১৯৮৮ সালে প্রয়াত রাজীব গাঁধীর সঙ্গে দিল্লি থেকে দার্জিলিং গিয়েছিলাম। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ বিমানে চেপে শুধু যাওয়া নয়, তিন দিন রাজীব গাঁধীর মতো এক আকর্ষক চরিত্রের সঙ্গে কাটানো। সে এক স্মরণীয় সময়। রাজীব গাঁধীর সঙ্গে সেই প্রথম আলাপ। রাজীবের দুই বিশ্বস্ত অফিসার মণিশঙ্কর আইয়ার এবং জি পার্থসারথি ছিলেন তাঁর সঙ্গে। সেই সফরে বুঝেছিলাম, কী প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে পারেন এই সুদর্শন প্রধানমন্ত্রী। প্রথমে আমরা গেলাম বিহারের পুর্নিয়া, সেখানে জনসভা করে একটা রাত কাটিয়ে পরের দিন দার্জিলিং। কলকাতায় তিন বছর সাংবাদিকতা করে দিল্লিতে বদলি হই ১৯৮৭ সালে। হাওড়া মন্দিরতলার ছেলে, বন্ধুরা বলত ‘আফটার অল মফস্সল’, তা সেই মফস্সলের ছেলে দিল্লিতে এসে প্রায় ‘হাঁ-করা’ অপুর মতোই অসীম কৌতূহল নিয়ে রাজীবকে দেখছিলাম। ’৮৮ সাল, মানে বুঝতেই পারছেন, তখন বফর্স-ঝড় শুরু হয়ে গিয়েছে। সেই অসুবিধাজনক পরিস্থিতির মধ্যেও রাজীবকে দেখেছিলাম, এক নিভৃত ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিজের প্রতি আস্থা ছিল। বিমানে দীর্ঘ কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছিলেন মণিশঙ্কর।
রাজীব বলেছিলেন, কী ভাবে চার-পাঁচ ঘণ্টা ঘুমিয়ে একনাগাড়ে কাজ করে যান তিনি। মাঝে মাঝে গপ্পো করতে করতে সুগন্ধি কোলন মাখানো শীতল ছোট সাদা তোয়ালেতে মুখ মুছছিলেন। আমি চোখ বড় বড় করে ওঁর কথা শুনছিলাম। সত্যিকারের আধুনিক মানুষ তিনি। অন্ধ কুসংস্কারকে যে নির্বাচনে কাজে লাগানো হয়, সেও তাঁর তীব্র অপছন্দ। চকোলেট আর কফি খেতে খেতে বলছিলেন, ভোটের জন্য মন্দির মসজিদে যেতে হয়, তবে আমার বিশ্বাস মানুষের ধর্মে। তখন মণিশঙ্কর আইয়ার অনেক রোগা মানুষ। জিন্স পরে রাজীবের বক্তৃতার খসড়া লেখেন। রাজীব বক্তৃতাতেও ড্রামা পছন্দ করতেন না। বলছিলেন, আমি যা, আমি তা-ই। মানুষকে বোকা ভাবার কারণ নেই।
সম্প্রতি রাহুল গাঁধীর সঙ্গে দেখা হয়েছে। তুঘলক লেনে ওঁর ড্রয়িং রুমে বসে ওঁর কথা শুনতে শুনতে বার বার ওঁর বাবার কথাই মনে পড়ছিল। রাহুলকেও অবলোকন করছি। দেখছি, ধবধবে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি আর মেরুন রঙের সুদৃশ্য চটি। দুধ-সাদা পায়ে চটিটা মানিয়েছে দারুণ। রাহুলও এক জন আধুনিক মানুষ। স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি। ঐতিহ্যমিশ্রিত কুসংস্কার, মোহজড়িত বাধা যখন ভারতীয় জনমানসের বৃহদংশকে গ্রাস করছে, তখন ৪৭ বছর বয়সের রাহুল প্রমাণ করছেন, রাজীবের মতো তিনিও অপটিক্স, রেটরিক ইত্যাদি কায়দায় লোক-দেখানো ভড়ংয়ে বিশ্বাস রাখেন না।
হাওড়া মন্দিরতলার এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা সংবাদকর্মী ’৮৮ সালের যে সময়ে রাজীব গাঁধীর সঙ্গে কথা বলেছিল, আজ সেই সময় পরিবর্তিত। এখন নিজের ঢাক নিজেরই পেটানোর যুগ। তাতে সব কদর্যতাই ঢাকা পড়ে যায় বলে ভাবা হয়। এ হল এক সেলফি সমাজ। চিৎকার করে সবাই বলছে আমায় দেখো, আমায় দেখো। এক দিকে অন্ধ মূঢ় ধর্মবিশ্বাস-কেন্দ্রিক সাম্প্রদায়িকতা আর অন্য দিকে অহং-অহং-অহং। সেই অহং-ব্যবস্থা গণতন্ত্রের কবরের মধ্যে এক আধুনিক রাজতন্ত্রের অতীতচারী দুরাশা।
সময় বদলেছে। জনমত নিয়ন্ত্রণকারী মিডিয়া-সংস্কৃতি ২০১৪ সালে বিজেপিকে দিয়েছিল ২৮২ নামক সংখ্যার সাফল্য। স্বীকারোক্তি আমার— আমারও দৃঢ় বিশ্বাস ছিল নরেন্দ্র মোদী রাজনীতিতে এক নতুন ঋতু নিয়ে আসবেন। গোধরাকে পিছনে ফেলে তিনি সৎ একটি সামাজিক আদর্শ নিয়ে নতুন ভারত নির্মাণের প্রধান কারিগর হবেন। ব্যক্তিগত ভাবে ওঁকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি আমি। প্রচণ্ড মনের জোর। যা করব ভাবেন তা করেই ছাড়েন, এমন মানুষ তিনি। কিন্তু গত চার বছর দেখলাম দুঃখজনক বিবর্তন। কেন্দ্রের নাক যে ভাবে রাজ্যে রাজ্যে প্রলম্বিত ছায়া ফেলল, তাতে একমুখী একনায়কতন্ত্রে মানুষ ক্ষুব্ধ হচ্ছেন।
রাজ্যে রাজ্যে কৃষকদের আন্দোলন মুখরিত হয়ে উঠেছে। দলিত-ওবিসি সংখ্যালঘু সমাজের নিরাপত্তার অভাববোধ তীব্র হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, বিজ্ঞাপন দেখিয়েও সাধারণ মানুষের অভাববোধ দূর করা যাচ্ছে না। বশ্যতার ছবি চার দিকে, প্রশাসককে ঘিরে বিদূষকদের ভিড়। চিন্তাশীল বিবেকসম্পন্ন মানুষ দূরে সরে যাচ্ছেন। আর এই প্রেক্ষাপটে রাহুল গাঁধী সকল কাঁটাকে ধন্য করে জাতীয় রাজনীতিতে প্রস্ফুটিত।
রাহুল গাঁধীকে যাঁরা ‘পাপ্পু’ বলতেন, যাঁরা বলতেন ‘আমুল বয়’, বলতেন ‘মাম্মি কা বেটা’, তার মধ্যে আরএসএস-বিজেপি সবচেয়ে বড় অংশ হলেও এ দেশের একটা অন্য প্রভাবশালী সমাজও এর মধ্যে ছিল। অভিজাত পাঁচতারা মানুষ থেকে শুরু করে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মফস্সলের মানুষও ছিলেন। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, বিজেপি যতই রাহুল গাঁধীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আক্রমণ ধারালো করুক না কেন, তাঁরা আর তাঁকে ‘পাপ্পু’ বলছেন না। আবার তেমনই, রাহুল গাঁধী সম্পর্কে জনপ্রিয় প্রচার ছিল, সনিয়া-তনয় একেবারেই ‘সিরিয়াস’ নন, বিয়ে-থা না করে খালি দেশ-বিদেশে বেড়িয়ে বেড়ান, একটানা কয়েক সপ্তাহ ধরে রাজনৈতিক কর্মসূচি নিতে পারেন না। প্রশ্ন উঠত, নরেন্দ্র মোদী ৬৭ বছর বয়সে যে পরিশ্রম করতে পারেন ৪৭-এর রাহুল তা পারেন কই? এখন কিন্তু এই সব প্রচার অনেকটাই স্তিমিত। যে সোশ্যাল মিডিয়া ছিল নরেন্দ্র মোদীর প্রধান কর্মক্ষেত্র, সেখানে দেখছি তাঁকে নিয়েও অনেক বেশি ব্যঙ্গবিদ্রূপ, কার্টুনের ছড়াছড়ি। রাহুলের চেয়ে মোদীকে লক্ষ্য করেই আমজনতার চিমটি কাটার সাহস-প্রদর্শন চলছে।
২০১৯ সালে জাতীয় ভোটের ফলাফল কী হতে চলেছে, তা নিয়ে কোনও ভবিষ্যদ্বাণী করতে আমি রাজি নই। তবে এটুকু বলতে পারি, আগুনের প্রবল হলকা এখন গোটা ভারত জুড়ে। বিদ্রোহ চার দিকে। তার মধ্যে জাতীয় স্তরে রাহুল গাঁধী আবার এক পালাবদলের ডাক দিয়েছেন। দেশের সমস্ত মোদী বিরোধী আঞ্চলিক নেতাদের সহায়তা প্রার্থনা করেছেন। আ়ঞ্চলিক দলগুলির হাত ধরে কেন্দ্রবিরোধী যুক্তরাষ্ট্রীয় রাজনীতির নতুন এক অধ্যায় জন্ম নিচ্ছে।
গড়পড়তা মানুষ নাটক ভালবাসেন। রাজনৈতিক নেতা হয়েছেন, কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেননি? এ কেমন কথা? রাহুল এখন নিয়মিত টুইট করছেন, উপস্থাপনায় আনছেন নানা ধরনের মজা। অনেকে তাঁকে আরও নাটুকে, আরও কৃত্রিম হওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছেন। কিন্তু ২০১৪ সালে প্রভূত জনসম্মোহিনী বক্তৃতা দিয়ে ‘অচ্ছে দিন’-এর স্বপ্ন দেখানোর পর যখন দেখছি সে সব শুধুই ভড়ং, তখন কি মনে হয় না, প্রয়োজন নেই শিরা-ফোলানো নাটক, বক্তৃতায় উদারা-মুদারা-তারা-অতিতারার উত্থানপতন! তার বদলে সুভদ্র, খাদে গলা নামানো, অনতি-চিৎকৃত অঙ্গীকারই ঢের ভাল।
এক দণ্ডের জন্য ভেবে দেখুন তো, অতি উচ্চগ্রামে বাঁধা মন কি বাত তো অনেক শুনলাম। হাতে থাকল কী?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy