Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
ভারতে শিক্ষার হাল সম্পর্কে অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু

শুধু ডিগ্রি চাইলে হবে না

কঠিন পরিশ্রমের কাজ যদি যন্ত্র করে দেয়, সেটা খারাপ কিছু নয়। দৈহিক শ্রম থেকে মুক্তি পেলে মানুষ আরও উন্নত ধরনের কাজ করতে পারবে। গণিত, বিজ্ঞান, সঙ্গীত বা সাহিত্যের চর্চা করতে পারবে।

শিক্ষক: পুরুলিয়ার স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে অনেকটা সময় কাটালেন ভারত সরকারের ভূতপূর্ব অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কৌশিক বসু

শিক্ষক: পুরুলিয়ার স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে অনেকটা সময় কাটালেন ভারত সরকারের ভূতপূর্ব অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কৌশিক বসু

শেষ আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

প্রশ্ন: কাজ নেই, যথেষ্ট কাজ তৈরি হচ্ছে না, এই নালিশ দিন দিন বাড়ছে। এই অবস্থা কি বদলাবে?

কৌশিক বসু: আজ মানুষ যে সব কাজ করে, আগামী দিনে তার অনেকটাই করবে কৃত্রিম-বুদ্ধি যন্ত্র। ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ যে চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে তা কেবল কাজের জায়গাতেই নয়, গোটা সমাজেই একটা প্রবল ধাক্কা দিচ্ছে। শেষ এমন বড় মাপের ধাক্কা এসেছিল শিল্প বিপ্লবে, ১৭৫০ থেকে ১৮৫০ সালের মধ্যেকার সময়ে। তখন প্রযুক্তিতে এমন পরিবর্তন এল, যে শিশুরাও মেশিন চালাতে পারল বড়দের মতো। তার প্রভাব পড়ল সমাজেও। শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বাড়তে লাগল ব্রিটেনে। শিশু শ্রমিকের অনুপাতের নিরিখে অনেক দরিদ্র দেশকেও ছাড়িয়ে গেল অষ্টাদশ শতকের ব্রিটেন। আজ আবার এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হতে চলেছে, যখন দ্রুত বদলে যাবে কাজের পরিচিত ধরন। মেশিন আরও অনেক রকম কাজ করতে পারছে বলে মানুষের নিয়োগ কমে যাচ্ছে।

কঠিন পরিশ্রমের কাজ যদি যন্ত্র করে দেয়, সেটা খারাপ কিছু নয়। দৈহিক শ্রম থেকে মুক্তি পেলে মানুষ আরও উন্নত ধরনের কাজ করতে পারবে। গণিত, বিজ্ঞান, সঙ্গীত বা সাহিত্যের চর্চা করতে পারবে। কিন্তু শ্রমিক যদি মজুরি হারায়, আর সেই টাকাটা যোগ হয় কারও মুনাফার সঙ্গে, সেটা এক মস্ত সঙ্কট। এখন তা-ই হচ্ছে। অসাম্য বেড়ে চলেছে। ভারতে তা চড়চড় করে বাড়ছে। ষাট-সত্তরের দশকে ব্যবধান দেখা হত ধনীতম দশ শতাংশ লোকের সঙ্গে বাকি মানুষের। এখন ধনীতম এক শতাংশের সঙ্গে বাকিদের বিস্তর ফারাক দেখা যাচ্ছে।

এটা সমাজকে প্রচণ্ড আঘাত করছে। গোটা বিশ্ব আন্দোলিত হচ্ছে। নানা দেশে গণতন্ত্রের যে সঙ্কট দেখা দিচ্ছে, আমার ধারণা তার শিকড় কাজের জগতের আমূল পরিবর্তনে। তা বলে এই আঘাত যে কেবল ক্ষতিই করবে, এমন ধরে নেওয়া চলে না। শিল্প বিপ্লবের সময় নতুন চিন্তার স্ফুরণ হয়েছিল। অ্যাডাম স্মিথের মতো অর্থনীতিবিদ মোড়-ঘোরানো ধারণার সন্ধান দিয়েছিলেন। আয়কর বসানো শুরু হল সেই সময়েই। এল নতুন নতুন আইন। তাই সমাজের মারাত্মক, সুদূরপ্রসারী ক্ষতি এড়ানো গিয়েছিল। কৃত্রিম বুদ্ধির প্রযুক্তি যে আঘাত হানছে, তাতেও হয়তো সমাজ নতুন কোনও বাঁক নেবে।

প্র: তা হলে কেমন হবে আগামী দিনের কর্মক্ষেত্র? তার জন্য কেমন শিক্ষা দরকার?

উ: আগামী দিনে মানুষ সেই সব কাজই করবে, যা যন্ত্র পারে না, যা কল্পনাশক্তি দিয়ে করতে হয়। তাই শিক্ষার প্রকৃতিতেও পরিবর্তন জরুরি। যে শিক্ষায় একই ধরনের কাজ প্রায় যান্ত্রিক ভাবে করে যেতে হয়, তা আর কাজে লাগবে না। যে শিক্ষায় চিন্তাশক্তি, উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশ হয়, এর পর কর্মক্ষেত্রে তা-ই কাজে লাগবে। যে দেশ মনে করবে কোনও মতে একটা ডিগ্রি পাওয়াই হল শিক্ষা, সে বেশি কিছু করতে পারবে না। ভারতে এ কথাটা নিয়ে চিন্তা দরকার। স্বাধীনতার সময়ে ভারতে উচ্চশিক্ষার মান যথেষ্ট ভাল ছিল। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা আন্তর্জাতিক মানের ছিল বলেই আজও বিশ্বের ভাল ভাল প্রতিষ্ঠানে ভারতীয় অধ্যাপকদের উপস্থিতি নজর করার মতো।

উদ্ভাবনী প্রতিভার বিকাশের জন্য বৈজ্ঞানিক মানসিকতা তৈরি করা চাই। আমাদের ঐতিহ্য নিয়ে নিশ্চয়ই আমরা গৌরব করব। কিন্তু যদি ধরে নিই সব সত্য, সব রহস্য প্রাচীন শাস্ত্রে রয়েছে, তা হলে ভুল হবে। এই ভাবে ভাবতে গিয়ে অনেক উন্নত দেশ পিছিয়ে পড়েছে। ভাল শিক্ষার জন্য চাই প্রশ্ন করতে উৎসাহী মন। প্রাচীন গ্রিস, আধুনিক ইউরোপ প্রশ্ন করেছে বলেই জ্ঞান অর্জনে এগিয়ে গিয়েছে।

পুরুলিয়ার ‘ফিলিক্স স্কুল অব এডুকেশন’-এ আমি মাঝে মাঝে যাই, আজও গিয়েছিলাম। খুব আনন্দ হল দেখে যে, শিশুরা আনন্দের সঙ্গে শিখছে। খুদে পড়ুয়ারা আমাকে অঙ্কের ধাঁধা জিজ্ঞেস করছে। একটা দুটো এমন কঠিন, আমি উত্তর জানতাম না। আশা করি ওরা বুঝতে পারেনি ওই প্রশ্নগুলোতে আমিও গোল্লা পেতাম। ওই খুদে পড়ুয়ারা নৈতিক প্রশ্নও তুলছে, ‘সততা মানে কী? সব সময়ে সত্যি বলা কি ভাল?’ এমন জিজ্ঞাসু মন গড়ে তোলা প্রয়োজন। আমি থাকি নিউ ইয়র্কে, কিন্তু পারা ব্লকের এই স্কুলটিতে প্রথম ‘থ্রি ডি প্রিন্টার’ দেখলাম। হয়তো এমন উন্নত মানের শিক্ষার সুযোগ অল্প শিশুই পাচ্ছে, কিন্তু সমাজে এর প্রভাব কম নয়। নানা সমীক্ষা দেখিয়েছে, পরিবারে এক জন মানুষ শিক্ষিত হলে অন্যদের জীবনেও পরিবর্তন আসে। বাংলাদেশ দরিদ্র, কিন্তু শিক্ষার প্রসার, বিশেষত মহিলাদের মধ্যে শিক্ষার উন্নত হার, সে দেশকে মানব উন্নয়নে অনেক এগিয়ে দিয়েছে।

প্র: নরেন্দ্র মোদী কাজ তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তা যে হচ্ছে না, সেটা কি প্রযুক্তির বিবর্তনের কারণেই? না কি নীতির গলদও আছে?

উ: ভারতে এখনও কর্মক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার এমন কিছু বেশি নয় যে, কৃত্রিম বুদ্ধির যন্ত্র আসায় খুব তাড়াতাড়ি অনেক লোকের কাজ চলে যাবে। তবুও, দেশে কর্মহীনতার যতটুকু তথ্য-পরিসংখ্যান আমাদের হাতে আছে, তাতে কাজে নিয়োগের ছবি খুব খারাপ। এত দ্রুত এত লোকের কাজ যাওয়ার কথা নয়। এখন বার্ষিক বৃদ্ধির হার ৯ শতাংশ থেকে কমে ৬.৭ শতাংশে নেমেছে, কিন্তু সে-ও খুব খারাপ হার নয়। অথচ কাজের বাজার খুব খারাপ। খুব সম্ভব এর একটা কারণ ২০১৬ সালের নোট বাতিল করা, যা ভারতের অসংগঠিত ক্ষেত্রকে ঘায়েল করেছে। অধিকাংশ মানুষ যে হেতু অসংগঠিত ক্ষেত্রেই কাজ করেন, তাই কাজ পাচ্ছেন না।

যে উপায়ে নতুন কাজ তৈরি হতে পারত, তার প্রতিও যথেষ্ট মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে না। যেমন রফতানি। স্বল্পমূল্যের পণ্য রফতানি থেকে কার্যত সরে এসেছে চিন। সে জায়গাটা খালি পড়েই রয়েছে। বাংলাদেশ পণ্য তৈরি করে রফতানি করার কাজে যে ভাবে এগিয়ে এসেছে, ভারত সে তুলনায় উদ্যোগ করেনি। অথচ রফতানি বৃদ্ধির নীতি গ্রহণ করলে অনেক কাজ তৈরি হতে পারে।

উদ্বেগের কথা, কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের যোগদানের হার ভারতে কমছে। কেন, তা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। হয়তো সাবেকি চিন্তাধারা এখনও চলছে। তাই লোকে মনে করে, পরিবারের রোজগার বাড়লে মেয়েদের আর কাজ করার দরকার নেই। এটা ভুল। মেয়েদের কাজের সঙ্গে সমাজ, দেশের উন্নতিও জড়িয়ে আছে। গোটা বিশ্ব থেকেই সাক্ষ্য মিলেছে, মেয়েদের রোজগার অল্প বাড়লেও তা শিশুদের কল্যাণে অনেকখানি উন্নতি আনে।

প্র: সমস্যাগুলি বহু দিনের। কেন সমাধান মেলেনি?

উ: কারণ গণতন্ত্রের দুর্বলতা। গণতন্ত্র মানুষের একটি অসামান্য কৃতিত্ব। কিন্তু তার দুর্বলতার বিষয়েও ভোটদাতাকে সতর্ক থাকতে হবে। নির্বাচনে জেতার দৌড়ে নেমে রাজনৈতিক দলগুলো একটা ন্যূনতম কার্যক্রম খুঁজে নেয়। তার উপর এখন এ দেশে খুব সঙ্কীর্ণ মনোভাব থেকে বিভেদ সৃষ্টি করে ভোট টানার চেষ্টা চলছে। কোথায় থামতে হবে, সে বোধ যেন হারিয়ে গিয়েছে। বাংলায় নবজাগরণের দিকপালরা যা বলেছিলেন, যা আধুনিক ভারতকে রূপ দিয়েছিল, তা আবার মনে করা চাই। তাঁদের শিক্ষা— ধর্ম মানুষের নিজস্ব বিশ্বাস, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা মহামূল্যবান। এই মূল্যবোধ গ্রহণ করেছিল বলেই ভারত উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যে স্বতন্ত্র হয়ে উঠেছিল, বিশ্বের শ্রদ্ধা অর্জন করেছিল। যে সব রাজনৈতিক গোষ্ঠী জাতি-ধর্মের ভিত্তিতে হিংসায় উস্কানি দিচ্ছে, তাদের চাপ প্রতিরোধ করতে হবে। ভোটদাতাকেই প্রশ্ন করতে হবে, ‘‘আমার নেতা কি ন্যায়-নীতি মানেন, না কি মানেন না?’’ ভারতে আজ গণপ্রহারে হত্যা ঘটেই চলেছে, গোটা বিশ্ব সে খবর পড়ছে, দেখছে। এতে জগতের কাছে ভারতের অমর্যাদা হচ্ছে, দেশের ক্ষতি হচ্ছে। আগে এমন ঘটনা কত হত, এখন কত হচ্ছে, সেটা কোনও কথা নয়। আজ প্রত্যেককে বলতে হবে, ‘‘এমন ঘটনা একটাও চাই না। এ আমার ভারত নয়। যদি বা এমন ঘটনা থেকে কোনও সুবিধে মেলে, তা আমি নেব না।’’

সাক্ষাৎকার: স্বাতী ভট্টাচার্য

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Opinion Kaushik Basu Indian Education
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE