Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

রাখা যাবে না একলা ঘর

কলকাতার মানসিক হাসপাতালগুলিতে সলিটারি সেল উঠে গিয়েছে বছর তিনেক আগে। যাঁরা ‘ভাল পেশেন্ট’ হয়ে উঠতে পারতেন না, অবাধ্য গোঁয়ার হয়ে থাকতেন, তাঁদের সেই ঘরে পুরে ‘চিকিৎসা’ করা হত।

রত্নাবলী রায়
শেষ আপডেট: ২২ জুন ২০১৮ ০০:১৭
Share: Save:

অবশেষে ভাঙল শেষ ঘরটাও। জুন মাসের গোড়ায় রাজ্য সরকারের নির্দেশে পুরুলিয়া মানসিক হাসপাতালের ‘সলিটারি সেল’ ভেঙে ফেলা হল। এ রাজ্যে আর কখনও কোনও মনোরোগীকে সম্পূর্ণ একা একটা ঘরে বন্দি করে রাখা যাবে না।

কলকাতার মানসিক হাসপাতালগুলিতে সলিটারি সেল উঠে গিয়েছে বছর তিনেক আগে। যাঁরা ‘ভাল পেশেন্ট’ হয়ে উঠতে পারতেন না, অবাধ্য গোঁয়ার হয়ে থাকতেন, তাঁদের সেই ঘরে পুরে ‘চিকিৎসা’ করা হত। তাঁদের দেখিয়ে অন্য রোগীদের বোঝানো হত, বেয়াদপি করলে তাঁদের জন্যও একই ‘ব্যবস্থা’ করা হবে। সম্পূর্ণ নগ্ন করে রাখা হত রোগীকে। ঘরেই মলমূত্র ত্যাগ, বাইরে থেকে থালা ছুড়ে খাবার দেওয়া, এই ছিল নিয়ম।

দুই দশক কাজ করছি মানসিক হাসপাতালের মনোরোগীদের সঙ্গে। যত বার নির্জন সেল নিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছি তাঁরা বলেছেন, ‘‘এই সেল ব্যবহৃত হয় না।’’ কিন্তু নির্যাতনের ইতিহাসও কি মানুষকে তাড়া করে বেড়ায় না? একক সেলের উপস্থিতিই এক জন মানুষকে আতঙ্কে রাখার জন্য যথেষ্ট নয় কি? রেশমির কথা মনে পড়ছে। হাসপাতালে কাজ করতে আসা এক শ্রমিক রেশমিকে যৌন নির্যাতন করে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সেই ব্যক্তিকে চিহ্নিত করতে পারেননি। কিন্তু রেশমিকে এই ‘অপরাধ’-এর জন্য দোষী সাব্যস্ত করে নির্জন সেলে ভরে দেওয়া হল! কর্তৃপক্ষের মনে হয়েছিল, নিশ্চয়ই রেশমি সেই শ্রমিককে প্রলুব্ধ করেছে! সুস্থ হয়ে ওঠা রেশমিকে তাই বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার জন্য আরও কয়েক বছর হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল।

এমন কত যে অন্যায় পীড়ন চলে! মনে পড়ে প্রতিভার কথা। প্রতিভা ছ’বছর ধরে বহরমপুর হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন, বাড়ির লোক এক বারও দেখতে আসেননি। সমাজকর্মীরা বার বার পরিবার, প্রতিবেশীদের সঙ্গে আলোচনা করার পর আত্মীয়রা প্রতিভাকে নিয়ে যেতে সম্মত হলেন। বাড়ি ফিরে যাওয়ার দু’দিন আগে প্রতিভাকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ন্যাড়া করে দিল। আয়নায় নিজেকে দেখে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে প্রতিভা বলেছিলেন, ‘‘আমার কী হবে দিদি? ওরা তো আমাকে আর ফেরত নেবে না। সবাই বলবে, এখনও পাগলই আছে তাই হাসপাতাল থেকে ন্যাড়া করে দিয়েছে।’’ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের যুক্তি, ‘‘উকুনের জন্য ওদের অ্যানিমিয়া হয়ে যাচ্ছে। তাই চুল কাটিয়ে দিলাম।’’

পুরনো মানসিক স্বাস্থ্য আইনে রোগীর মর্যাদা রক্ষার বিষয়ে একটি বাক্য ছিল। বলা ছিল, মানসিক রোগীর সঙ্গে তাঁর পরিবার, সমাজ-প্রতিবেশী, কর্মস্থল ও চিকিৎসাস্থলে কেউ অমানবিক, অমর্যাদাপূর্ণ ব্যবহার করতে পারবে না। কোন ধরনের কাজকে ‘নির্যাতন’ বলে গণ্য করা হবে, সে বিষয়ে কোনও স্পষ্টতা ছিল না। অথচ আমরা সবাই বুঝি, নির্যাতন মানে কেবল মারধর বা গালাগাল নয়। হাসপাতালে ভর্তি প্রবীণ মানুষকেও যদি ‘তুই’ সম্বোধন করা হয়, খেতে দেওয়ার বাসন যদি অপরিষ্কার হয়, খাওয়ার থালা যদি ছুড়ে দেওয়া হয়, তা কি নির্যাতন নয়? পুরুলিয়া মানসিক হাসপাতালে প্রাতরাশে পাউরুটি, কলা, দুধ দেওয়া হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সুষম খাদ্য দিচ্ছেন সন্দেহ নেই। কিন্তু পাউরুটি ও কলা হাতে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, প্লেট জিনিসটার বালাই নেই। এবং দুধ মগে দেওয়া হচ্ছে। সেই মগেই দুপুরে ডাল দেওয়া হয়, আবার শৌচাগারেও ব্যবহার করতে হয় ওই একই মগ। এই ব্যবহার কি একটি মানুষের প্রাপ্য? পুরনো আইন এমন আচরণকে ‘নির্যাতন’ বলে চিহ্নিত করেনি, হয়তো তাই এগুলো চলতে পারছিল।

মানসিক হাসপাতালে মহিলাদের বিভাগে চারিদিকে রক্ত-লাগা ন্যাকড়া ছড়িয়ে থাকে, নতুন রং করা দেওয়ালে রক্তের ছোপ দেখতে পাওয়া যায়। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে, ‘পাগল’রা তো এমন করবেই। অথচ তলিয়ে দেখলে বোঝা যায় অনেক সময়ে বাথরুমে জল থাকে না, যথেষ্ট বাথরুম না থাকার জন্য বাথরুম ফাঁকা পাওয়া যায় না। এমন অবস্থায় কারও হাতে যদি রক্ত লাগে, তা হলে দেওয়ালে মোছা ছাড়া কোনও উপায় আছে কি? যে মেয়েরা ন্যাপকিন ব্যবহারে অভ্যস্ত নন, তাঁদের প্রশিক্ষিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে কি?

নতুন মানসিক স্বাস্থ্য আইনে বলা হচ্ছে, হাসপাতালে ভর্তি রোগীকে নিরাপদ, স্বাস্থ্যকর, জঞ্জালমুক্ত পরিবেশ দিতে হবে। মর্যাদাপূর্ণ পোশাক, সুষম খাদ্য, ঋতুস্রাব চলাকালীন মহিলাদের স্বাস্থ্যবিধি-সম্মত সহায়তা দিতে হবে। জোর করে ন্যাড়া করা যাবে না। এক পোশাক সকলকে পরতে বাধ্য করা যাবে না। রোগী চাইলে হাসপাতালের পোশাক না পরে নিজের পছন্দের পোশাক পরতে পারেন। গোপনীয়তার অধিকারও দেওয়া হয়েছে রোগীকে। আর স্পষ্টই বলা হচ্ছে, রাখা যাবে না ‘সলিটারি সেল’।

আইন আজ বলছে, রোগীকে সুরক্ষা, চিকিৎসা এবং মর্যাদা দিতে হবে। এখন প্রশ্ন, কত দ্রুত এগিয়ে আসবে সরকার? সরকারি নির্দেশ না এলে আইন কার্যকর হবে না। সর্বোপরি, সমাজ কবে সেই দাবি করবে? মনোরোগীর নির্যাতনে সমাজের সায় যে দিন থাকবে না, সে দিন বন্ধ হবে নিরপরাধের শাস্তি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

psycho patient Solitariness asylum
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE