Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

বহুরূপধারিণী

দেবী প্রথমে ধরা দেন বৈষ্ণব ধর্মে, সেখানে তিনি দেবকীর গর্ভসম্ভূত, শ্রীকৃষ্ণের অগ্রজা। কংস সেই শিশুকন্যাকে বধ করিতে উদ্যত হইলে তিনি পূর্ণ যুবতীর রূপ ধারণ করিয়া আকাশে উঠিয়া অট্টহাস্য করেন।

শেষ আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০১৮ ০০:৪৮
Share: Save:

অষ্টমী বা নবমীর অঞ্জলি নহে, পরিচিতির বহুত্বকে স্বীকার না করিলে শারদীয়ার দেবীপূজা বৃথা। দুর্গা কেবল মহিষাসুর, শুম্ভ-নিশুম্ভ বধের দশপ্রহরণধারিণী নহেন। তাঁহার পরিচিতিতে অরণ্যচারী হইতে বৈষ্ণব, শৈব, শাক্ত, নানা রূপ মিশিয়া আছে। দেবী প্রথমে ধরা দেন বৈষ্ণব ধর্মে, সেখানে তিনি দেবকীর গর্ভসম্ভূত, শ্রীকৃষ্ণের অগ্রজা। কংস সেই শিশুকন্যাকে বধ করিতে উদ্যত হইলে তিনি পূর্ণ যুবতীর রূপ ধারণ করিয়া আকাশে উঠিয়া অট্টহাস্য করেন। নিদ্রা বা কালরাত্রি নামে চতুর্ভুজা ও অষ্টভুজা এই দেবী পূজা পাইতেন, সাম্রাজ্যের প্রান্তে বিন্ধ্য পর্বতের অরণ্যে বিন্ধ্যবাসিনী রূপে তিনি অধিষ্ঠান করিতেন। সেই সময় অরণ্যচারী শবররাই ছিলেন তাঁহার উপাসক। প্রাচীন ভারত এই বিন্ধ্যবাসিনীকে চিনিত, বাংলার তাম্রলিপ্ত বন্দরে বর্গভীমা মন্দিরে আজও তাঁহার নিত্য উপাসনা। কালক্রমে এই প্রান্তিক দেবীই ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রে স্বীকৃত হইলেন, অসুর বধের পর বৈদিক ইন্দ্র তাঁহার মস্তকে রাজছত্র ধরিলেন। শবর-পূজিত, অরণ্যচারী দেবীকে রাজবেশে সাজাইয়া দেন দেবরাজ স্বয়ং। মহিষাসুর যে মহিষের রূপ ধারণ করিয়া যুদ্ধে আসেন, সেই মহিষ কি কেবল একটি তৃণভোজী, চতুষ্পদ প্রাণী? ঋগ্বেদের ভাষ্যকার সায়ন জানান, মহিষ অর্থে যে কোনও পশু। অরণ্যচারী শবরেরা দেবীর পদতলে পশুবলি দিত। আজকাল দলিতের উপর সহস্র অত্যাচার দেখিয়াও যে সকল শক্তিমানরা নীরব থাকেন, তাঁহারা আর যাহাই হউন, শক্তিসাধক নহেন।

সিংহবাহিনী, অরণ্যচারী দেবীটির কাছে শুধু বৈদিক ইন্দ্রই নতি স্বীকার করিলেন না, তাঁহার বৈষ্ণব জন্ম ক্রমে প্রবিষ্ট হইল শৈব ধর্মে। দেবী হইয়া উঠিলেন হিমালয়সুতা উমা, শিবের ঘরনি। হিন্দুধর্মে পূজার ইতিহাসটিই বলিয়া দেয়, বৈষ্ণব বনাম শৈব সাম্প্রদায়িকতার স্থান এখানে নাই। দুইয়ের মধ্যে আদানপ্রদান চলিয়াছে, হিন্দু ধর্ম দেবীর সব চারিত্র অক্ষুণ্ণ রাখিয়া পরিচিতির বহুত্বকে স্বীকার করিয়া লইয়াছে। প্রাচীন কালে দেবীর পূজা হইত জন্মাষ্টমীর ভাদ্র মাসে, ক্রমে রাজাদের দিগ্বিজয়ের মাস আশ্বিনে। তিনি কেবল বৈষ্ণব বা শাক্ত, এই জাতীয় বন্ধনীতে দেবীকে হিন্দু ধর্ম সঙ্কুচিত করিয়া দেয় নাই, পরিচিতির বহুত্বকে স্বীকার করিয়া লইয়াছে। এই বহুপরিচিতিই দেবীকে প্রকৃত প্রস্তাবে সর্বভারতীয় করিয়াছে। তাই বৈদিক যজ্ঞ ও বামাচারী তান্ত্রিক উপচার দুই-ই মিশিয়া গিয়াছে তাঁহার পূজাপদ্ধতিতে। অষ্টমীতে অঞ্জলির আগে কোষাকুষি ও নানাবিধ উপচার শুদ্ধ করার যে ‘ভূতশুদ্ধি’, মস্তকে গঙ্গাজল ছিটাইয়া নিজেকে শুদ্ধ করিবার যে ‘ন্যাস’, তাহা তন্ত্রের অবদান। বিজয়া দশমীর শেষে জলে দেবীর বিসর্জনের প্রথাটি আসিয়াছে কামরূপ হইতে।

এই বহুপরিচিতির কারণেই মিথিলা হইতে দক্ষিণের বিজয়নগর অবধি সর্বত্র ছড়াইয়া আছে প্রাচীন ও মধ্য যুগের নানা দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী। মিথিলার পূজা-উপচারে বোধনের দিন একটি বিল্ববৃক্ষের শাখায় দেবীর মূর্তি গড়ার কথা আছে। সেখানে বৃক্ষশাখা কাটিতে গিয়া প্রথমে অঞ্জলি দিতে হইবে, হে বৃক্ষ, তুমি যন্ত্রণা পাইয়ো না, অপরাধ লইয়ো না। আমরা কেবল পূজার নিমিত্ত একটি শাখা কাটিব। বাঙালি যাঁহাকে কলাবৌ বলে, তিনি নিছক গণেশপত্নী নহেন। নবপত্রিকার নয়টি গাছ তথায় নয় শক্তির প্রতীক। কলার অধিষ্ঠাত্রী দেবী ব্রহ্মাণী, কচুর কালী, হরিদ্রার দুর্গা, জয়ন্তী কার্তিকী, বেল শিবা, ডালিম রক্তদন্তিকা, অশোক শোকরহিতা, মানকচু চামুণ্ডা ও ধান লক্ষ্মীর প্রতীক। অরণ্যজন হইতে গাছপালা, পরিবেশ সকলের প্রতি হিন্দুর দুর্গাপূজা মমত্বশীল ছিল, এখন সবই বর্ণাঢ্য থিম-পূজায় পর্যবসিত হইয়াছে। থিমপূজা থাকুক, কিন্তু দুর্গার এই শাস্ত্রসম্মত বহু পরিচিতিটিও স্মরণে রাখা জরুরি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Festival Durga Puja Durga Puja 2018
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE