ত্রিগুণা সেন।
জার্মানি ১৯৩০-৩১। মিউনিখের একটি রেস্তরাঁয় খেতে আসতেন নিরামিষাশী হিটলার। সস্তায় ভাত-ডালের আশায় ভারতীয় ছাত্রদেরও সেখানে আনাগোনা। ভারত ও আফ্রিকার ছাত্রদের তিনি ঘোর অপছন্দ করেন জেনেও এক দিন রেস্তরাঁয় বসে ভারতের এক গবেষক-ছাত্র তাঁকে বলেন, ‘‘আমরা যা রোজগার করি তার সবটাই এখানে খরচ হয়, তাতে কিন্তু আপনাদেরই লাভ।’’ পেশায় ইঞ্জিনিয়ার ওই তরুণ ভারতীয় গবেষক-ছাত্র তখন বিদেশি ছাত্রদের সংসদের সভাপতিও বটে। ১৯৩০-এ রবীন্দ্রনাথের জার্মানি সফরের সময় তাঁরই উদ্যোগে মঞ্চস্থ হয় ‘চিত্রাঙ্গদা’, নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন ওই ছাত্রনেতা স্বয়ং!
স্টুডেন্ট কার্ড দেখিয়ে সস্তায় জিনিসপত্র কেনা তখন বিদেশি ছাত্রদের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে জার্মানিতে। এক বার এক হিটলারপন্থী জার্মান ছাত্রনেতাকে বুঝিয়েসুঝিয়ে, তাঁর নেশাগ্রস্ত অবস্থার সুযোগে, ভারতীয় গবেষক-ছাত্রনেতাটি তাঁকে দিয়ে সই করিয়ে নিলেন ওই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে। স্টুডেন্ট কার্ড ফের চালু হল বিদেশিদের জন্য। সেই ছাত্রনেতাই পরবর্তী কালের ছাত্রদরদি ও গভীর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন শিক্ষাবিদ ত্রিগুণা সেন (ছবিতে)।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য তথা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ত্রিগুণা সেনকে নিয়ে একটি মৌখিক ইতিহাস প্রকল্পের সূত্রে এমন বহু অজানা কাহিনির সন্ধান পেয়েছিলাম, যার কিছু কিছু স্থান পেয়েছে সম্প্রতি জাতীয় শিক্ষা পরিষৎ প্রকাশিত লেসনস ইন লিভিং, স্টোরিজ় ফ্রম দ্য লাইফ অব ত্রিগুণা সেন বইটিতে। ওই প্রকল্পে অংশ নিতে গিয়ে আমার বার বার মনে হয়েছে, ত্রিগুণা সেনের জীবনের খোঁজে এমন অনেক গল্প উঠে আসছে, আজকের ভারতে উচ্চশিক্ষা নীতি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বাধিকার প্রসঙ্গে যার গুরুত্ব অপরিসীম।
যেমন হিউম্যানিটিজ় চর্চার বিষয়টা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রয়াত অধ্যাপক পীযূষ সোমের কাছে শুনেছিলাম, কী ভাবে ত্রিগুণা সেন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষকদেরও সমাজতত্ত্বের বই পড়তে উৎসাহিত করতেন যাতে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সামাজিক প্রতিষ্ঠানে মানবমনের সংবেদনশীল কারবারি হয়ে উঠতে পারেন। পঞ্চাশের দশকে যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্রদের জন্য ‘মডার্ন ওয়ার্ল্ড’ নামে ইতিহাসের মডিউল বা পাঠ-একক তৈরি করে দিয়েছিলেন অধ্যাপক সুশোভন সরকার। বিজ্ঞান ও কারিগরি বিদ্যার ছাত্ররা বাংলা সাহিত্য পড়তেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, ইংরেজি প্রফুল্ল গুহ ও সংস্কৃত গৌরীনাথ শাস্ত্রীর কাছে। পেশায় ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য শঙ্কর সেন আমাকে বলেছিলেন, ১৯৮৬ সালে তিনি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বে আসেন, তখন প্রতি দিন সকালে এক বার করে আর্টস আর সায়েন্স বিল্ডিংগুলোর দিকে যেতেন কারণ প্রথম উপাচার্য তাঁকে আলাদা করে বলেছিলেন, ‘‘তুমি আর্টস আর সায়েন্সকে একটু নজর দিয়ো।’’
ত্রিগুণা সেন বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছিলেন ১৯২৬ সালে। চল্লিশের দশকে অধ্যক্ষ হয়ে আসেন ওই প্রতিষ্ঠানেরই উত্তরসূরি যাদবপুরের কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনলজি-র, ১৯৫৬-য় যা থেকে উদ্ভব যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের। জাতীয় শিক্ষা পরিষৎ প্রবর্তিত ওই ইনস্টিটিউটে কারিগরি বিদ্যা চর্চার পাশাপাশি হিউম্যানিটিজ় চর্চার ওপর ছিল বিশেষ জোর। শিবপুরের বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে এখানেই যাদবপুরের একটা বড় তফাত ছিল। ইতিহাস, দর্শন, ভাষা-সাহিত্য, ও শিল্পকলা বিষয়ে নিয়মিত বক্তৃতা দিতেন বহু বিশিষ্ট মানুষ। মনে করা হত, ছাত্ররা যখন ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বেরোবেন তখন তাঁরা যেন সমাজসংস্কৃতি সচেতন মানুষ হয়ে বেরোন। ত্রিগুণা সেন যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দশ বছরে তার দায়িত্বে ছিলেন, তখন সেই ধারাকেই নানা ভাবে পুষ্ট করবার চেষ্টা করেছেন। এমনকি কলা বিভাগের ছাত্রীছাত্রদের জন্যেও চালু করেছিলেন ‘এভরিডে সায়েন্স’ নামক একটি বিষয়। সত্তরের দশক থেকে ক্ষীণ হতে হতে এই ধারা এখন বিলুপ্ত বলা যায়।
সারা বিশ্বে যখন হিউম্যানিটিজ়ের বিষয়গুলো উপেক্ষিত, কলা বিভাগগুলো আর্থিক দৈন্যে ভুগছে, কারিগরি ও ম্যানেজমেন্টের ছাত্রীছাত্রদের তুলনায় হিউম্যানিটিজ়ের ছাত্রীছাত্র ও শিক্ষকদের নিচু নজরে দেখা হচ্ছে, কারণ তাঁদের টাকা রোজগারের ক্ষমতা কম, তখন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বর্ষীয়ান অধ্যাপকরা, যাঁরা আজ বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির সঙ্গে উপদেষ্টা হিসেবে যুক্ত, ত্রিগুণা সেন প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে আক্ষেপ করছেন: আজকের পাশ-করা ইঞ্জিনিয়ারদের অধিকাংশেরই সমাজতত্ত্ব সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই, ক্লাসরুমে যে সমস্যার ফর্মুলা আলোচিত হয়নি, নিজে ভেবে তার তল অবধি পৌঁছতে শেখেননি তাঁরা।
যে সময় ত্রিগুণা সেন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেছেন, তখন দেশ জুড়ে আইনকানুন পাল্টে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নটা আজকের মতো রাষ্ট্রের কাছে বাঁধা রাখা হয়নি! বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় উদ্ভাবনী চিন্তার মূল্য এবং স্বাধীনতা ছিল। ত্রিগুণা সেন নানা ভাবে তার সদ্ব্যবহার করেছেন । দু’একটা উদাহরণ দিই।
পঞ্চাশের দশকের শেষে অসম থেকে ও ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে রাজনৈতিক কারণে পড়া-ছেড়ে-চলে-আসা ছাত্রীছাত্রদের তিনি সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করে নিতেন এমন ভাবে যাতে তাদের একটা বছর নষ্ট না হয়। নিজের রাজনৈতিক মতাদর্শকে তিনি কখনওই এমন কোনও কাজে অন্তরায় হতে দেননি যা ছাত্রদের ভাল রাখবে। ত্রিগুণা সেন নিজে প্রথম যৌবনে বিপ্লবী দলের সদস্য ছিলেন, তার পর জার্মানিতে ফ্যাসিবিরোধী বিদেশি ছাত্র সংসদের নেতা এবং পরবর্তী কালে দিল্লিতে কংগ্রেস মন্ত্রিসভার সদস্য। কোনও দিনই কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তাঁর যোগ ছিল না। কিন্তু ডাক্তার অরুণ সেন যখন ‘স্টুডেন্টস হেল্থ হোম’ শুরু করেন, তখন সেই হোমের গায়ে কমিউনিস্ট তকমা লেগে থাকা সত্ত্বেও উপাচার্য হেল্থ হোমের কাজকর্ম দেখে বুঝেছিলেন যে তাঁর ছাত্রীছাত্রদের স্বাস্থ্যের খাতিরে ‘স্টুডেন্টস হেল্থ হোম’-এর ইউনিভার্সাল মেম্বারশিপ থাকা দরকার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের! শুধু তা-ই নয়, কলকাতার মেয়র হিসেবে তাঁর কার্যকালের শেষ দিনে, খানিকটা বিধান রায়ের অমতেই, ত্রিগুণা সেন মৌলালির মোড়ে ‘স্টুডেন্টস হেল্থ হোম’-এর জন্য মঞ্জুর করেছিলেন জমির আবেদন!
১৯৬৭ সালে তিনি প্রথমে হন কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রী এবং ১৯৬৯-তে পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী। ১৯৭২ সালে যখন মন্ত্রিত্ব ছেড়ে চলে আসেন, তখন তাঁকে আর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য করতে চেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী। ত্রিগুণা সেন ‘না’ বলেছিলেন এই যুক্তিতে: ‘‘আমার গায়ে এখন পুরোপুরি একটা রাজনৈতিক দলের তকমা সেঁটে গেছে। যেখানে যাব, সেখানকার ছাত্ররা আর আমায় বিশ্বাস করবে না!’’ আজ আমরা শিক্ষাঙ্গনকে ছাত্র-রাজনীতি প্রভাবমুক্ত করা নিয়ে অনেক কথা বলি। কিন্তু আজকের দিনে এ রকম উত্তর বর্ষীয়ান শিক্ষাবিদদের মুখে মাঝে মধ্যে শোনা গেলে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ছাত্রীছাত্রদের সম্পর্ক আদৌ কিছু পাল্টাত কি না, সেটা নিয়ে ভাবার দরকার আছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy