নতুন করে। যোগেন্দ্র যাদব। লখনউ। ছবি: পিটিআই।
কয়েক দিন আগে কলকাতায় এসেছিলেন যোগেন্দ্র যাদব। দিল্লির সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব ডেভেলপিং সোসাইটিজ-এর শিক্ষক, লোকনীতি সংস্থার পরিচালক, সুপরিচিত ভোটবিজ্ঞানী, সুবক্তা ও আম আদমি পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এই মানুষটিকে লোকে ইদানীং চেনে আপ-এর বিদ্রোহী এবং বহিষ্কৃত নেতা হিসেবে। কয়েক মাস আগেও, বিকল্প রাজনীতির মাধ্যম হিসেবে আপ-কে গড়ে তোলায় প্রয়াসী যোগেন এখন ফের বেরিয়েছেন বিকল্প রাজনীতির সন্ধানে, ‘স্বরাজ অভিযান’-এ। আপাতত নাগরিক সমাজের বিবেকী সদস্যদের নিয়ে একটি বিকল্প মঞ্চ গড়ে তোলার লক্ষ্যে দেশের নানা প্রান্তে ঘুরে মানুষের সঙ্গে কথা বলছেন তিনি, সেই কারণেই এ বার বাংলা তথা কলকাতায় আসা।
আপ-এর পুরনো মোহ-ভাঙা কর্মী, সাধারণ মানুষ, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক, নানা গোষ্ঠীর মানবাধিকার-কর্মিকুল যোগেনের সঙ্গে সারা দিন মনখোলা ‘বাতচিত’ (সংলাপ বা বার্তালাপ বললে একটু বেশি ভারী শোনায়) চালালেন, যেখানে যোগেন মুখ্যত মনোযোগী শ্রোতা, মাঝে মাঝে বক্তা, ফের শ্রোতা। এই সূত্রেই অনিবার্য ভাবে উঠে এল গণতন্ত্রের প্রসঙ্গ।
রাজনৈতিক ব্যবস্থায় গণতন্ত্র
গণতন্ত্র কাকে বলে, এ নিয়ে প্রাচীন গ্রিক সমাজ থেকে হাল-আমল অবধি আকাদেমিক ও সাধারণ চর্চায় কৌতূহল ও কুটকচালির অন্ত নেই। কিন্তু অন্তহীন সংজ্ঞার জঙ্গলে খেই হারিয়ে না ফেলে, গণতন্ত্রকে আমরা বুঝতে চেষ্টা করতে পারি তার ব্যবহারিক রূপ দেখে। সাম্প্রতিক পুর-ভোট, বা অদূর-অতীতের লোকসভা ভোট দেখে মনে হতে পারে, গণতন্ত্র হল মনোনয়ন জমা দেওয়া, প্রতিশ্রুতি ও প্রচার, নির্বাচনী বুথ, ভোটারদের লাইন, পরিচয়পত্র পরীক্ষা, ভোটদান, ফলপ্রকাশ ও সবশেষে বিজয়ীদের সরকার/বোর্ড গঠন। কিন্তু অনেকেই এই বিবরণ মানবেন না। বলবেন, এ হল আদর্শ বা পাঠ্যপুস্তকে লেখা বর্ণনা। এবং এ বারের ও বিগত বেশ কয়েক দশকের নির্বাচনের নিরিখে বলবেন, এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে ভোটার লিস্টে কারচুপি, দিন ঘোষণার পর থেকে হিংসা ও সন্ত্রাসের চড়তে থাকা পারদ, ভোটের দিন বুথ-জ্যাম, জাল ভোট, রিগিং, ছাপ্পা ভোট, বোমাবাজি, গোলাগুলি, প্রশাসনিক পক্ষপাত, রক্তপাত, লাশ এবং (প্রয়োজনে) নির্বাচন-পরবর্তী ঘোড়া কেনাবেচা।
একটু তলিয়ে ভাবলে বোঝা যাবে, উপরে বলা ব্যবহারিক গণতন্ত্রের দুটি উদাহরণই (আদর্শ ও ফলিত) ভোট-কেন্দ্রিক। ভোটের সঙ্গেই গণতন্ত্রের এই ধারণার শুরু ও শেষ। গণতান্ত্রিক অধিকার বলতে এখানে মুখ্যত নিরপেক্ষ প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে শান্তিপূর্ণ ভাবে পছন্দসই প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার অধিকারের কথাই বোঝানো হচ্ছে। অর্থাৎ, মানুষের যা কিছু দায়দায়িত্ব বা অধিকার, তার শুরু ও শেষ এই ভোটপ্রক্রিয়া ঘিরেই। এই ধারণার বিপরীত একটি তাত্ত্বিক ধারণা আছে। সেটা এই েয, আমাদের মতো উত্তর-ঔপনিবেশিক দেশে ভোটকেন্দ্রিক গণতন্ত্র হল নৈতিক বোধম্পন্ন নাগরিক সমাজের প্রান্তে তথা বিপরীতে থাকা ‘পলিটিক্যাল সোসাইটি’র (‘শাসিত’) মানুষদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন সরকারি আর্থিক বা প্রশাসনিক উদ্যোগ তথা পলিসি-র বিনিময়ে, এ-সব দিতে সক্ষম ‘শাসক’দের বেছে নেওয়ার রাজনীতি। এই দৃষ্টি অনুযায়ী, আমাদের হালফিলের গণতন্ত্রের ভিত্তি, নাগরিক সমাজের উচ্চ নৈতিকতা নয়, উপরে বর্ণিত শাসিতের রাজনীতি। এই শাসিতেরা গণতন্ত্রের উচ্চ আদর্শের পতাকাবাহী সিটিজেন বা নাগরিক নয়, তারা জীবনধারণের চৌহদ্দির মধ্যে আটকে থাকা পপুলেশন বা জনসমষ্টি।
পলিটিক্যাল সোসাইটি-র ধারণাভিত্তিক শাসিতের রাজনীতি হয়তো সাম্প্রতিক ভোটকেন্দ্রিক গণতন্ত্রের হালহকিকত অনেকটা বর্ণনা করে, কিন্তু তাত্ত্বিক ভাবে তাদের আত্মসত্তা কেড়ে নিয়ে তাদের শাসন-পারঙ্গম শাসক গোষ্ঠীগুলির চির-অধীন করে রাখে। যদি তথাকথিত শাসিত বা নিম্নবর্গীয়দের এই অবস্থাকে তাদের অলঙ্ঘ্য বিধিলিপি বলে না মানি, তবে গণতন্ত্র সম্পর্কে কিছু মৌলিক ধারণার পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে। গণতন্ত্র কেবল ভোটসর্বস্ব কিছু বে-আইনি আচারব্যবহার নয়, তা প্রাত্যহিক অনুশীলন বা চর্চার বিষয়। ফলে, ভোটপ্রক্রিয়া মিটে গেলেই, এমনকী পরম শান্তিপূর্ণ ভাবে মিটে গেলেও, তার চর্চা শেষ হয়ে যায় না, বরং শুরু হয়। বিশেষ করে স্থানীয় সরকারের— পুরসভা বা পঞ্চায়েতের— স্তরটি এই চর্চার আদর্শ ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে।
প্রশ্ন হল, স্থানীয় সরকারের ঠিক কোন স্তর গণতন্ত্র চর্চার আওতায় আসবে? সংবিধানের ৭৩ ও ৭৪তম সংশোধনের পর কিন্তু, অন্তত প্রাতিষ্ঠানিকতার দিক থেকে, এ ব্যাপারে কোনও সংশয় নেই যে, গ্রামে গ্রাম-সভা আর পুরসভায় ওয়ার্ড কমিটি হল গণতন্ত্র চর্চার সেই মৌলিক স্তর। সাধারণ মানুষের সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের এটাই সেরা ফোরাম। বছরে কমপক্ষে দু’বার গ্রাম-সভা আর ওয়ার্ড কমিটির অধিবেশন ডাকা বাধ্যতামূলক। এদের ক্ষমতা যদিও মুখ্যত পরামর্শমূলক, তবু, ঠিক মতো চললে তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের কারণে, সেই সব পরামর্শের সবটাই নির্বাচিত বোর্ড সহজে হেলাফেলা করতে পারে না। এখান থেকেই ঘটতে পারে বিকল্প রাজনীতির সূত্রপাত। শান্তি বজায় রেখেও, যতটা সম্ভব দলনিরপেক্ষ থেকে, অঞ্চলের সুশাসন সম্পর্কিত তথ্যঋদ্ধ আলাপ-আলোচনা, সেমিনার প্রভৃতির আয়োজন মতের আদানপ্রদানের সহায়ক হতে পারে। এ কথা ঠিক, এই রাজ্যের অন্য ক্ষেত্রগুলির মতোই, গ্রাম-সভা আর ওয়ার্ড কমিটিও সর্বৈব দলনিয়ন্ত্রিত। কিন্তু যদি দৈনন্দিনতায় গণতন্ত্র চর্চা করতে হয়, এমনকী প্রতিরোধ গড়তে হয়, তবে পাঁচ বছর পরের নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা না করে, এখান থেকেই শুরু করতে হয়।
রাজনৈতিক সংগঠনে গণতন্ত্র
এই বিকল্প গণতন্ত্র চর্চার জন্যও চাই বিকল্প রাজনৈতিক সংগঠন। একটি রাজনৈতিক দল বা সংগঠন সমাজ-রাজনীতির নানা স্তরে গণতন্ত্রের প্রসার ঘটাবে এবং নিজস্ব সংগঠনেও কোনও অগণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা উঠতে দেবে না, এটা কী করে সম্ভব হতে পারে? গণতন্ত্রকামী মানুষ বিগত দেড় শতাব্দী ধরে নানা দেশে এর খোঁজ চালিয়ে গেছে। কিন্তু দেখা গেছে, বার বার সে ঠকেছে। আমাদের জাতীয় কংগ্রেসের মতো একদা ঢিলেঢালা মঞ্চও আজ চলেছে হাইকম্যান্ডের অঙ্গুলিহেলনে। আর বিশ্বের তাবড় কমিউনিস্ট দল ১৯০২-এর রুশ রাজনৈতিক বাস্তবতার ওপরে ভিত্তি করে লেখা লেনিনের ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান’ পড়ে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার এমন ফলিত প্র্যাক্টিস শিখেছে যে গণতন্ত্রকে টা-টা বলে কেন্দ্রিকতাকেই আঁকড়ে ধরেছে। এ সত্য পরমাণু চুক্তির প্রশ্নে প্রথম ইউপিএ সরকারের থেকে দলের সমর্থন প্রত্যাহার করার সূত্রে বঙ্গজ কমিউনিস্টরা ছাড়া আর ভাল কে জানে!
বিকল্প রাজনীতির প্রতিশ্রুতি দেওয়া শিশু-পার্টি আপ-এর মধ্যে এই প্রবণতা এমন প্রকট হয়েছে যে ইয়েট্সকে স্মরণ করে বলতে ইচ্ছা করে, ‘...দ্য বেগারস্ হ্যাভ চেঞ্জড প্লেসেস, বাট দ্য ল্যাশ গোজ অন’। আপ-এর বিষয়ে যোগেনের মতো হতাশ অনেকেই জানতে চেয়েছেন, আগামী দিনে যোগেন ও তাঁর সহযোগীদের ঘিরেও, এমন প্রশ্ন উঠবে না তো! এর একশো ভাগ সুনিশ্চিত সদুত্তর কারও পক্ষেই দেওয়া অসম্ভব। বোধহয় এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতা থেকেই মানুষ এমন নিশ্চিতি খোঁজে। কিন্তু গণতন্ত্রের চর্চাটা তো একটা চিরন্তন প্রক্রিয়া: অনেকটা গ্রিক পুরাণের সিসিফাসের পাথর ঠেলার মতোই। দেবতার অভিশাপে এক পাহাড়ের খাদ থেকে একটা বড় বোল্ডার উপরে ঠেলে নিয়ে যাওয়াই তার নিয়তি। কিন্তু যত বার সে পাথরটা ঠেলে একেবারে উপরে নিয়ে যায়, আবার তা গড়িয়ে নেমে আসে। সিসিফাসের কাজ কখনও ফুরোয় না!
শ্রীচৈতন্য কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy