Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
মমতার উত্তরসূরি? উত্তর খুব সহজ নয়

উত্তরণের পরে অভিষেক

যারা বড় দল, ক্ষমতায় থাকে বা ক্ষমতার কাছাকাছি পৌঁছে যায়, বিশেষ করে তাদের ক্ষেত্রে ওই প্রক্রিয়ার গুরুত্ব অপরিসীম।

দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১৫ জুন ২০১৮ ০১:০৩
Share: Save:

ইদানীং অনেকের মুখেই প্রশ্ন শুনছি, অভিষেক কি আগামী দিনের মুখ্যমন্ত্রী? প্রশ্নটি আরও জোরালো হয়েছে তৃণমূলের শীর্ষনেতাদের সাম্প্রতিক কিছু মন্তব্যে, যাঁরা প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছেন তরুণ সাংসদ এবং যুব তৃণমূল সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় দলের ভবিষ্যৎ কান্ডারি। সংগঠনে তাঁর গুরুত্ব এবং অবস্থান যে কিছুটা আলাদা, সেই বাস্তবতা ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত। তাই পোশাকি ব্যাখ্যায় যতই ‘যৌথ নেতৃত্ব’-এর কথা বলা হোক, দুইয়ে দুইয়ে চার করলে দল তথা সরকারের পরবর্তী ‘মুখ’ হওয়ার দৌড়ে অভিষেককে এগিয়ে রাখা হচ্ছে বললে হয়তো খুব ভুল হবে না।

যে কোনও দলেই নেতা-নেত্রী হিসেবে কাউকে তুলে ধরা একটি বৃহৎ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অঙ্গ। যারা বড় দল, ক্ষমতায় থাকে বা ক্ষমতার কাছাকাছি পৌঁছে যায়, বিশেষ করে তাদের ক্ষেত্রে ওই প্রক্রিয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। তার পিছনে কাজ করে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম নানা বিবেচনা। সেখানে ঘাটতি বা ভুলচুক হলে ফল ভুগতে হয়। কারণ চূড়ান্ত বিবেচনায় যিনি কান্ডারি, দলের ভাগ্যলিপি লিখতে হয় তাঁকেই। সাফল্য, ব্যর্থতা সব কিছুর দায় তাঁর।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের একটি বড় সুবিধা হল, এই দলটি শূন্য থেকে তাঁর হাতে গড়া। নিরন্তর আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মানুষের আস্থা অর্জন করে দু’দশকের মধ্যে দলকে তিনি রাজ্যে শাসন ক্ষমতায় বসিয়েছেন, জাতীয় রাজনীতিতে প্রবল ভাবে প্রাসঙ্গিক করে তুলতে পেরেছেন। প্রশংসা-নিন্দা-সমর্থন-বিরোধিতা সব কিছু ছাপিয়ে এটা মানতেই হবে, তৃণমূল আজ যে উচ্চতায় পৌঁছেছে তার সবটাই মমতার অবদান। তাই আজও রাজ্যে ৪২টি লোকসভা বা ২৯৪টি বিধানসভা আসনে মমতাকে সামনে রেখে প্রার্থীরা কার্যত ছায়াযুদ্ধ করেন। জিতলে মমতা জেতেন, হারলেও মমতাই হারেন! এই দলে তিনিই সর্ব অর্থে শেষ কথা।

একটি রাজনৈতিক দলের ‘সাবালক’ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে এই পরিস্থিতি কত দূর ‘স্বাস্থ্যসম্মত’ তা নিয়ে তর্ক থাকতেই পারে। কিন্তু তাতে মমতার দলের কিছু যায়-আসে না। তৃণমূলের ভোটারদেরও নয়। তাঁরা জানেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই এখানে একমাত্র স্থায়ী আমানত। বাকি সব লিকুইড ক্যাশ!

এটা অবশ্য দলের একটি অসুবিধাও বটে। মমতাকে ঢাল না করে দল কিছু ভাবার বা করার ‘সাহস’ দেখাতে পারে না। তৃণমূল ভবনের পদাধিকারীরা বা নবান্নের মন্ত্রীরা জানেন,
যে কোনও স্খলন-পতন-ত্রুটিতে মমতা সব সামলে দেবেন। যে কোনও কিছুতে তাঁর অনুমোদন তাই অপরিহার্য।

এ হেন একটি দলের শীর্ষস্তরে রদবদলের জল্পনা যখন আলোচনার টেবিলে চলে আসে, তখন তাকে উপেক্ষা করা চলে না। বিশেষত, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, সুব্রত বক্সির মতো দায়িত্বশীল উঁচুতলার তৃণমূল নেতারা এ নিয়ে মুখ খোলার পরে বিষয়টি নেহাত কথার কথা বলে উড়িয়ে দেওয়া ভুল। বরং সেই সম্ভাবনার দিকগুলি নিয়ে ভেবে দেখা প্রয়োজন।

তবে অভিষেক রাজ্যের ভাবী মুখ্যমন্ত্রী কি না, সেই গবেষণার আগে ভাবতে হবে তেমন কোনও পরিস্থিতি কি সত্যিই আসন্ন? আরও সহজ কথায় বললে, মমতার কি মুখ্যমন্ত্রিত্ব ছেড়ে অন্য কোনও দায়িত্বে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে? স্বয়ং অভিষেক সে দিন বলেছেন, ২০১৯-এ মমতাকে প্রধানমন্ত্রী করার জন্য তৃণমূলকে শপথ নিতে হবে। এই নিষ্পাপ ইচ্ছার আড়ালে একটি কামনা কিন্তু স্পষ্ট। মমতার দল তাঁকে প্রধানমন্ত্রী দেখতে চায়।

এই চাওয়া দোষের কিছু নয়। উত্তরণই তো বাঞ্ছনীয়। উচ্চাকাঙ্ক্ষা রাজনীতিকের স্বাভাবিক ধর্ম। কেউ মুখে স্বীকার করুন বা না করুন, মনের গভীরে সেটা থাকবেই। অপেক্ষাও থাকবে উপযুক্ত সুযোগের। মমতার সামনে প্রধানমন্ত্রিত্বের সুযোগ যদি আসে, তবে, শুধু তাঁর দল নয়, বাঙালিও গর্ব করার জায়গা পাবে। যেমন পেয়েছিল প্রণব মুখোপাধ্যায় রাষ্ট্রপতি হওয়ায়।

কিন্তু রাজনীতির গতিপথ প্রায়শই বক্র। অনিশ্চিতও বটে। সোজা আঙুলে ঘি উঠলে সেই রাজনীতির হয়তো বিশেষ দাম নেই! ২০১৯-এর ভোটের দিকে তাকিয়ে কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদীর বিকল্প সন্ধানে এখন যে হিসাবনিকাশ চলছে, তাতে মমতার ভবিতব্য কোথায় গড়াবে, কে জানে! সোজা আঙুল বাঁকালে কার কপালে ঘি জুটবে, কেউ কি জোর দিয়ে এখনই তা বলতে পারে?

মমতা অবশ্য সব সময় বলে থাকেন, তিনি কোনও গদির মোহে চলেন না। যা করেন, তা বৃহত্তর জনস্বার্থে। তবু সময়ের দাবিতে কখন কী করতে হয়, সেটা তৃণমূল নেত্রীর চেয়ে ভাল আর কে জানেন! তাই তাঁর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুদূরপ্রসারী সম্ভাবনা জিইয়ে রেখেই রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রীর উত্তরসূরি নিয়ে ভাবনাচিন্তার কারণ রয়েছে।

অভিষেক মমতার পরিবারের সন্তান। তৃণমূলের বরিষ্ঠ নেতা পার্থবাবু ঠিকই বলেছেন, আজন্ম বাড়ির মধ্যে মমতাকে দেখে, তাঁর জীবনচর্যা, লড়াই এবং রাজনীতিকে সামনে রেখে অভিষেক বড় হয়েছেন। বিদ্রোহী নেত্রী মমতা ও শাসক মমতা দু’জনেই তাঁর খুব চেনা। নেতৃত্বের স্বাভাবিক প্রবণতায় নিজেকে রপ্ত করে তুলতে অভিষেকের তাই অসুবিধা হয়নি। এবং, পরিবারতন্ত্রের ছকে বাঁধা কটাক্ষ সয়েও দল তাঁকে সেই মর্যাদা দিতে শুরু করেছে।

চার বছর আগে মমতা যে দিন অভিষেককে সরাসরি লোকসভার প্রার্থী করেন, সে দিনই ইঙ্গিত ছিল— তাঁর মধ্যে সম্ভাবনার বীজ পুঁতে দিতে চান তৃণমূলের প্রতিষ্ঠাত্রী। মমতার মূল উত্থান যেমন শুরু হয় লোকসভার সাংসদ হওয়া থেকে, অভিষেকেরও তা-ই। তফাত হল, মমতা সাংসদ হওয়ার বহু আগে থেকেই সক্রিয় ভাবে রাজনীতি করেছেন। কংগ্রেসের ছাত্র, যুব, এমনকি ট্রেড ইউনিয়নেও সাধারণ কর্মী হয়ে কাজ করেছেন। সেখান থেকে ধাপে ধাপে তিনি শীর্ষ নেতৃত্বে পৌঁছেছেন। অভিষেকের সূচনা এবং উত্থান সবই তুলনায় দ্রুত। তিনি প্রত্যক্ষ রাজনীতি শুরুই করেছেন তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে। ২০১২-তে তৃণমূল যুব কংগ্রেসের সমান্তরাল ‘যুবা’ নামে একটি সংগঠন তৈরি হয়। তখন সদ্য পঁচিশের অভিষেক হন তার সভাপতি। তৃণমূল যুব কংগ্রেসের দায়িত্ব নেওয়ার আগে এটা ছিল প্রথম ধাপ। ২০১৪-য় তিনি সাংসদ হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে ‘যুবা’র অস্তিত্ব লোপ হয়। থাকে শুধু যুব তৃণমূল। সেই থেকেই অভিষেক যুব তৃণমূলের সভাপতি। আজও তিনি তা-ই।

নিজের উপস্থিতি এবং স্বাতন্ত্র্য জানান দিতে প্রথম থেকেই কোনও রাখঢাক নেই অভিষেকের। দলের অন্দরে নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ প্রকাশে তিনি অকৃপণ। তাই মুকুল রায় যখন তৃণমূলে প্রবলপ্রতাপান্বিত, তখনও অভিষেক তাঁর প্রতি বিরাগ জানাতে কুণ্ঠিত হননি। যুব সংগঠনকে নিজের মতো করে সাজাতে তিনি তাঁর ঘনিষ্ঠদের বেছে নিয়েছেন অবলীলায়। কে কী বলল, কার ‘ভাবমূর্তি’ নিয়ে কী প্রশ্ন উঠল, পরোয়া করেননি কোনও কিছুর। ২০১৬-র মন্ত্রিসভা যে দিন শপথ নেয়, সে দিন শহর ছেয়ে গিয়েছিল অভিষেকের ছবি-সহ ‘ম্যাচ উইনার’ হোর্ডিংয়ে। কেন, তা নিয়ে ঘরে-বাইরে বিতর্কও ছড়ায়। অভিষেক গায়ে মাখেননি। এ বার পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রার্থী তালিকা থেকে শুরু করে পুরো প্রক্রিয়ায় অভিষেকের ভূমিকা এবং প্রভাব নজর এড়ায়নি।

অনেকের মতে, কোনও সিদ্ধান্ত ঠিক বা ভুল যা-ই হোক, বিতর্ক তুচ্ছ করে নিজের দাপটে অনড় থাকা নেতৃত্বের একটি উল্লেখযোগ্য লক্ষণ। নড়বড়ে হলে লোকের কাছে ভুল বার্তা যায়। সেটা দুর্বলতা। নেতৃসুলভ নয়। অভিষেক ‘দুর্বল’ হতে নারাজ।

কিন্তু নেতার অপর গুণ হল, সকলকে নিয়ে মানিয়ে চলা। যেখানে ‘ভয়’ দিয়ে জয় করতে হয় না, মমতায় কাছে টানতে হয়। তার সঙ্গে চাই নিরন্তর জনসংযোগ। দুই ক্ষেত্রেই মমতার জুড়ি মেলা ভার। অভিষেকের সামনে এটা কিন্তু বড় পরীক্ষা। কান্ডারি হয়ে হাল ধরার আগে তাঁকে সেই পরীক্ষাতেও সফল হতে হবে। মমতার উত্তরসূরি যিনিই হোন, এই গুণটা আয়ত্ত করা তাঁর পক্ষে বড্ড জরুরি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Abhishek Banerjee mamata banerjee TMC
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE