Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

বাদুড় রহস্য

প্রায় দুই দশক পূর্বে মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুরে শূকরের মধ্যে নিপা ভাইরাসের আক্রমণ প্রথম আবিষ্কৃত হইয়াছিল।

শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০১৮ ০১:১৩
Share: Save:

নিপা নামক ভাইরাসটির সংক্রমণে আরও এক বার প্রমাণিত হইল প্রবল পরাক্রমশালী মনুষ্যকুলও কত দুর্বল হইতে পারে। রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর তালিকায় শীর্ষ স্থানে দুই শত্রু। ব্যাক্টিরিয়া এবং ভাইরাস। ব্যাক্টিরিয়া একাধিক সংক্রামক রোগের কারণ, নিউমোনিয়া, যক্ষ্মা, টাইফয়েড, কলেরা, প্লেগ কিংবা ডিপথেরিয়া। কিন্তু মানুষের চরমতম শত্রু বুঝি ভাইরাস। সর্দি বা ইনফ্লুয়েঞ্জার ন্যায় সাধারণ উৎপাতই কেবল নহে, হাম, বসন্ত, পীতজ্বর, জলাতঙ্ক, পোলিয়ো কিংবা এনসেফ্যালাইটিসের মতো মারাত্মক রোগও ইহার উপহার। অথচ আয়তনে কতটুকুই বা ওই ভাইরাস! সূচ্যগ্রের হাজার ভাগের এক ভাগ মাত্র। হয়তো এই কারণেই ভাইরাসের আবিষ্কার ব্যাক্টিরিয়ার অনেক পরে। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে। তত দিনে জীবাণু হিসাবে ব্যাক্টিরিয়া নানা ভাবে পরীক্ষিত। বিজ্ঞানীরা দূষিত তরলকে জীবাণুমুক্ত করিতে সূক্ষ্ম ছাঁকনির মধ্যে ফেলিতেন। ছাঁকনির উপরে পড়িয়া থাকিত ব্যাক্টিরিয়া। নীচে পরিষ্কার তরল। পরে এক সময় ধরা পড়িল, পরিস্রুত তরলও জীবাণুমুক্ত নহে। তাহা দূষিত করিতে পারে বিশুদ্ধ পদার্থকে। অর্থাৎ, কিছু বিষাক্ত কণা আছে, যাহারা ব্যাক্টিরিয়া অপেক্ষা ক্ষুদ্রতর। ইহারা চিহ্নিত ভাইরাস নামে। লাতিন ভাষায় শব্দার্থ পূতিগন্ধ কিংবা পঙ্ক।

প্রায় দুই দশক পূর্বে মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুরে শূকরের মধ্যে নিপা ভাইরাসের আক্রমণ প্রথম আবিষ্কৃত হইয়াছিল। ভাইরাসটির মুখ্য বাহক ফল-ভক্ষণকারী বিশেষ শ্রেণির বাদুড়। শৃগালের মুখমণ্ডলের সহিত সাদৃশ্য হেতু যাহারা ‘উড়ন্ত শৃগাল’ নামেও পরিচিত। উক্ত বাদুড়ের মূত্র, বিষ্ঠা, থুতু কিংবা শুক্রাণুতেও ভাইরাসটি বাস করিতে পারে। মরিবার সময় বাদুড়ের দেহনিঃসৃত ওই সব পদার্থ পরিবেশে ছড়াইলে বিপদের সম্ভাবনা। বাংলাদেশে নিপা-র সংক্রমণের মূলে চিহ্নিত হইয়াছে খেজুরের রস পান। শীত ঋতুতে উহা এক সুস্বাদু পানীয়। খেজুরের গাছে এবং রসে বাদুড়ের স্পর্শ স্বাভাবিক। ওই স্পর্শের পথে বাদুড়ের দেহনিঃসৃত পদার্থ খেজুরবৃক্ষকে কলুষিত করে বলিয়া অনুমান। কিসের কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশে বাদুড়-বাহিত নিপা ভাইরাস ছড়াইল? অরণ্য-নিধন, যাহা মনুষ্যের বাসভূমি বৃদ্ধির তাগিদায় সর্বত্র চলিতেছে। ফলে বাস্তুচ্যুত বাদুড়েরা এক্ষণে দিকে দিকে ছড়াইয়া পড়িতেছে। বাড়িতেছে মনুষ্যের বিপদ।

মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুরে নিপা-র সংক্রমণে যে কয় জন মনুষ্য মৃত্যুমুখে পতিত হন, তন্মধ্যে অধিকাংশই শূকর-পালক। অর্থাৎ নিপা সেই শ্রেণির ভাইরাস, যাহা বন্য ও গৃহপালিত পশু হইতে মনুষ্যে ছড়ায়। ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে এক সমীক্ষায় জানা যায় যে ১,৩৯৯ প্রকার জীবাণু মানুষের দেহে বাসা বাঁধিতে পারে, তন্মধ্যে অধিকাংশই পশু হইতে মনুষ্যদেহে হানা দেয়। পশুর দুগ্ধ কিংবা ডিম্ব আহার্য হিসাবে ব্যবহার যে রূপ পরোক্ষ পন্থা, তদনুরূপ মশামাছি কর্তৃক জীবাণু বহনও মনুষ্যের বিপদের মূলে। রুগ্‌ণ বিড়াল, কুকুর কিংবা বানরের আঁচড় বা কামড়ে ভাইরাস সংক্রমণের একশো শতাংশ সম্ভাবনা। স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা ইদানীং যে দাবি উত্থাপন করিতেছেন, তাহা ভাবিবার মতো। তাঁহাদের মতে মনুষ্যের স্বাস্থ্যহানি একক বিচার্য বিষয় হইতে পারে না। পশু এবং মনুষ্যস্বাস্থ্য একত্রে বিচার্য। তদনুযায়ী প্রকল্প প্রণয়ন জরুরি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE