Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
প্যাশন প্লে দেখার অভিজ্ঞতা থেকে কবির এক অ-সামান্য সৃষ্টি

বিকল্প এক জিশুগাথা

খ্রিস্টানদের ধর্মীয় অনুষঙ্গে প্যাশন শব্দের দ্যোতনা: ইহুদি-পুরোহিতের চক্রান্তে মানবজীবনের শেষ কয়েক দিন জিশুর ওপর নেমে আসা চূড়ান্ত নির্যাতন, আর তার করুণ পরিণতি। এ সবই নাট্যাকারে উপস্থাপিত হয় প্যাশন প্লে-র মাধ্যমে। 

সোমেশ্বর ভৌমিক
শেষ আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:১৭
Share: Save:

উনসত্তর বছর বয়সে দীর্ঘ পাশ্চাত্য-সফরের ধকল আর ব্যস্ততার মধ্যে জার্মানির মিউনিখ শহরে ১৯৩০ সালের ২৩ জুলাই কবি সারা রাত জেগে ফিল্মের জন্য নতুন টেকনিকে নাটক লিখেছেন— জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের তৎকালীন সচিব অমিয় চক্রবর্তী ২৬ জুলাই লেখা চিঠিতে। স্নেহভাজন পরিচালক হিমাংশু রায়ের অনুরোধে জার্মান প্রযোজনা সংস্থা ইউএফএ-র কাছে পেশ করার জন্যে লেখা হলেও এই চিত্রনাট্য থেকে কোনও ছবি তৈরি হয়নি। কালক্রমে রবীন্দ্রনাথের মৌলিক ইংরেজি রচনা দ্য চাইল্ড, আর সেটির বাংলা রূপান্তর শিশুতীর্থ জন্ম নিয়েছিল চিত্রনাট্যটি থেকে। রবীন্দ্র-জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, বাভারিয়ান জনপদ ওবেরআম্‌মারগাউ-তে ২৩ জুলাই সারা দিন জিশুখ্রিস্টের জীবনান্তকালীন ঘটনাবলি অবলম্বনে তৈরি প্যাশন প্লে দেখার ‘অনুপ্রেরণা’য় তৈরি হয়েছে ব্যতিক্রমী রচনা। অনেকেই সমর্থন করেছেন এই মত। কিন্তু, ‘অনুপ্রেরণা’য় কি থাকে না সমর্থন-ভিত্তিক সদর্থক ব্যঞ্জনা? অথচ প্যাশন প্লে-র নাট্যটা কবির চিত্রনাট্য বা তার রূপান্তরগুলির সঙ্গে মিলিয়ে পড়লে খটকা লাগে।

খ্রিস্টানদের ধর্মীয় অনুষঙ্গে প্যাশন শব্দের দ্যোতনা: ইহুদি-পুরোহিতের চক্রান্তে মানবজীবনের শেষ কয়েক দিন জিশুর ওপর নেমে আসা চূড়ান্ত নির্যাতন, আর তার করুণ পরিণতি। এ সবই নাট্যাকারে উপস্থাপিত হয় প্যাশন প্লে-র মাধ্যমে।

ওবেরআম্‌মারগাউ-তে প্যাশন প্লে-র অভিনয় শুরু হয়েছিল ১৬৩৪ সালে, প্লেগ মহামারি থেকে রক্ষা পাওয়ার মানত হিসেবে। তখন থেকে দশ বছরের ব্যবধানে এই ভক্তিনাট্যের অভিনয় হয়ে আসছে, যার মহলাই চলে পাঁচ বছর ধরে।

যে অভিনয় রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন, সেই নাট্যের কাঠামোটি তৈরি হয়েছিল উনিশ শতকের পঞ্চাশের দশকে, দু’জন যাজকের হাতে, নিউ টেস্টামেন্টে বর্ণিত শিশুর জীবনকাহিনি বা গসপেল অবলম্বনে। গড্‌স স্পেল, যার আক্ষরিক অর্থ ঈশ্বরের মহিমা, তারই অপভ্রংশ গসপেল। নিউ টেস্টামেন্টের চারটি ভাষ্যের চারটি আলাদা গসপেল আছে (সেন্ট ম্যাথিউ, সেন্ট মার্ক, সেন্ট ল্যুক এবং সেন্ট জন প্রণীত)। সেন্ট জন-এর গসপেলের সঙ্গে ওবেরআম্‌মারগাউ-এর প্যাশন প্লে-র মিল থাকলেও ইহুদি পুরোহিত, তাদের আশ্রয়দাতা বা অনুগামীদের কীর্তিকলাপের বর্ণনা যেন বাকি তিনটি গসপেল থেকে খুঁজে বার করে ঢোকানো হয়েছে।

ওবেরআম্‌মারগাউ-এর প্যাশন প্লে এক ট্র্যাজিক মেলোড্রামা। এখানে মন্দ মানুষরা ভাল মানুষের কাজে বিঘ্ন ঘটায়, তাদের মানসিক ও শারীরিক ভাবে বিপর্যস্ত করে। শেষ পর্যন্ত ভাল মানুষদের আদর্শের জয় হলেও সে জয় আসে এক বা একাধিক জীবনের মূল্যে। এ নাট্যে মন্দ মানুষরা সবাই স্বার্থান্বেষী ইহুদি, বিশেষত প্রতিপত্তি হারাবার ভয়ে ভীত পুরোহিতচূড়ামণি কাইফাস, পুরোহিত আনাস, অত্যাচারী রাজা হেরদ, বিশ্বাঘাতক জুদাস ইসকারিয়ত এবং পুরোহিততন্ত্রের অন্ধ অনুগামী জনতা, যারা জিশুর রক্তদর্শন করতে চায়। ইহুদি হওয়া সত্ত্বেও ভাল মানুষ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন জিশু, তাঁর ভক্ত অনুগামী আর শুভাকাঙ্ক্ষীর দল, যাঁদের মধ্যে আছে মেরি নামের দুই নারী, প্রথম জন জিশুর মা, অন্য জন মেরি ম্যাগডালেন। কয়েকটি রোমান চরিত্রও আছে, বিশেষ করে রোম সম্রাট অগাস্টাসের সার্বভৌম প্রতিনিধি পন্টিয়াস পিলাত আর তাঁর সেনাপতি। কিন্তু নাটকের ভাষ্য অনুযায়ী, তাঁরা ইহুদি-পুরোহিততন্ত্রের সামনে অসহায়।

অথচ এই পালা দেখে ফিরে রাত জেগে হোটেলের প্যাডের কাগজেই ফিল্মের জন্য নতুন টেকনিকে যে নাটক লিখেছিলেন কবি, তার মেজাজ তাঁর দেখা বাভারীয় মেজাজের চেয়ে অনেকটাই আলাদা। কবির চিত্রনাট্যের শুরুতে যে অভিযাত্রার কথা বলা হয় সেটির মেজাজ, শিষ্য-সহ জিশুর জেরুসালেম অভিযানের মেজাজের সঙ্গে মোটেই তুলনীয় নয়। তাঁর জেরুসালেম অভিযানের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইহুদি পুরোহিততন্ত্রের বিরুদ্ধাচরণ। এ রকম কোনও নির্দিষ্ট সংঘাতের পূর্বাভাষ রবীন্দ্রকাব্যে নেই। সেখানে বরং আছে বিপর্যস্ত, অন্ধকারাচ্ছন্ন মানবসমাজের ছবি। সেই অন্ধকার থেকে আলোর খোঁজে এগিয়ে চলে যাত্রীদল, কোনও এক অমৃততীর্থের দিকে। ধর্মীয় লক্ষ্যের চেয়ে সেখানে বড় হয়ে ওঠে উদার মানবিকতার সন্ধান। যাত্রীদলের নেতাকে কবি চিহ্নিত করেছেন ভক্ত হিসেবে। অস্থির মানবসমাজকে তিনি দিতে চান অমৃতের সন্ধান। কিন্তু প্যাশন-প্লে’র মতো এখানে তিনি নায়ক নন। এই ভাবে গসপেল প্রভাবিত প্যাশন-প্লে’র গণ্ডি থেকে প্রথমেই নিজের দূরত্ব তৈরি করে নেন কবি।

চিত্রনাট্য যত এগোয় ততই স্পষ্ট হয়ে ওঠে এটির ভিন্ন মেজাজ। এটা ঠিক যে, জিশুর অনুগামীদের যে বর্ণনা আমরা গসপেলে (বা প্যাশন-প্লে’তে) পাই, চিত্রনাট্যে নামহীন ভক্তের অনুগামী হিসেবে আমরা তাদেরই দেখি। কিন্তু এমন তো নয় যে এ রকম মানুষ কোনও একটি বিশেষ সমাজে বা বিশেষ কালেই দেখা যায়। যুগ যুগ ধরে এমন মানুষের দুর্দশাতেই ভারী হয়ে আছে পৃথিবীর ইতিহাস। কিন্তু জনসমষ্টির মধ্যে থেকে কয়েক জনকে প্রধান চরিত্র হিসেবে বেছে নিয়ে কাউকে ভাল আর কাউকে মন্দ হিসেবে চিহ্নিত করে তিনি কোনও মেলোড্রামা তৈরি করেননি, তৈরি করেননি ভাল-মন্দের কোনও নাটকীয় দ্বান্দ্বিকতা। জুদাস ইসকারিয়তের বিশ্বাসঘাতকতার দীর্ঘ এবং নাটকীয় বর্ণনা আছে ওবেরআম্‌মারগাউ-এর প্যাশন প্লে’তে। তার তুলনায় চিত্রনাট্যে সন্দিহান এক তরুণ অনুগামীর হাতে ভক্তের নিহত হওয়ার বর্ণনা নিতান্ত সংক্ষিপ্ত এবং অ-নাটকীয়। এটা যেন নিছক দুর্ঘটনা। আততায়ী স্বভাবত বিশ্বাসঘাতক, হিংস্র এবং নিষ্ঠুর— এমন কোনও ইঙ্গিত নেই, যেমন আছে প্যাশন প্লে’র নাট্যে। দুষ্কৃতীর দুর্দশা ও তজ্জনিত তাৎক্ষণিক চিত্তবিক্ষেপকেই দুষ্কর্মের জন্য দায়ী করেন তিনি, চরিত্রগত কোনও নীচতাকে নয়। আর প্যাশন প্লে-র ক্ষেত্রে যা অপরিহার্য সেই প্যাশনের বর্ণনা (জিশুর যন্ত্রণাভোগ, মৃত্যু ও পুনরুত্থানের যোগফল) দূরে থাক, তার উল্লেখও চিত্রনাট্যে নেই।

চিত্রনাট্যের অষ্টম পরিচ্ছেদ থেকেই টেস্টামেন্ট বিধৃত কালানুক্রম ভেঙে দিয়ে এক বিকল্প জিশুগাথা তৈরি করতে থাকেন রবীন্দ্রনাথ। প্যাশন প্লে’র শেষ দু’টি দৃশ্যে উপস্থাপিত হয় গসপেল বর্ণিত পুনরুত্থানের দৃশ্যবলি। কিন্তু কবি তাঁর চিত্রনাট্যের শেষ তিন পরিচ্ছেদে অনুসরণ করেছেন জিশুর জন্মকালীন ঘটনাবলি বিষয়ে গসপেলের বর্ণনা। খ্রিস্টীয় অনুষঙ্গ মেনেই রচনা করেছেন পূর্বদেশীয় জ্ঞানীদের (‘মেজাই’) নেতৃত্বে সদ্যোজাত জিশুর অনুসন্ধানের বিবরণ। দিগ্‌দর্শক তারার সঙ্কেত মেনে যাত্রীদল গিয়ে দাঁড়ায় পর্ণকুটিরের সামনে। সেখানে মায়ের কোলে শুয়ে থাকা ছোট্ট শিশুটিকেই চিহ্নিত করে মানুষের পরিত্রাতা হিসেবে। রবীন্দ্রনাথের চিত্রনাট্যে নবজাতকের আবির্ভাবই মূল বিষয়। ফলে যে চিত্রনাট্যের অনুপ্রেরণা হিসেবে প্রচারিত হয়েছে ‘ইস্টার স্পিরিট’-এর ধারক প্যাশন প্লে’র কথা, সেখানে ঢুকে পড়ল ক্রিসমাস স্পিরিটের ছায়া! ইস্টার স্পিরিটে আছে এক নিখাদ করুণরস— ত্যাগ, তিতিক্ষা, সংযম আর প্রায়শ্চিত্তের ভাব। ক্রিসমাস স্পিরিটে আছে সুখ ও শুভ-র প্রতীক্ষাজাত অনাবিল আনন্দ। খ্রিস্টীয় চেতনায় পরস্পরবিরোধী না হলেও এদের মেজাজ আলাদা। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু তাঁর চিত্রনাট্যে এই দূরত্ব ঘুচিয়ে দিয়েছেন।

গসপেল-ভাষ্যকে ব্যবহার করে প্যাশন প্লে দর্শককে কেবলই ঠেলে দিতে চায় নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে। কিন্তু এ হেন প্যাশন প্লে দেখার পরেও রবীন্দ্রনাথ জীবনান্তকালীন যন্ত্রণার বর্ণনায় আটকে না থেকে পুনরুত্থান-সংক্রান্ত গসপেল-ভাষ্যকে তাঁর মরমি মন দিয়ে পুনর্নির্মাণ করলেন সারা রাত জেগে। সৃষ্টিশীলতার এ এক অনবদ্য উদাহরণ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Christmas Tale Jesus
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE