে যাওয়ারও উপায় নেই। ম্যানেজারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করা শ্রমিকদের সাধ্যাতীত। যেহেতু এই কারখানাগুলির বেশির ভাগ কর্মীই মহিলা, তাই নিয়ম করে প্রেগন্যান্সি টেস্ট হয়। এখানে চাকরি করতে হলে গর্ভধারণ নিষিদ্ধ। মাতৃত্বের জন্য কোনও রকম সুযোগসুবিধা দিতে কারখানা রাজি নয়। এই রকম কাজের পরিবেশে আত্মহত্যার ঘটনাও বেশ নিয়মিত। চিনে বহু কারখানাই জাল দিয়ে ঘেরা, যাতে কোনও শ্রমিক জানালা থেকে বাইরে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা না করতে পারেন।

তবুও, এই কারখানাগুলিতে কাজ করতেই হত্যে দিয়ে পড়ে থাকেন বহু, বহু মানুষ। কেন, সেই কারণ বুঝতে অর্থনীতিবিদ হওয়ার প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশের যে মেয়েরা গারমেন্টস কারখানায় কাজ করেন, অত্যন্ত কষ্টকর পরিবেশেও, তাঁদের কাছে সেটাই সেরা বিকল্প। প্রথম বিশ্বের তুলনায় নামমাত্র বেতনও তাঁদের দেশের প্রেক্ষিতে অনেক। আর কোনও কাজ করে এই পরিমাণ উপার্জন করা তাঁদের পক্ষে অসম্ভব। বাজার অর্থনীতির যুক্তি বলবে, কারখানায় কাজ করতে চেয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রত্যেকটি মানুষ ব্যয়-লাভের হিসাব কষেই এই কাজ করতে এসেছেন। অন্যত্র কাজ করলে সে কাজের সঙ্গে বেতনের যা তুল্যমূল্য হিসাব, তার তুলনায় গারমেন্টস কারখানায় লাভ বেশি বলেই না তাঁরা কাজ করতে এসেছেন এখানে। আগের তুলনায় ভাল থাকতে পারছেন। আর, রানা প্লাজায় দুর্ঘটনার মতো বিপদ? ভবিষ্যতে যাতে এমন না ঘটে, তার জন্য সতর্ক হওয়া অবশ্যই প্রয়োজন, কিন্তু তার বেশি কথার দরকার কী?

মানুষ ব্যয়-লাভের হিসাব কষে সবচেয়ে লাভজনক বিকল্প হিসাবেই গারমেন্টস কারখানাগুলিকে বেছে নিচ্ছে, এটা যে নেহাত কুযুক্তি, তা বলে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। মানুষ বাছছে ঠিকই, কিন্তু একে চয়নের স্বাধীনতা বলার কোনও কারণ নেই। বাকি বিকল্পগুলি এমনই দারিদ্রের, এমনই মারাত্মক যে সেগুলিকে বেছে নেওয়া আর স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করার মধ্যে খুব পার্থক্য নেই। ফলে, পরিস্থিতিই মানুষকে বাধ্য করে এমন অমানবিক পরিবেশের কারখানাকেও বেছে নিতে। এটা তাঁদের বাধ্যবাধকতা।

কিন্তু, এটুকু বলে থেমে গেলে আরও বড় একটা প্রশ্ন অধরাই থেকে যাবে। যে কোনও কর্মক্ষেত্রে যে কোনও শ্রমিক নিজের শ্রম বিক্রি করতে যান। তার বিনিময়ে মজুরি বুঝে পান। শ্রমের বাজারে এই বিনিময়ের প্রথাটি সিদ্ধ। এখানে শ্রমিক বিক্রেতা, কারখানার মালিক ক্রেতা। কিন্তু ভিয়েতনাম থেকে বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া থেকে চিন, তৃতীয় বিশ্বের প্রায় সব দেশের আউটসোর্সিং-এর কারখানায় বিনিময় শুধু এটুকুতে থেমে থাকছে না। কারখানার মালিক, মজুরির বিনিময়ে, কার্যত শ্রমিকের সত্তা কিনে নিচ্ছেন। তাঁর সামাজিক মেলামেশার অধিকার, শারীরিক প্রয়োজন, মাতৃত্ব থেকে জীবনের নিশ্চয়তা, সবই মালিকের আয়ত্তাধীন হচ্ছে। এই শ্রমের বাজারে নিজেকে— শুধু শ্রম নয়, সম্পূর্ণ নিজেকে— বিক্রি করা ছাড়া শ্রমিকের উপায়ান্তর নেই। কারখানার যন্ত্রপাতি যেমন, ঠিক তেমনই শ্রমিকরাও মালিকের সম্পত্তিতে পরিণত হচ্ছে। অর্থাৎ, শ্রমের বাজারে শুধু শ্রম নয়, শ্রমিক নিজেই পণ্য। এমন পণ্য, যার নিয়ন্ত্রণের অধিকার আর শ্রমিকের হাতে নেই, মালিকের হাতে।

একে কি স্বেচ্ছা-বিনিময় বলা চলতে পারে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Labour Poverty Market Product
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE