রাবণ চন্দ্রশেখর আজ়াদ। ভীম দলের এই নেতা শিরোনামে। রাম রাজনীতির মাত্রার সঙ্গে সমান তালে উত্তাল রাবণ রাজনীতিরও, পুরোভাগে অবশ্যই চন্দ্রশেখর। তাঁর আন্দোলনের মূল কথা বর্ণহিন্দুদের ধর্মকেন্দ্রিক আচরণ, জাতপাত, রাজনীতির বলিষ্ঠ প্রতিবাদ। এমনকী গত কয়েক বছরে তাঁর যে ছবিটা আমরা চিনি, সেই সযত্নেলালিত গোঁফটিও রেখেছিলেন হিন্দি বলয়ে গোঁফ রাখার অপরাধে দলিত যুবককে খুনের ঘটনার প্রতিবাদে।
রাম বনাম রাবণ রাজনীতি, রাম বনাম না-রাম রাজনীতি, অথবা আলি বনাম বজরংবলী রাজনীতি— নানা ভাবে ভারতের ভাগ্যে সিঁদুরে মেঘের আনাগোনা। তবে রাবণ রাজনীতির এই উত্থান ঠিক আজকের বিষয় নয়, এক ইতিহাস আছে তার। সেই ইতিহাস প্রায় একশো বছরের পুরনো।
১৯২০ সালে পেরিয়ার ই ভি রামস্বামীর উত্থান, অনেকটা চন্দ্রশেখরের ধরনের। তামিলনাড়ুতে হিন্দুত্বের জাতপাত, বর্ণহিন্দুত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তোলেন পেরিয়ার আর তাঁর দল দ্রাবিড় কজ়ঘম। বর্ণহিন্দুদের দেবতা রামচন্দ্র, তাই রাবণই প্রতিবাদের চিহ্ন হয় পেরিয়ারের। বর্ণহিন্দুদের ‘কাম্বা রামায়ণ’-এর উল্টো দিকে পেরিয়ার লেখেন ‘রামায়ণ পাথিরাঙ্গাল’ (১৯৪৪), ‘রামায়ণ ট্রু রিডিং’ (১৯৫৬), ‘রামায়ণ কারিপ্পুগাল’ (১৯৬৮)। বিরোধিতা বাড়তে থাকে, ’৫৬ নাগাদ রামের ছবি পোড়াতে শুরু করেন পেরিয়ার সমর্থকরা।
চন্দ্রশেখরের সঙ্গে এখানেও মিল পেরিয়ারের। তুমুল জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও রাজনীতি থেকে, নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে দূরেই ছিলেন পেরিয়ার, পেরিয়ারের সমর্থকরা। বর্ণহিন্দুদের বিরুদ্ধে, জাতপাতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ— এমনটাই ছিল পেরিয়ারের আন্দোলনের মুখ, যেমন চন্দ্রশেখরের ভীম দলেরও।
চন্দ্রশেখরের অযোধ্যায় রামজন্মভূমিতে সংবিধান হাতে যাওয়া ইতিমধ্যে বহু আলোচিত। রাবণ রামজন্মভূমিতে গেলেন এবং গেলেনও না। চন্দ্রশেখর সংবিধানের অধিকার চাইলেন, রাজনীতির ময়দানে, এখনও অবধি রাজনীতির স্পর্শ বাঁচিয়ে পেরিয়ার রাজনীতিতে তেমনই এক বিন্দু— ১৯৭১ সালে সালেমে। তার আগে ১৯৭০ সালে, জরুরি অবস্থায়, তাঁর ‘রামায়ণ ট্রু রিডিং’ নিষিদ্ধ হয়েছে উত্তরপ্রদেশে। তা নিষিদ্ধ থাকে ১৯৭৬ সালে সুপ্রিম কোর্টের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া অবধি।
তামিলনাড়ুর রাজনীতিতে পাশে পাশে ঘটেছিল কিছু ঘটনা। সি এন আন্নাদুরাই, ডিএমকে’র প্রতিষ্ঠাতা ১৯৪৭ সালেই লিখেছিলেন ‘নিডি থেভান মায়াক্কাম’ যেখানে রাবণ তাঁর আত্মপক্ষ সমর্থনের জোরালো সুযোগ পান। সেখানে একে একে সেই সব চরিত্ররা আসেন, যাঁরা রামের মহাকাব্যিক উচ্চতাকে প্রশ্ন করেন। যেমন রামের দ্বারা নিহত শূদ্র শম্বুকের মা, বা সীতা। এই লেখাকে ভিত্তি করেই এম আর রাধা লেখেন ‘রামায়ণ’ নামের নাটক, যার মূল প্রতিপাদ্য স্বয়ং রাবণ। প্রবল জনপ্রিয়তা পায় নাটকটি। এই জনপ্রিয়তায় ক্ষুণ্ণ হন তামিলনাড়ুর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী কে কামরাজ। নাটকটি নিষিদ্ধ হয়। নতুন নিয়ন্ত্রণী আইন প্রণীত হয়।
এ বার রাবণের সপক্ষে সামনে আসেন আন্নাদুরাইয়ের রাজনৈতিক শিষ্য এম করুণানিধি। ‘মুরাসোলি’ সংবাদপত্রে ‘রামায়ণ’ নাটকের পক্ষে, রাবণের পক্ষে এবং অবশ্যই নাটকের স্বাধীনতার পক্ষে তাঁর নিয়মিত কলাম জনপ্রিয় হয়। বাড়তে থাকে রাবণমাহাত্ম্য চর্চা। পেরিয়ার, আন্নাদুরাই হয়ে করুণানিধি, ডিএমকে দলের আধিপত্য এবং রাবণের অস্তিত্বের শক্তি প্রায় সমার্থক হয়ে ওঠে।
প্রতিরোধে নামে তৎকালীন প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কংগ্রেস এবং সেই প্রতিবাদের চিহ্ন হয় রাম রাজনীতি। কংগ্রেসের সি রাজাগোপালচারী ‘কল্কি’ পত্রিকায় নিয়মিত ভাবে লিখতে থাকেন রাম চরিত্রের আখ্যান। রাজাগোপালচারী ‘অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো’তেও নিয়মিত এ বিষয়ে বলতে থাকেন এবং রামায়ণ প্রোটেকশন স্কোয়াডও গড়ে তোলেন।
কংগ্রেসকে পিছু হটতে হয়। রাবণ রাজনীতির মঞ্চে প্রথমে আন্নাদুরাই, তার পর করুণানিধিকে মুখ্যমন্ত্রী করে। এর এক বছরের মধ্যে জরুরি অবস্থা ঘোষণা এবং আবারও রাবণ রাজনীতির সামনে আসা। ১৯৭০ সালে পুলাভার কুলানথাইয়ের ‘রাবণ কবিয়াম্’-এর উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন করুণানিধি এবং বহু বছর পরে এই প্রথম বার বর্ষীয়ান পেরিয়ার সামনে আসেন আবার। রামের ১০ ফুট মূর্তি সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়। অসংখ্য মানুষ, উত্তাল সমর্থন, সামনে থাকেন দ্রাবিড় কজ়ঘমের সদস্যরা। রামের মূর্তি পোড়ানো সমার্থক হয় হিন্দি বলয়ের আগ্রাসনের, কংগ্রেসের চাপিয়ে দেওয়া জরুরি অবস্থার সপাট প্রতিরোধের সঙ্গে।
এর পর নব্বইয়ের দশক, রামজন্মভূমি বাবরি মসজিদ বিতর্ক এবং ৬ ডিসেম্বর। দাক্ষিণাত্যেও তার প্রকোপ পড়ে। রামগোপালন তৈরি করেন হিন্দুত্ববাদী মঞ্চ— হিন্দু মুন্নানী। বর্ণহিন্দুত্বের উত্থানে আবারও অসংখ্য রাম কুশপুত্তলিকা ভস্মীভূত হয়। আবারও সামনে আসে ‘রাবণ’। করুণানিধি ঘোষণা করেন, রাবণের অপমান মানা হবে না। ‘‘রাবণকে অপমান করা মানে আমাকে অপমান করা।’’
ইতিহাস পুনরাবৃত্ত হচ্ছে। পেরিয়ার আন্নাদুরাই করুণানিধি যা পেরেছিলেন, চন্দ্রশেখর ‘রাবণ’ আজ়াদ তা পারবেন কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy