Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
ইতিহাসকে অন্য দৃষ্টিতে দেখার অধিকার শিল্পের অবশ্যই আছে

দুই দলেই তর্ক ভুল

‘পদ্মাবতী’ সিনেমাটা আর কিছুই নয়, পদ্মিনী চরিত্রটিকে কেন্দ্র করে এমনই আরও একটি গল্প, যা বলিউডি ভংসালী ঘরানায় ‘লাগ ঝমাঝম’ ভঙ্গিতে বলা, এটা না বুঝতে পারলে, ইতিহাসের দোহাই দিয়ে একধারসে ‘সতী মাই কি জয়’ গাইতে বসলে, তাই গোড়ায় গলদ হয়ে যায়।

ঈপ্সিতা হালদার
শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০১৭ ০১:২৬
Share: Save:

আমাদের জাতের স্বাভিমানে চুনকালি লেপা হয়েছে, আমাদের দেবী মা পদ্মাবতীকে মন্দিরের পাদপীঠ থেকে নামিয়ে করে তোলা হয়েছে বাহরওয়ালি নাচনি, তাই পরিচালকের মুণ্ড চাই’— এই গর্জন ফলিয়ে সাম্প্রদায়িক রোষের উদ্দাম নৃত্য কলকাতাতেও হল। মুশকিল হল, এই দেশে ছবির নাম ‘বিল্লু বারবার’ হলে পরামানিকদের মানে লেগে যায়, ‘পদ্মাবতী’ হলে রাজপুতদের মানে লেগে যায়। এ সব দেখে মনে পড়ে অম্বেডকরের ১৯৩৬-এ না দিতে পারা বক্তৃতা ‘অ্যানাইহিলেশন অব কাস্ট’-এর কথা, যেখানে তিনি বলেছিলেন, হিন্দু সমাজ জেগে ওঠে শুধু ‘জাত’ হিসেবে, নেশন-এর একক ‘জাতি’ হিসেবে নয়। পদ্মাবতী বিতর্ক নিয়ে টিভি চ্যানেলে টক শো-য়, নিজেদের ইতিহাসের অভিমান রক্ষায় করণী রাজপুত মুখিয়ারা দীপিকা পাড়ুকোনের নাক-কান কেটে ফেলার নিদান দিলেন। মেবারের ইতিহাস নিয়ে এত গুমর তাঁদের, কিন্তু যখন জিজ্ঞেস করা হল, কোন সনে আলাউদ্দিন খিলজি মেওয়ার দখল করেছিলেন, উত্তর দিতে পারলেন না। উলটে অনুষ্ঠানের সেটেই তলোয়ার উঁচিয়ে রণং দেহি ভঙ্গিতে বললেন, আসলি অভিমান হল, আমাদের দেবী ষোলো হাজার রাজপুত নারী নিয়ে জওহর ব্রত করেছিলেন, সতীত্ব রক্ষায় স্বেচ্ছায় অগ্নিপ্রবেশ।

আমরা ইতিমধ্যে পণ্ডিতদের কাছে জেনেছি, এমনকী মহাফেজখানায় রক্ষিত দলিল-দস্তাবেজও ইতিহাসকে প্রামাণ্য করে তুলতে পারে না। তথ্যের মধ্যেও পক্ষপাত থাকে। এবং শুধু তথ্যই ইতিহাস নয়, মানুষের মুখে মুখে ফেরা কথা— লোকশ্রুতি লোককাহিনি প্রবাদ প্রবচন— এ সবও ইতিহাস। এই যে আর্কাইভে যা আছে, তার সঙ্গে মানুষজনের পিছল স্মৃতিতে যা রয়েছে, সবটা মিলিয়েই ইতিহাস তৈরি হয়— কথাটা বলার উদ্দেশ্য: ইতিহাস বলতে যে একমাত্রিক একটা ব্যাপার বোঝাত, আর সাধারণ মানুষের কথা বাদসাদ দিয়ে সে যে বিরাট বলদর্পী সিংহাসন দখল করে ছিল, সেইগুলোকে চ্যালেঞ্জ করা। কিন্তু এ বার যদি তাকে কেউ এ ভাবে বোঝেন: আর্কাইভ পুরোপুরি মিথ্যা, শুধু লোকে যা বিশ্বাস করেন তা-ই সত্য, এবং আমার জাতের লোক যা বিশ্বাস করেন তা অন্য জাতের স্মৃতির চেয়ে বেশি সত্য— তা হলে সব কিছুই বিচ্ছিরি রকম গুলিয়ে দেওয়া যাবে।

এই আগ্রাসী জাত্যভিমানীদের বিরুদ্ধে আসল যুক্তিটা আলাদা। ইতিহাস ও লৌকিক চেতনার চাপান-উতোরে সেই যুক্তিটি হারিয়ে যেতে থাকে। তা হল, কোনও শিল্পমাধ্যমই ইতিহাসকে প্রামাণ্য হিসেবে পেশ করে না। ইতিহাসকে সে নানা ভাবে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে, ইতিহাসকে ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করে গল্প বুনতে চায়। যে চরিত্র বা যে ঘটনা সাধারণত প্রবল গুরুত্ব পেয়ে এসেছে, তার বদলে অন্য কারও ওপর, বা অন্য ঘটনার ওপর স্পটলাইট ফেলে। প্রচলিত, প্রতিষ্ঠিত কাহিনিকে ও তার অন্তর্নিহিত মতামতকে প্রশ্ন করে, আক্রমণ করে, এমনকী তাকে একেবারে উলটে দিয়ে দেখতে চায়। মুশকিল হল, শিল্পের স্বাধীনতা নিয়ে কথা না বলে, তার ইতিহাসকে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার অধিকার আছে তা না বলে, সঞ্জয় লীলা ভংসালীর বন্ধুরাও এখন বলছেন, ভংসালী তিলমাত্র অপলাপ করেননি রাজপুত স্বাভিমানের। ভারতীয় দূরদর্শনের সভাপতি এবং মুখ্য সম্পাদক রজত শর্মা হলফ কেটে বলছেন, ভংসালীর গবেষণা পুরোপুরি ইতিহাস-অনুগ, বর্ণে বর্ণে বাস্তবনিষ্ঠ। তিনি রাজপুতদের ডাক দিচ্ছেন, ছবি দেখতে এসো, দেখবে, মোটেও এই ছবিতে পদ্মাবতীর স্বামী মেবার-রাজ রতন সিংহ ডরপোক নয়। আলাউদ্দিন খিলজিই নারীলিপ্সু কুচক্রী, আদত হিরো রাজপুত-সিংহই। ছোটবেলা থেকে ঠিক যেমনটা শুনেছি, পড়েছি, ভংসালীর ‘পদ্মাবতী’ হুবহু তাই, কোনও বিকৃতি নেই। সুভাষ ঝা বলছেন, সত্যিই মেবার রমণীরা নাচতেন, কিন্তু অন্তরালে জেনানা রানিবাসে, রাজা ছাড়া আর কোনও দর্শকই থাকত না। সিনেমায় যে ‘ঘুমার’ নাচের দৃশ্য আছে, তাতে কোনও বাইরের মরদ নেই। তাই, ইতিহাস-বিকৃতি তো ঘটেইনি, বরং যে পরিমাণ জাঁকজমকে এখানে জওহর ব্রত পালন হয়েছে তা আজ অবধি সিনেমায় দেখানো সতীর চিতায় ওঠার দৃশ্যগুলির মধ্যে মহত্তম।

শুনে মনে হয়, ‘ইতিহাস বিকৃত করা হয়নি’ বলতে গিয়ে, ‘ছোটবেলা থেকে যা শুনে এসেছি তাকে বিকৃত করা হয়নি’ বলতে গিয়ে, আমরা এটাই বলছি না তো, যে, ছোটবেলা থেকে যা শুনে এসেছি শিল্পী তার অন্যথা করতে পারেন না? বা, ইতিহাসকে কোনও ভাবেই অন্য দৃষ্টিতে দেখার অধিকার কারও নেই? আমরা এক রাজপুত রাজা, তাঁর রূপসি রানি, আর খিলজিকে নিয়ে ত্রিকোণ আকাঙ্ক্ষার মুখফেরতা কাহিনিকে লাহৌর থেকে আরাকান অবধি নানা ভাবে বয়ে চলা একটি বহুধারা প্রবাহ হিসেবে না দেখে, নানা অনুবাদ চয়ন পরিবেশন আর তার বহু রূপ নিয়ে কথা না বলে, শেষ পর্যন্ত একটা ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু বয়ানকেই প্রতিষ্ঠা করে ফেলছি না তো? যেখানে মুসলমান আসল শত্রু, আর সতীর চিতায় চাপা ভারতীয় সভ্যতার চূড়ান্ত অহমিকা, যাকে প্রশ্নই করা যাবে না? এই যে বার বার এ কথা বলে আশ্বস্ত করা হচ্ছে যে ভংসালীর ইতিহাস-গবেষণা ত্রুটিহীন, তাতে যে-কাব্য ‘অবলম্বনে’ এই ফিল্মটি তৈরি— মালিক মুহম্মদ জয়সি রচিত ‘পদুমাবত’— হরেদরে তা ইতিহাসের অটুট আর্কাইভ হয়ে দাঁড়ায় না তো? তা হলে, সেই যুক্তিগুলোয় হয়তো এই সিনেমা রক্ষা পেলেও পেতে পারে, কিন্তু শিল্পমাধ্যম যে ঐতিহাসিক পুরাতাত্ত্বিক মৌখিক যে কোনও সূত্রপ্রসঙ্গ নিয়েই আখ্যান তৈরি করতে পারে, আর সেই সূত্রগুলির কপিরাইট নেই তাই তা ভাঙা কক্ষনও দূষণীয় নয়— এই জরুরি কথাগুলো অস্পষ্ট থেকে যায়। এবং তা হলে, ভবিষ্যতে এই স্বাভিমানী দাঙ্গাবাজদের প্রশ্রয়ের ভিত গড়ে দেওয়া হয়।

মোল্লা দাউদের ‘চন্দায়ন’, শেখ কুতবান সোহরাওয়ার্দির ‘মৃগাবতী’ বা শেখ মঞ্ঝান শাত্তারির ‘মধুমালতী’-র মতোই জয়সির ‘পদুমাবত’ একটি সুফি প্রেমোপাখ্যান (১৫৪০)। মধ্যযুগে আঞ্চলিক দরবারগুলি ফারসি, সংস্কৃত, গুর্জরি, ব্রজ, অওয়ধি বা বাংলায় কাব্য রচনার পৃষ্ঠপোষকতা করত। শের শাহের আজ্ঞাধীন অমেঠীর অঞ্চলশাসক জয়সিকে কাব্য রচনার ভার দেন। সুফি ইশক নাথ যোগতত্ত্ব কেন্দ্রিক এই গাথা অমেঠী থেকে মেবার অবধি ছড়িয়ে যেতে লাগে মোটামুটি পঞ্চাশ বছর। একই সঙ্গে নানা দরবারে নানা দিকে ছড়িয়ে পড়ে তা, নানা আঞ্চলিক ভাষায়। বহু প্রচলিত কাব্য রচনা ঘরানায় লেখা হতে থাকে পদ্মিনী উপাখ্যান, প্রচারিত হতে থাকে মুখে মুখে। কে-ই বা আর তখন ভাবত কাব্য বা লোকগাথা শুনছি, না ইতিহাস? আবার লোকশ্রুতিই তো বাস্তব তখন।

তবে যখন থেকে পদ্মিনীর কাহিনি চিতোর উদয়পুরের রাজপুত বংশাবলির অন্তর্গত হয়ে পড়ে, তখন থেকে এতাবৎকালের কবির গীতিকারের পদ্মিনী হয়ে যান মেবারের ঐতিহাসিক রাজপুত মহিষী, যাঁর উপর লালসার দৃষ্টি পড়েছিল খিলজির। উনিশ শতকে চারণ গীতিকারদের থেকে যেমন, তেমনই এই সব বংশাবলি থেকে সূত্র নিয়ে জেমস টড রচনা করেন রাজপুতানার ইতিহাস, ‘অ্যানালস অ্যান্ড অ্যান্টিকুইটিজ অব রাজস্থান’ (১৮২৯, ১৮৩২), যার রোম্যান্টিক প্রাচ্যবাদী নির্ঝর অভিভূত করে দেয় হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (পদ্মিনী উপাখ্যান, ১৮৫৮), জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর (সরোজিনী বা চিতোর আক্রমণ, ১৮৭৫), ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ (পদ্মিনী, ১৯০৬) থেকে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে (রাজকাহিনী, ১৯০৯)। এই আবেগের শরিক হন বঙ্কিম ও রমেশচন্দ্র দত্ত। হিন্দু জাতীয়তাবাদের উন্মেষে হিন্দু-মুসলমানের সরলরৈখিক মেরুকরণের ভয়াবহ উৎসব শুরু সেখানেই। সেই গল্পগাছাগুলির কোনওটিই ইতিহাস নয়, অথচ প্রতিটিই দাবি করে কাহিনির ঐতিহাসিকতা।

সে ভাবেই জয়সির কাহিনিতে নিহিত নিগূঢ় মরমিয়াবাদ আর লৌকিক-অলৌকিকের জটিল যোগ সাধারণ চ্যাপ্টা ধাঁচের ইতিহাসই হয়ে যায়, আর তা থেকে তৈরি আরও আখ্যানগুলি সেই ইতিহাসের বৈধতায় নিজেরা ইতিহাস হয়ে উঠতে চায়। ‘পদ্মাবতী’ সিনেমাটা আর কিছুই নয়, পদ্মিনী চরিত্রটিকে কেন্দ্র করে এমনই আরও একটি গল্প, যা বলিউডি ভংসালী ঘরানায় ‘লাগ ঝমাঝম’ ভঙ্গিতে বলা, এটা না বুঝতে পারলে, ইতিহাসের দোহাই দিয়ে একধারসে ‘সতী মাই কি জয়’ গাইতে বসলে, তাই গোড়ায় গলদ হয়ে যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE