Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Editorial News

দিক্‌ভ্রান্ত হয়ে পড়ছি না তো

হিংসার প্রকাশ বাড়ছে আমাদের ব্যক্তিত্বে। আমাদের আচরণে, আমাদের প্রকাশভঙ্গিতে, আমাদের ব্যক্তিগত ব্যবহারে তার প্রমাণ রয়েছে। সভ্যতার শিক্ষায় বা বাধ্যবাধকতায় আধুনিক মানুষ তার হিংসাত্মক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে রাখত এত দিন।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১০ জুন ২০১৮ ০০:৫৭
Share: Save:

আবার শিউরে উঠতে হল। উন্মত্ত হিংসার বীভৎস দৃশ্য গোটা অস্তিত্ব ধরে যেন নাড়িয়ে দিল। আমরা মানুষই তো? নাকি পৈশাচিক কোনও অস্তিত্ব? ধন্দ জাগল।

অসমের কার্বি আংলং জেলার ঘটনা। সোশ্যাল মিডিয়ায় দাবানলের মতো ছড়িয়েছে বীভৎসতার ছবি। অসমেরই গুয়াহাটি থেকে যাওয়া দুই পর্যটককে দেখে ছেলেধরা বলে সন্দেহ হয়েছে স্থানীয়দের। সুতরাং ঘিরে ধরে গণপ্রহার শুরু। কোনও আইন-কানুনের পরোয়া নয়, কোনও পুলিশ-প্রশাসনে খবর নয়, কোনও প্রমাণের অপেক্ষা নয়, কোনও যুক্তি-তর্কের অবকাশ নয়, ‘সন্দেহভাজনদের’ কোনও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ নয়। সন্দেহই শেষ কথা। সন্দেহ যখন হয়েছে, তখন সন্দেহভাজনদের মরতেই হবে। অতএব ভয়ঙ্কর গণপ্রহার শুরু এবং নেহাতই বেড়াতে যাওয়া দুই যুবকের বীভৎস মৃত্যু।

মুহূর্তে ব্যক্তি থেকে গোষ্ঠী হয়ে উঠল একদল লোক, মুহূর্তে একজনকে বা দুজনকে গোটা গোষ্ঠীর শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে ফেলল তারা, মুহূর্তে ‘শত্রুকে’ পৃথিবী থেকে সরিয়েও ফেলল। এক বার নয়, বার বার ঘটছে এ রকম, নানা প্রান্তে ঘটছে, কার্বি আংলং কোনও বিচ্ছিন্ন নিদর্শন নয়। এটা কি আধুনিক সভ্যতার চেহারা!

সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন

এই যূথবদ্ধ হিংসায় আমাদের সমাজ কোনও এক কালে অভ্যস্ত ছিল, সে কথা ঠিক। সভ্যতার আদি লগ্নে এ বীভৎসতা ছিল। সামাজিক ভাবেই অনেক অন্যায় ঘটানো হত। কিন্তু সমাজপতিরা বা সমাজতত্ত্ববিদরা বুঝেছিলেন, এই যৌথ অন্যায় সমর্থনীয় নয়। তাই এই যৌথ হিংসার বিরুদ্ধে বার্তা দেওয়া শুরু হয়েছিল, তা রোখার প্রয়াস হয়েছিল। কিন্তু প্রণবতা যদি থেকে যায় ব্যক্তিত্বের গভীরে, সমাজে তো তার প্রতিফলন কখনও না কখনও ঘটবেই।

হিংসামুক্ত সমাজ— সভ্যতা সেই লক্ষ্যেই পৌঁছতে চেয়েছে। পেরেওছে। যত এগিয়েছে সভ্যতা, সামাজিক হিংসার ঘটনা তত কমিয়ে আনা গিয়েছে। কিন্তু মানব সভ্যতা আজ যখন অপরিমেয় পরিসর জুড়ে বিস্তার নিয়েছে, তখন সে বিপুল বিস্তৃতির মাঝে মানবজাতিকেই দিক্‌ভ্রান্ত দেখাচ্ছে কোনও কোনও ক্ষেত্রে। কোথা থেকে শুরু করেছি যাত্রা, কোথায় এসে পৌঁছেছি, কোন পথ ধরে এসেছি, কোন দিকে এ বার আমরা যাব, কোনটা অতীত আমাদের, কোনটা সামনে রয়েছে— সে সব যেন অনেকেই গুলিয়ে ফেলছি। তাই আদিম হিংস্রতাও যেন মাঝে-মধ্যেই ছাপ ফেলে যাচ্ছে তথাকথিত আধুনিক মানবতার উপরে।

আরও পড়ুন
ছেলেধরা বলে মিথ্যে সন্দেহ, অসমে এই দুই যুবককে পিটিয়ে খুন

হিংসার প্রকাশ বাড়ছে আমাদের ব্যক্তিত্বে। আমাদের আচরণে, আমাদের প্রকাশভঙ্গিতে, আমাদের ব্যক্তিগত ব্যবহারে তার প্রমাণ রয়েছে। সভ্যতার শিক্ষায় বা বাধ্যবাধকতায় আধুনিক মানুষ তার হিংসাত্মক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে রাখত এত দিন। কিন্তু সে নিয়ন্ত্রণে যেন শৈথিল্য আসছে ক্রমে। সোশ্যাল মিডিয়া নামের এক নতুন জগৎ হাতে পেয়ে আমরা অনেকেই যেন অবদমিত হিংসা, ঘৃণা, বিদ্বেষের প্রকাশ ঘটাতে শুরু করে দিয়েছি।

যা কিছু আমাদের অপছন্দ, তার বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়ায় আমরা মতামত দিই কোন ভাষায়? পাড়ার মুদির দোকানে গিয়ে বা বাজারে মাছ বিক্রেতার সঙ্গে দর কষাকষি করার সময় যে ভাষা আমরা প্রয়োগ করি না নিজেদের মান-সম্মানের কথা ভেবে, সোশ্যাল মিডিয়ায় অক্লেশে লিখে ফেলি সেই সব কথাই। কেউ কেউ একটু গোপনে লিখি। ‘অসীম আকাশ’ বা ‘একলা নদী’ বা ‘সবুজ অরণ্য’ জাতীয় কাল্পনিক নামে হয়তো সোশ্যাল মিডিয়ায় বিরাজ করেন কেউ, মন্তব্যে বা সোশ্যাল পোস্টে হয়তো হিংসা বা ঘৃণার তীব্র বিষ ঝরান, আর আমরা হয়তো জানতেই পারি না ওই ‘অসীম আকাশ’ বা ‘সবুজ অরণ্য’ আসলে আমাদেরই পাড়ার অমুক কর্মকার বা পাশের পাড়ার তমুক মিত্র। কেউ কেউ আবার স্বনামেই ঘৃণা বা বিদ্বেষ ছড়াই।

আজ থেকে চার-পাঁচ বছর আগেও কিন্তু বোঝা যেত না, আধুনিক মানুষের মনে হিংসার বিষ এতখানি। সোশ্যাল মিডিয়া হাতে হাতে পৌঁছে যাওয়ার আগে পর্যন্ত কিন্তু বোঝা যায়নি, নিজেদের ব্যক্তিত্বে এত ঘৃণা, এত দ্বেষ পুষে রেখেছেন আধুনিক মানুষ। আজ বোঝা যাচ্ছে। অশনি সঙ্কেতটাও টের পাওয়া যাচ্ছে।

প্রত্যেক ব্যক্তি বা অনেক ব্যক্তি যদি নিজের নিজের ব্যক্তিত্বে এত হিংসা-ঘৃণা-দ্বেষ পুষে রাখেন এবং কোনও না কোনও উপায়ে তার প্রকাশ ঘটাতেও যদি অভ্যস্ত হয়ে পড়েন, তা হলে হিংসার প্রকাশ যে সামাজিক বা যৌথ রূপও অচিরেই নেবে, সে কথা বলাই বাহুল্য।

ভেবে দেখার সময় হয়েছে অতএব। সভ্যতার কোনও পরিসরে আমাদের অনিয়ন্ত্রিত, অপরিশীলিত ও হিংস্র আচরণ আমাদের ঠেলে দিচ্ছে না তো কোনও অতীত অন্ধকারের দিকে? গুরুতর কোনও গলদ কোথাও রয়ে যাচ্ছে না তো? সমাজতত্ত্ববিদদেরও এগিয়ে আসতে হবে। এই পরিস্থিতির আশু সমাধান জরুরি। না হলে আমরাই বিপন্ন হব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE