‘টেনশন ঠাকুর’-এর বেদিতে হু হু করে বাড়ছে ভক্তসংখ্যা।—নিজস্ব চিত্র।
আরও এক দেবতার আবির্ভাব হইল। কোচবিহারের মেখলিগঞ্জে দেখা দিয়াছেন ‘টেনশন ঠাকুর’। নামেই মাহাত্ম্যের পরিচয়। উদ্বেগ প্রশমিত করা আর মানুষের আয়ত্তে নাই, তাহার জন্য প্রয়োজন দেবতার কৃপা। কিন্তু সকল দেবতা কি সেই আশ্বাস লইয়াই আসেন না? মণ্ডপে দুর্গা দুর্গতিনাশিনী, লক্ষ্মী গৃহস্থের সম্পদ রক্ষায় নিযুক্তা। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইবার আশ্বাস লইয়া আসেন সরস্বতী, ব্যবসায় ক্ষতি হইতে রক্ষায় গণেশ ভক্তের পূজা পান। বিপদ হইতে বাঁচাইবার জন্যই নির্দিষ্ট দেবী রহিয়াছেন, নাম বিপত্তারিণী। কিন্তু বিপদ অল্প নহে। নির্দিষ্ট বিপত্তি হইতে বাঁচিতে নির্দিষ্ট দৈবশক্তি সন্ধান করিতে চায় মানুষ। তাই সুন্দরবনে ভরসা বনবিবি, সর্পদংশন এড়াইতে মনসা, বসন্ত রোগ হইতে বাঁচাইতে শীতলার আবির্ভাব। নূতন নূতন প্রয়োজনে নূতন নূতন দেবদেবীর কল্পনা, যদিও মর্যাদা বাড়াইতে প্রাচীনত্বের দাবি করিয়া থাকেন ভক্তেরা। কলেরার নিরাময় লইয়া গবেষণাকালে চিকিৎসক শম্ভুনাথ দে অনুসন্ধানে জানিয়াছিলেন, ওলাবিবি বা ওলাইচণ্ডী বস্তুত আবির্ভূতা হন ঔপনিবেশিক যুগে। শহরের শৌচ ও নিকাশি ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে তখন কলেরা মহামারির আকার লইয়াছিল। যশোর জেলা হইতে নিম্নবেগ বুঝাইতে ‘ওলা’ শব্দটির আমদানি, এবং অচিরে কলিকাতায় ওলাদেবীর আবির্ভাব। নিতান্ত হাল আমলে ‘সন্তোষী মাতা’ জুড়িয়াছেন তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর তালিকায়, একটি জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের কল্যাণে। উদ্বেগের কারণের শেষ নাই, তাই নিত্যনূতন অবতারে দেবতা অবতীর্ণ।
সংবাদে প্রকাশ, মেখলিগঞ্জ হইতে ময়নাগু়ড়ি যাইবার পথে জল্পেশ রোডের ধারে প্রতিষ্ঠিত ‘টেনশন ঠাকুর’ কর্মহীনদের গতি। এই উদ্বেগ হইতে মুক্তি দিবার জাগতিক আশ্বাসও অবশ্য মিলিয়াছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পূর্বে নরেন্দ্র মোদী যুবসমাজের প্রশিক্ষণ এবং কর্মসংস্থান তৈরি করিবার প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন। দুর্ভাগ্য, ভারতবাসী তাহার খুব বেশি নিদর্শন দেখিতে পায় নাই। রাজ্য সরকার কি নূতন শিল্প নির্মাণ ও কর্মে নিয়োগে গতি আনিয়াছে? বাংলার বাসিন্দারা তাহা অনুভব করিতে পারে নাই। রাজ্যের জেলাগুলি হইতে বিপুল সংখ্যক মানুষ শ্রম বিক্রয় করিতে অন্যান্য রাজ্যে যাইতেছে। অবৈধ ঠিকাদারের উপর নির্ভর করিয়া, পরিবারকে অনিশ্চয়তায় রাখিয়া ভিনরাজ্যে যাত্রা স্বভাবতই উদ্বেগের। সীমান্ত জেলাগুলিতে বাংলাদেশ হইতে নানা পণ্যের পাচারচক্র কাজ করিতেছে। সে কাজে সর্বদাই জীবনের ঝুঁকি, জেল-জরিমানা নিয়মিত হইয়া থাকে। জীবিকার উদ্বেগে শ্রম-নির্ভর মানুষ যে দৈবের আশ্রয় খুঁজিবে, তাহাতে আশ্চর্য কী?
সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে দেবতার আরাধনার গতিপ্রকৃতি দেখিলে আরও একটি বোধ জন্মায়। বহু লৌকিক দেবদেবী দরিদ্র মানুষের আরাধ্য হইয়া আবির্ভূত হন। দৈবশক্তির প্রচারের সহিত দেবতার অবস্থানেরও ঊর্ধ্বগতি হইতে থাকে। গাছতলার ঘরোয়া আসনটি ছাড়িয়া বিগ্রহের প্রতিষ্ঠা হয় মর্মর-মন্দিরে। প্রভাতের ফুল-দূর্বা, বিকালের প্রদীপ হইতে শুরু হয় স্নান-ভোগদান-আরতির ঘটা, পুরোহিত ও পান্ডাদের আধিপত্য। কিছু দিন পরে দেখা যায়, পাথর হইতে পুনরায় রূপ পাইয়াছেন এক অন্তরঙ্গ ঈশ্বর। ভক্তের উদ্বেগ মিটাইতে তাঁহার আবির্ভাব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy