গ্রাফিক- তিয়াসা দাস।
সভ্যতার অগ্রগমনের সহিত বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রটিও বিস্তৃত হইতেছে। সনাতন বিষয়ের গণ্ডি অতিক্রম করিয়া ভারতীয় বিদ্যায়তনগুলি আজ নূতন পরিসরে ভাবিতে শিখিয়াছে। এক কালে রাজনীতির পৃথক পাঠ্যক্রম ছিল না। পরে অর্থনীতি ও রাষ্ট্রনীতির গর্ভ হইতে জন্মগ্রহণ করে রাষ্ট্রবিজ্ঞান। ইহার বহু কাল পরে রাষ্ট্রবিজ্ঞান হইতে সমাজতত্ত্বের জন্ম। ইদানীং কলাবিদ্যা চর্চার ক্ষেত্রে এই পরিসরগুলি ছাপাইয়া ইন্টারডিসিপ্লিনারি স্টাডিজ়ে উৎসাহ দেখা যাইতেছে। ‘উইমেন’ হইতে ‘পিস অ্যান্ড কনফ্লিক্ট’— সব ধরনের পাঠ দেওয়ার বন্দোবস্ত হইতেছে। সমাজকে জানিতে গেলে তাহার প্রতিটি দিককে চিনিয়া লওয়া আবশ্যক। সুতরাং, ভারতীয় সমাজের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বধূ হইয়া উঠার কর্তব্যটিই বা কী রূপে বাদ থাকে? বধূ সুশীলা হইল কি না, সমাজের সব নিয়ম মানিল কি না, পরিবারের ঐতিহ্যের সহিত সুর মিলাইল কি না— নারীর এই সকল পদক্ষেপ মাপিতে বসে সমাজ। নারীর কার্যকলাপ চির দিনই সমাজের মাথাব্যথা। সুতরাং, সেই ব্যথা দূর করিবার নিমিত্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হইলে তাহা সামাজিক সঙ্কট দূরীভূত করিবার দৃষ্টান্তমূলক প্রয়াস। দারিদ্র থাকুক, বৈষম্য থাকুক, তবু বধূ খাঁটি হইলে সনাতন ভারতের ধর্মটি অক্ষুণ্ণ থাকে।
সমাজের এই প্রয়োজনীয় দায়িত্বটি উত্তম রূপে বুঝিয়াই আদর্শ গৃহবধূ হইয়া উঠিবার প্রশিক্ষণে একটি স্বল্প সময়ের কোর্স চালু করিয়াছে ভোপালের বরকাতুল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যটিও স্পষ্ট জ্ঞাপন করা হইয়াছে— নারীর ক্ষমতায়ন। সত্য! নারীকে যদি আদর্শ বধূরূপে দিনাতিপাত করিতে হয়, তাহা হইলে ক্ষমতার প্রয়োজন বইকি! পুরুষের ন্যায় দৈনন্দিন জীবনসংগ্রাম তো আছেই, উপরি পাওনা পারিপার্শ্বিক চাপ। উদ্দেশ্য অনুরণিত হয় উপাচার্যের কণ্ঠে— নারীরা যাতে সমস্ত মানুষকে মানিয়া লইতে এবং সকল পরিস্থিতিতে মানাইয়া লইতে পারেন, তাহা শিখাইয়া দেওয়াই পাঠ্যক্রমের লক্ষ্য। এহ বাহ্য। পুঁথিগত বিদ্যা অসার, অতএব জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে সমাজের কর্তব্য-দায়িত্বের ভার লইতে পারিলে তবেই তাহা প্রকৃত শিক্ষা। পরিবারকে গ্রথিত করিবার দায় নারীর হইলে বধূবিদ্যা কোর্সের কার্যকারিতা লইয়া প্রশ্ন থাকিতেই পারে না। অর্থনীতিতে অর্থ আসে নাই, সমাজতত্ত্বে সমাজে সুস্থিতি আসে নাই, বধূবিদ্যায় আদর্শ বধূ নির্মিত হইলে তাহা জ্ঞানজগতে নূতন দিগন্ত উন্মোচন করিবে।
তবু দুর্জনের প্রশ্ন, বরকাতুল্লা বিশ্ববিদ্যালয় কি পুরুষতান্ত্রিকতার নির্লজ্জ দৃষ্টান্তই স্থাপন করিতেছে না? সংসারের জাঁতাকলে নারীদের পেষণ করিবার যে চিরাচরিত রীতি, তাহাকে কি মান্যতা দিবে না কোর্সটি? বধূপন্থীরা গোসা করিয়া বলিয়াছেন, চাকুরিজীবী হইবার আকাঙ্ক্ষা যদি সম্মাননীয় আইডেন্টিটি হয়, তবে বধূ হওয়া পরিহাসের বস্তু হইবে কেন? হইবে। কারণ, বধূ হইয়া উঠা আবশ্যক রূপেই চাকুরিজীবী অপেক্ষা পৃথক। সেই কারণেই চাকুরির প্রশিক্ষণের পাশাপাশি স্বামী হইয়া উঠিবার শিক্ষার ব্যবস্থা নাই। পুরুষতন্ত্র নারীকে কেবল নারীরূপেই চিহ্নিত করে, মানুষের আইডেন্টিটি দেয় না। লেখাপড়া শিক্ষার্থীকে সব চেয়ে জরুরি যে শিক্ষাটি দেয়, তাহা সমাজকে প্রশ্ন করিবার অধিকার। যাহা অন্ধ ভাবে সমাজের নিয়ম মানিয়া চলিবার শিক্ষা দেয়, তাহা কেবল পশ্চাতে টানিবার উপকরণ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy