Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

নীরেনদার মুখোমুখি হলেই মনে হত মাস্টারমশায়

শব্দের জাদু দেখানোর বিশেষ জাদুকাঠি থাকে কারও কারও হাতে। কুশলী প্রাজ্ঞজনের সংখ্যা কমছে যে! লিখছেন সেবন্তী ঘোষএমন সব্যসাচীকে তাঁর কীর্তির জন্যই মনে রাখা প্রয়োজন। যাঁরা অতি নিকটজন শবানুগমনের সময় ব্যক্তি মানুষটিকেই তাঁরা খুঁজবেন। আমরা, তাঁর পাঠকরা তাঁকে চিরজীবনই জানব। আরও একটা কারণে যেতে দ্বিধা হয়েছে। দীর্ঘ সময় যোগাযোগ রাখিনি। যাচ্ছি-যাব করে যাওয়া হয়নি। তবে আজ আর কেন?

শেষ আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৪:৫৫
Share: Save:

ফ্যানটম-কে যে অরণ্যদেব নামে চিনি, তার ঘোড়াকে তুফান, আর টিনটিনের স্নোয়িকে কুট্টুস-এ—সে তো কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর নামকরণ।

‘অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদের’ মতো ‘ফিসফিসে কুঞ্জবনে’ তাঁর দীর্ঘদেহ, দীর্ঘায়ু ও সচল মস্তিষ্ক দিয়ে এতকাল আমাদের আগলে রেখেছিলেন। চতুর্দিক থেকে বাংলা সাহিত্যকে ভরিয়ে তুলেছিলেন। যা আমাদের অনেকেরই জানা। আজ যখন তাঁর বাড়ি বাঙ্গুর বা মেয়ে বা ছেলের বাড়ির কাছাকাছি বসেই খবর পেলাম, যেতে মন সরল না।

এমন সব্যসাচীকে তাঁর কীর্তির জন্যই মনে রাখা প্রয়োজন। যাঁরা অতি নিকটজন শবানুগমনের সময় ব্যক্তি মানুষটিকেই তাঁরা খুঁজবেন। আমরা, তাঁর পাঠকরা তাঁকে চিরজীবনই জানব। আরও একটা কারণে যেতে দ্বিধা হয়েছে। দীর্ঘ সময় যোগাযোগ রাখিনি। যাচ্ছি-যাব করে যাওয়া হয়নি। তবে আজ আর কেন?

আমার জীবনের সামান্য লেখালেখির জন্য যে দু’টি পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অ্যাকাডেমির অনীতা-সুশীলকুমার স্মৃতি পুরস্কার ও কৃত্তিবাস পুরস্কার, দু’টির অনুষ্ঠান মঞ্চে পৌরোহিত্য করেছেন নীরেনদা। কৃত্তিবাস তাঁর হাত থেকে নেওয়া। তার আগে বাঙ্গুরের বাড়িতে যাওয়া। পিছন দিকের এক ফালি বাগানে ফলভারাবনত বৃক্ষের প্রতি তাঁর গর্বিত মনোযোগ-যেন এমন জন-কোলাহলে এই বাড়িটির বিশেষত্ব দেখিয়ে দিতে চাইছিলেন। তখনও অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের ব্যতিক্রমী বাংলা সংলাপের মুখোমুখি হইনি। শুনেছি, নীরেনদা প্রতিটি বাক্য শব্দ স্পষ্ট ভাবে শুরু ও শেষ করেছেন। এই যে খেই হারানো বা এক অর্ধবাক্য থেকে অন্য বাক্যে যাওয়া, এ সবের ধারেকাছে নেই।

কবি কি!

আমার তো সারা জীবন নীরেনদার মুখোমুখি হলেই মনে হতো হেডমাস্টার মশাই! এইবার পড়া ধরবেন! আর আমি নির্ঘাৎ তোতলাবো! আমরা বাইরে বেরিয়ে যাওয়া অবধি বইটা উল্টপাল্টে দেখেছিলেন সে দিন। বলেছিলেন, ‘‘ফোন কোরো দিন পনেরো পরে।’’ ভেবেছি, ফোন করব। তার পরে ওই যা হয়। ভাবছি কী ভাবে জিজ্ঞেস করি, আমার বইটা পড়েছেন? কেমন লাগল? এ ভাবে এমন একটি মানুষকে জিজ্ঞেস করা অতি অস্বস্তির।

পুরস্কার মঞ্চে দীর্ঘদিন পরে পাশে বসেই বললেন, মাত্রা বৃত্তে পুরো বইটা হতে পারত। অনর্থক পরের দিকে কবিতাগুলো না দিলেই পারতে। চুপ করে শুনলাম। ভাবছিলাম, ফোনটা আগে করলেই হত।

সাহিত্য অ্যাকাডেমির একটি রূদ্ধদ্বার অনুষ্ঠানে নব্বইয়ের কবিরা কবিতা পড়েছিলেন। সিনিয়র কবিরা তাঁদের লেখা আলোচনা করেছিলেন। আমার প্রাপ্তি ছিল নীরেনদা। প্রায় এক পাতা জোড়া সে আলোচনা পরে ওই অনুষ্ঠানটি নিয়ে যে বই প্রকাশিত হয়েছে, তাতে স্থান পেয়েছে। তা নিয়ে বিশদে বলার সময় এখন নয়।

ঘটনাচক্রে, বড়দিনে একটা কাজের জন্য আমার এ বারের গন্তব্য ছিল কলকাতা। রাতেই ফের শিলিগুড়ির দিকে রওনা হওয়ার টিকিট। খবরটা পাওয়ার পর থেকে সারা দিনে যাবতীয় কথোপকথনের অনেকটাই তিনি জুড়ে থেকেছেন। শুধু অদ্ভুত শূন্যতার অনুভব বললে কী আর সব বোঝানো যাবে! সব কিছুই শব্দ সাজিয়ে বোঝানোর মতো জাদুকরি ক্ষমতা তো সকলের থাকে না। শব্দের জাদু দেখানোর বিশেষ জাদুকাঠি থাকে কারও কারও হাতে। শব্দ নিয়ে খেলা করা, হাজার-হাজার শব্দকে একটা মাঠে সুশৃঙ্খল ছন্দে খেলাধূলা করানোর মতো পারদর্শী হওয়াটাও মুখের কথা নয়। উপরন্তু, শব্দ নিয়ে খেলাধূলায় দক্ষদের সামলানোর মতো কুশলী প্রাজ্ঞজনের সংখ্যা তো ক্রমশ কমেই চলেছে যে!

(মতামত নিজস্ব)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Niendra Nath Chakraborty Death Obituary
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE