Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

ধর্ষণ করো, ছবি তোলো, পাঠিয়ে দাও

মোবাইল থেকে মোবাইল, ল্যাপটপ থেকে পামটপ ‘রেপ ভিডিয়ো’ ছড়িয়ে গেলেও, ধর্ষণকারীদের চেনা গেলেও পরোয়া নেই। ধর্ষিতা অভিযোগ জানাতে গেলেই যে পুলিশ ফিরিয়ে দেয়, সে ভিডিয়ো দেখে তৎপর হবে?দু’টো ছেলে মেয়েটার পা চেপে ধরে আছে। এক জন তার মুখ চেপে মাথার কাছে বসে। চতুর্থ জন ওই অবস্থায় মেয়েটাকে ধর্ষণ করছে। মেয়েটা আপ্রাণ চিৎকারের চেষ্টা করছে। আতঙ্কে যন্ত্রণায় তার চোখ দু’টো ঠেলে বেরিয়ে আসছে। পঞ্চম পুরুষটি মোবাইলে ভিডিয়ো তুলে রাখছে। প্রায় সাড়ে চার মিনিটের ভিডিয়োয় ধর্ষিতার পাশাপাশি ধর্ষক এবং তার সহযোগীদের মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৯ জুন ২০১৫ ০০:০৯
Share: Save:

দু’টো ছেলে মেয়েটার পা চেপে ধরে আছে। এক জন তার মুখ চেপে মাথার কাছে বসে। চতুর্থ জন ওই অবস্থায় মেয়েটাকে ধর্ষণ করছে। মেয়েটা আপ্রাণ চিৎকারের চেষ্টা করছে। আতঙ্কে যন্ত্রণায় তার চোখ দু’টো ঠেলে বেরিয়ে আসছে। পঞ্চম পুরুষটি মোবাইলে ভিডিয়ো তুলে রাখছে। প্রায় সাড়ে চার মিনিটের ভিডিয়োয় ধর্ষিতার পাশাপাশি ধর্ষক এবং তার সহযোগীদের মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। অশ্লীল মন্তব্য করে হাসতে-হাসতে, পিকনিকের মেজাজে তারা ক্যামেরার সামনে ‘কাজ’ শেষ করছে।

দ্বিতীয় ভিডিয়োর দৈর্ঘ্য প্রায় সাড়ে আট মিনিট। পাঁচ জনে মিলে একটি মেয়েকে একের পর এক ধর্ষণ করছে। ষষ্ঠ এক জন ছবি তুলছে। বীরবিক্রমে ক্যামেরার সামনে আঙুল তুলে ‘ভিকট্রি’ দেখাচ্ছে তারা, পোজ দিচ্ছে, চুটকি বলে হেসে গড়িয়ে যাচ্ছে। এক জন যখন ধর্ষণ করছে অন্যদের কয়েক জন তখন হস্তমৈথুন সারছে ক্যামেরার দিকে মুখ করে। এ ছবি এমএমএস হয়ে পৌঁছে যাচ্ছে লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে, তাদের একটা বড় অংশ সে সব ছবি শেয়ার করছে, লাইক দিচ্ছে!

সুনীতা কৃষ্ণন ঠান্ডা গলায় বলে যাচ্ছিলেন, ‘একেই বলে ‘রেপ ইন্ডাস্ট্রি।’ ধর্ষণ করো, ক্যামেরায় তুলে রাখো, অশ্লীল ছবির বিশ্ববাজারে চড়া দামে বিক্রি করো। মজা হল, টাকাও। মোবাইল থেকে মোবাইল, ল্যাপটপ থেকে পামটপ সে ছবি ছড়িয়ে গেলেও, ধর্ষণকারীদের চেনা গেলেও পরোয়া নেই। গোয়েন্দারা চোখে ঠুলি বেঁধে ঘুরবেন। ধর্ষিতা নিজে অভিযোগ করতে গেলেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পুলিশ হেনস্থা করে, অভিযোগ নিতে চায় না, ভিডিয়ো দেখে নিজেরা উদ্যোগী হয়ে কেস শুরু করার প্রশ্নই নেই। কেউ লিখিত অভিযোগ জানালে পুলিশ ভেবে দেখলেও দেখতে পারে।’

টাকা রোজগার ছাড়া অবশ্য আরও কিছু কারণ থাকতে পারে রেপ ভিডিয়ো তুলে রাখার পিছনে। এক শ্রেণির ধর্ষক বন্ধুবান্ধবদের ওই ছবি দেখিয়ে কৃতিত্ব জাহির করে: ‘দেখো আমি কেমন শক্তিধর পুরুষ, একটি মেয়ের দেহকে ডলেপিষে দখল ও ভোগ করলাম।’ আবার এই ভিডিয়ো হাতে থাকলে মেয়েটিকে ব্ল্যাকমেল করা যায়। ভয় দেখিয়ে পুলিশে যাওয়া থেকে নিরস্ত করা যায়। এমনকী যখন খুশি ডেকে পাঠিয়ে বার বার ধর্ষণ করা যায়। দেশের নানা অঞ্চলে এমন কীর্তির অন্তত কয়েকশো নজির আছে।

হায়দরাবাদের মেয়ে সুনীতাকেও পনেরো বছর বয়সে আট জন মিলে ধর্ষণ করেছিল। বহু লড়াইয়ের পর জীবনে ফিরেছেন তিনি। হায়দরাবাদে ‘প্রোজ্জ্বলা’ নামে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা চালান। ধর্ষিতা এবং পাচার হয়ে যাওয়া মেয়েদের নিয়ে কাজ করেন। তাঁর এক বন্ধু হোয়াটসঅ্যাপ-এ ভিডিয়ো দু’টো পেয়ে বিচলিত হয়ে ফরওয়ার্ড করেন। দেখার পর কয়েক ঘণ্টা মাথা কাজ করেনি সুনীতার। বলছিলেন, ‘কত ক্ষণ জানি না চুপ করে বসে থাকার পর মনে হল, এটা নিয়ে কিছু না করলে আমার নিজের উপর ঘেন্না হবে। সে দিন সারারাত ধরে দু’টো ভিডিয়ো কাটছাঁট করে দেড় মিনিটের দু’টো ক্লিপ তৈরি করলাম। ধর্ষিতাদের মুখগুলো ঝাপসা করে ধর্ষকদের মুখগুলো বেশি করে হাইলাইট করে দিলাম। দু’টোই ইউটিউবে আপলোড করলাম। শুরু হল আমার ‘শেম দ্য রেপিস্ট’ আন্দোলন।’

ইউটিউবে সুনীতা সবাইকে অনুরোধ করলেন, ভিডিয়োয় যে ধর্ষকদের দেখা যাচ্ছে তাদের কেউ চিনতে পারলে যেন দয়া করে তাঁকে জানান। কয়েক দিনের ভিতর এক জন ধর্ষকের পরিচয় চিহ্নিত করে এগারো জন তাঁকে মেল করেন। স্থানীয় পুলিশের সাইবার সেলে একটি অভিযোগও দায়ের করেছিলেন সুনীতা। পুলিশ এসে ভিডিয়ো ক্লিপ দু’টো তদন্তের জন্য নিয়ে যায়। এর পর বেশ কিছু দিন চেষ্টা করে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে দেখা করে সব জানান। কিন্তু এক জনও ধরা পড়ছিল না। শেষে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন সুনীতা। শীর্ষ আদালত ধর্ষকদের ধরার জন্য সিবিআইকে নির্দেশ দেওয়ার পর ওড়িশার এক জমি-বাড়ির ব্যবসায়ী ও তার এক সহযোগী গ্রেফতার হয়। তাদের জেরা করে জানা যায়, পাঁচ বছর আগে একটি মেয়েকে ধর্ষণ করার সময় ওই ভিডিয়ো তুলেছিল তারা। এই পাঁচ বছর অসংখ্য মানুষের কাছে ওই ভিডিয়ো পৌঁছেছে। তা সত্ত্বেও ওই ধর্ষকেরা খুল্লমখুল্লা ঘুরে বেড়িয়েছে।

সুনীতার আন্দোলন সম্পর্কে ইতিমধ্যে অনেকেই জেনেছেন, তাঁর হাতে বিভিন্ন জায়গা থেকে এই রকম আরও ভিডিয়ো ক্লিপ এসে পৌঁছেছে। সেগুলিও তিনি আদালতে জমা দিয়েছিলেন। প্রত্যেকটির তদন্তই আদালত সিবিআইয়ের হাতে দেয়। প্রতিটি ভিডিয়োয় যে ধর্ষকদের দেখতে পাওয়া গিয়েছে তাদের কেউ চিনতে পেরে ধরিয়ে দিলে এক লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে বলে ঘোষণা করেছে সিবিআই। কিন্তু এই কাহিনি অন্যরকম মোড় নেয় এর পরে। কেস চলতে-চলতেই এই রকম আরও প্রায় ৯৫টি রেপ-ভিডিয়ো এসে পৌঁছোয় সুনীতার হাতে। সুপ্রিম কোর্টে সুনীতার আইনজীবী সে কথা জানান। যা শুনে উদ্বিগ্ন বিচারপতি জানান, এই ভাবে কি এ সমস্যার মোকাবিলা সম্ভব? কেন্দ্রের অতিরিক্ত সলিসিটার জেনারেলের কাছে তিনি জানতে চান, ‘রাজ্যগুলির সাইবার সেল তা হলে কী করছে?’

প্রশ্ন হল, ভিডিয়োগুলি যখন বহু লোকের নাগালেই রয়েছে, ধর্ষকদের দেখাও যাচ্ছে, পুলিশের সাইবার সেল বা সিবিআই কেন নিজে থেকে তদন্ত শুরু করবে না? এই ধরনের অপরাধ দমনে কেন আলাদা টাস্ক ফোর্স থাকবে না? কেন এমন পরিকাঠামো থাকবে না যাতে এমন অপরাধের কথা জানতে পারলে যে কোনও নাগরিক সহজে অভিযোগ দায়ের করতে পারেন? এ সব ভিডিয়ো হাতে এলে মানুষ অনেক সময় পুলিশকে জানাতে চাইলেও নিজের পরিচয় গোপন করতে চান। সে ক্ষেত্রে লালবাজারে, ভবানী ভবনের মতো জায়গায়, থানায় থানায় আলাদা সেল থাকা উচিত, যেখানে নাম গোপন করেও মানুষ ভিডিয়ো জমা দিতে পারেন। প্রামাণ্যতা যাচাই করে পুলিশকে তদন্ত করতে হবে। যে ধর্ষকদের মুখ দেখা যাচ্ছে তাদের ছবি বড়-বড় করে শহরের সর্বত্র এবং নামী সংবাদপত্রে দেওয়া উচিত। এরা যে ধর্ষণ করেছে সেটা জানানো উচিত এবং ছবির তলায় এদের খুঁজে দিলে কত টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে সেটাও লিখে দেওয়া উচিত। হোয়াটসঅ্যাপ এবং ইউটিউবের পরিচালকদের সঙ্গে প্রশাসনের চুক্তি করা উচিত যাতে এই ধরনের ভিডিয়ো সেখানে দেখা গেলে গোয়েন্দারা সঙ্গে সঙ্গে জানতে পারেন।

কলকাতা পুলিশের যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (অপরাধ) পল্লবকান্তি ঘোষ জানান, যে কোনও থানায় বা লালবাজারে সাইবার ক্রাইম বিভাগে বা মহিলা সেলে ক্লিপ জমা দিয়ে অভিযোগ করা যায়, তবে অভিযোগকারীর নাম গোপন রাখার ব্যবস্থা নেই। অনেকে তো থানাপুলিশের ঝামেলা এড়াতে নাম গোপন রাখতে চাইতে পারেন? পল্লববাবুর বক্তব্য, ‘‘সে ক্ষেত্রে তাঁরা অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন না। এটাই নিয়ম।’’ সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচরপতি তথা রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান অশোক কুমার গঙ্গোপাধ্যায় এ কথা শুনে বললেন, ‘‘বিষয়টা যখন এতটা মারাত্মক তখন রাজ্যে অন্তত কোনও একটি জায়গায় তো নাম গোপন করে এই ধরনের নথি জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করা উচিত। তা ছাড়া, থানায় গিয়ে যে অভিযোগ দায়েরের কথা বলা হচ্ছে, অনেক থানা তো ধর্ষণের অভিযোগ-ই নিতে চায় না। তারা রেপ ভিডিয়োর অভিযোগ জমা নেবে এবং তার ভিত্তিতে দ্রুত অ্যাকশন নেবে, সে নিশ্চয়তা পুলিশকর্তারা দিচ্ছেন তো?’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE