Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
বৈষম্য বাড়লে অপুষ্টি বাড়বে

ভূমিপুত্রদের বঞ্চিত করাও গণহত্যা, বললেন বিনায়ক সেন

দেশভাগ হল মানে, যে যার নিজের এলাকায় চলে গেল, সেখানেই থাকল। কিন্তু এই যে এলাকা ভাগ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, তা ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে।

শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০০:০৬
Share: Save:

প্রশ্ন: ধর্মাচরণ, অসহিষ্ণুতা, হিংসা ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে তুমুল বিতর্ক চলছে দেশ জুড়ে। কিন্তু জনস্বাস্থ্যের বিষয়ে এত নীরবতা কেন?

বিনায়ক সেন: তার আগে অন্য একটা কথা বলি। দেশভাগ হল মানে, যে যার নিজের এলাকায় চলে গেল, সেখানেই থাকল। কিন্তু এই যে এলাকা ভাগ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, তা ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। এর পাশাপাশি, রাষ্ট্রীয় হিংসাও মারাত্মক আকার নিয়েছে। এত বছরেও তা কমেনি। বরং, এমন একটা বছরও যায়নি, যে বার রাষ্ট্রীয় মিলিশিয়া মানুষ মারেনি। এই যে নিরাপত্তাহীনতা, বৈষম্য, সেটাকেও জনস্বাস্থ্য থেকে আলাদা করা যাবে না।

প্র: সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার সঙ্গে তা হলে জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত?

: অবশ্যই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু), স্বাস্থ্যের সামাজিক নির্ধারক (সোশ্যাল ডিটারমিন্যান্টস অব হেল্থ) বলে এক সমীক্ষা চালায়। তাতে এই বৈষম্যের কথা বলা হয়েছে। এই বৈষম্য বাড়ছে। ফল হচ্ছে ভয়ংকর। জনস্বাস্থ্যকে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে, কর্পোরেটের মুনাফার ফর্মুলাকে মাথায় রেখেই।

প্র: গোরক্ষপুরের হাসপাতালে এত অসহায় শিশুর মৃত্যু কি গোটা অবস্থাটা বেআব্রু করে দিচ্ছে না?

উ: জনস্বাস্থ্য পরিষেবায় চরম অকর্মণ্যতার সাম্প্রতিক উদাহরণ এটা। এটাই কিন্তু দেশজোড়া ছবি। কোনও ব্যতিক্রম নয়।

প্র: ভারতে যোজনা কমিশনের বড় ভূমিকা ছিল।

উ: তা তো ছিলই। কিন্তু এই যোজনা কমিশনই জনমুখী অনেক সুপারিশ খারিজও করে দেয়!

প্র: ইউপিএ সরকার আপনাকে জাতীয় স্বাস্থ্য কমিটিতে রেখেছিল। আপনি স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য ছিলেন। সে সময় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে আপনি জামিনে মুক্ত হন।

উ: স্বাস্থ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ কমিটির নানা সুপারিশ খতিয়ে দেখে স্টিয়ারিং কমিটি সেগুলিকে মান্যতা দিয়েছিল। যেমন সুপারিশ করা হয়, গড় অভ্যন্তরীণ আয়ের (জিডিপি) ১.৫% থেকে বাড়িয়ে ৩% স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ করা হোক। কিন্তু যোজনা কমিশনের তখনকার ডেপুটি চেয়ারম্যান মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়া সমস্ত সুপারিশ খারিজ করে দেন। তাঁর যুক্তি ছিল, এই সুপারিশগুলি মানার মতো আর্থিক সামর্থ্য বা পরিকাঠামো নেই। জিডিপি’র যে বাড়তি ১.৫% স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছিল, টাকার অঙ্কে তার পরিমাণ প্রায় ১.৭৬ লক্ষ কোটি। অথচ, জনমুখী স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর উন্নয়নে এই টাকা খরচ করতে না পারলেও ‘নন পারফর্মিং অ্যাসেট’-এ এর দ্বিগুণ খরচের সুপারিশ গ্রাহ্য হয়েছে।

প্র: ‘বিজলি-সড়ক-পানি’ যে অর্থে পপুলার স্লোগান, সে অর্থে ‘স্বাস্থ্যের অধিকার’-এর স্লোগান কি লোক টানে না?

উ: এ ক্ষেত্রে একটা অন্য কথা জানাব। ন্যাশনাল নিউট্রিশন মনিটরিং ব্যুরো (এনএনএমবি) দেশের মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে বারে বারে সমীক্ষা করেছে। তাতে দেখা যায়, দেশের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের বেশি প্রাপ্তবয়স্কের (নারী-পুরুষ মিলিয়ে) বডি মাস ইনডেক্স (বিএমআই) ১৮.৫-এর কম। এঁদের অনাহারগ্রস্ত বলে গণ্য করা হয়। আমরা সমীক্ষা করে দেখেছি, একটা গোটা জনগোষ্ঠীর ৫০% থেকে ৭০% মানুষের বিএমআই ১৮.৫-এর নীচে। জনগোষ্ঠীর গোটাটাই স্থায়ী ভাবে দুর্ভিক্ষপীড়িত। যদিও কেন্দ্রের নির্দেশে ২০১৪-র অক্টোবরে এনএনএমবি বন্ধ করে দেওয়া হয়।

প্র: বৈষম্যের মাত্রা ভয়াবহ!

উ: সমাজের বিরাট অংশে বৈষম্য, অপুষ্টি, নিরাপত্তাহীনতা আছে। রাষ্ট্রক্ষমতা একে দমিয়ে রেখেছে। পরিচিতি-ভিত্তিক জাতীয় আনুগত্যকে কাজে লাগিয়ে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে, পুলিশকে ব্যবহার করা হয়েছে। সাম্প্রতিক উদাহরণ, নর্মদা আন্দোলন।

প্র: সেখানে সমাজকর্মী মেধা পটেকরকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

উ: হ্যাঁ। রাষ্ট্র যে সব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সেগুলো ভাঙল। জনমত দমিয়ে রাখতে সশস্ত্র বাহিনীকে কাজে লাগানো হল।

প্র: আপনি দীর্ঘ দিন ছত্তীসগঢ়ের প্রত্যন্ত এলাকায় তৃণমূল স্তরে জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের শরিক হয়েছেন। অভিজ্ঞতা কী বলছে?

উ: আমি ছত্তীসগঢ়ের ধমতেরি ও দল্লি রাজহরায় কাজ করেছি। তবে, শুধু ছত্তীসগঢ় বা বস্তারের কথা না বলে গোটা দেশের কথা বলছি। জনগোষ্ঠীর অপুষ্টি একটা খুব বড় বিষয়। মুশকিলটা হল, জীবনধারণের জন্য যে ‘কমন রিসোর্স’ দরকার, তার কাছে ভূমিপুত্রদের যেতে দেওয়া হচ্ছে না। বনজ সম্পদ, নদী, পাহাড়, গাছগাছালিতে বনবাসীদের আর আগের মতো অধিকার নেই। বড় বড় কর্পোরেটদের কাছে সে সব বিকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। হাজার হাজার ক্ষুধার্ত ভূমিপুত্রকে যে ভাবে বঞ্চিত করা হচ্ছে তা গণহত্যা ছাড়া আর কিছুই নয়।

প্র: তা হলে জনস্বাস্থ্য আন্দোলন এগোবে কী ভাবে?

উ: আমি আর একটা জরুরি কথা বলি। অপুষ্টির জন্য বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে যক্ষ্মার মহামারী দেখা যাচ্ছে। অপুষ্টির সঙ্গে যক্ষ্মা প্রতিরোধ-ক্ষমতা অঙ্গাঙ্গি জড়িত। শুধু ওষুধ দিয়ে এই যক্ষ্মা ঠেকানো যাবে না। জেএনইউ-এর অধ্যাপক রাজীব দাশগুপ্ত গবেষণায় দেখিয়েছেন, দশ বছরে যক্ষ্মা রোগে মৃত্যু পাঁচ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আসলে, সামাজিক বৈষম্য ঘোচাতেই হবে। একটা উদাহরণ দিই। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পরে সেখানে সামাজিক অস্থিরতা বাড়ে। তখন বিশেষ করে জেলবন্দিদের মধ্যে যক্ষ্মা বেড়ে যায়।

প্র: আমাদের দেশেও তো সামাজিক অস্থিরতা এবং নিরাপত্তাহীনতা ব্যাপক? এখানেও যক্ষ্মার মতো অসুখের প্রকোপ কি এই কারণে বেশি?

উ: অবশ্যই। এখানে বৈষম্যের নানা প্রকাশ আছে। যেমন, বিরাট এলাকা জুড়ে গ্রাম থেকে শহরে লোক চলে আসছেন। তাতে নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে। শুধু স্বাস্থ্য কর্মসূচি নিলে কোনও ফল হবে না।

প্র: শঙ্কর গুহনিয়োগী ও আপনাদের সম্মিলিত নেতৃত্বে দল্লি রাজহরার শহিদ হাসপাতাল জনস্বাস্থ্য আন্দোলনে নতুন দিশা দেখিয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো যায় না?

উ: সে অভিজ্ঞতা ভীষণ কাজে লেগেছে। সেখানে খনি-শ্রমিকেরা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে এই দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন।

প্র: তা হলে জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের কাজটা দেশ জুড়ে এগোবে কী করে?

উ: আমার কাছে এর কোনও প্রেসক্রিপশন নেই। তবে সবাই মিলে কাজটা করতে হবে। পুষ্টির দিকে বিশেষ ভাবে মনোযোগ দিতে হবে। শুধু চাল-গমের মতো কার্বোহাইড্রেট দিয়ে পুষ্টি আসবে না। খাদ্য সুরক্ষা আইনের মাধ্যমে যে রেশন দেওয়া হচ্ছে, তাতেও আসবে না। রোজকার খাদ্যাভ্যাসে ব্যাপক বদল দরকার। গোটা বিষয়টি দেখতে উচ্চপর্যায়ের বিশেষজ্ঞ কমিটি দরকার। খাদ্যের পরিমাণ ও গুণমানের পরিবর্তন করতেই হবে।

সাক্ষাৎকার: তাপস সিংহ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE