Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

একমেরু বিশ্বের অধিনায়ক

‘শত্রু’ সোভিয়েত শিবিরে ধস নামল যখন বুশ সেই সময়ে নিজেই প্রেসিডেন্ট। ভেঙে পড়ল বার্লিন প্রাচীর, পূর্ব ইউরোপের সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র, অবশেষে আস্ত ইউনিয়নটাই। এই পর্বে শেষ সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচভের সঙ্গে বুশের বন্ধুত্বের ভূমিকাটি জরুরি।

আবাহন দত্ত
শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:১৬
Share: Save:

সে উনিশশো আশির দশকের কথা। মার্কিন ভাইসপ্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ (১৯২৪-২০১৮) সম্পর্কে ঠাট্টা চালু ছিল: ‘ইউ ডাই উই ফ্লাই’। রোনাল্ড রেগনের সহকারী হিসেবে যাবতীয় রাষ্ট্রীয় শেষকৃত্যে হাজির থাকতেন বুশ। ওই সময়ে তিন সোভিয়েত নেতার মৃত্যুর পর রাশিয়া পৌঁছন তিনি। নেহাতই আনুষ্ঠানিক। তবে ভিত গড়ার কাজ শুরু সেখানেই।

‘শত্রু’ সোভিয়েত শিবিরে ধস নামল যখন বুশ সেই সময়ে নিজেই প্রেসিডেন্ট। ভেঙে পড়ল বার্লিন প্রাচীর, পূর্ব ইউরোপের সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র, অবশেষে আস্ত ইউনিয়নটাই। এই পর্বে শেষ সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচভের সঙ্গে বুশের বন্ধুত্বের ভূমিকাটি জরুরি। ১৯৮৯-এর ডিসেম্বর মাসে সোভিয়েত ক্রুজ় ‘ম্যাক্সিম গোর্কি’তে মুখোমুখি হয়েছিলেন বুশ-গর্বাচভ। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ব্রেন্ট স্কোক্রফ্টের মত ছিল না বৈঠকে। তিনি বলেছিলেন ‘প্রিম্যাচিয়োর’। তবু ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া মিতেরঁ, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার এবং মার্কিন কংগ্রেসের কিছু সদস্যের কথায় গর্বাচভের সঙ্গে দেখা করলেন বুশ। চুক্তি সই হল না, কিন্তু গর্বাচভ জানালেন, “মার্কিন প্রেসিডেন্টকে আমি আশ্বাস দিয়েছি যে সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের বিরুদ্ধে আর উষ্ণ যুদ্ধ শুরু করবে না।” এই আশ্বাসকে সঙ্গী করেই শেষ হয়ে যায় ঠান্ডা যুদ্ধ। ‘‘অর্ধশতকের অবিশ্বাস মুছে ফেলতে এই পদক্ষেপ দরকার ছিল’’, বলেছিলেন বুশ।

এর আগের পর্ব ছিল তুলনায় অনেক ‘উষ্ণ’। প্রেসিডেন্ট রেগনের কাছে সোভিয়েত মানেই ‘শয়তানের সাম্রাজ্য’। কমিউনিস্টদের ক্ষেত্রে মার্কিন নীতি ছিল ‘দেতঁত’, অর্থাৎ প্রতিপক্ষের সঙ্গে চলনসই সম্পর্ক। রেগন বলেছিলেন ‘রোলব্যাক’ অর্থাৎ প্রতিপক্ষের উপর প্রবল চাপসৃষ্টি। লাভ হয়েছিল। ‘স্ট্র্যাটেজিক ডিফেন্স ইনিশিয়েটিভ’ সম্পর্কে গর্বাচভের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র জেরাসিমভের মত: “খুব সফল ব্ল্যাকমেল। এমন প্রতিযোগিতায় দাঁড়ানোর ক্ষমতা ছিল না সোভিয়েত অর্থনীতির।”

ঠান্ডা যুদ্ধে দাঁড়ি টানতে রেগনের ভূমিকা মানেন গর্বাচভ। তবে বুশের প্রয়াণের পর জানান, “জর্জ আর বারবারা বুশের আন্তরিকতা তারিফ করার মতো।” আসল কথা, রেগন ঢাকঢোল পিটিয়েও যে কাজ হাসিল করতে পারেননি, বুশ নীরবে তা সেরেছিলেন। ১৯৮৭ সালে বার্লিন শহরের ৭৫০তম বর্ষ উদ্‌যাপনে ব্র্যান্ডেনবার্গ গেটে বক্তৃতা দেন রেগন: “জেনারেল সেক্রেটারি গর্বাচভ, আপনি যদি শান্তি চান, যদি সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্ব ইউরোপের সমৃদ্ধি চান, আপনি যদি উদারীকরণ চান, তা হলে এই গেটে আসুন। মিস্টার গর্বাচভ, এই গেট খুলে দিন। মিস্টার গর্বাচভ, এই দেওয়াল ভেঙে ফেলুন।” সেই দেওয়াল ভেঙে ফেলা হয় বুশের সময়। ইতিহাসের অংশ হয়ে যান বুশ।

উপসাগরীয় যুদ্ধও ইতিহাস হয়ে যায়। ১৯৯১-এর ফেব্রুয়ারিতে ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের বাহিনীর হাত থেকে কুয়েতকে মুক্ত করতে ছোটে মার্কিন সেনা। কোরীয় যুদ্ধের পর এমন আর ঘটেছে কি? মার্কিন পক্ষ ও রাষ্ট্রপুঞ্জের অবস্থান উপেক্ষা করে, বুশের একার সিদ্ধান্তেই কুয়েত মুক্ত করে ফিরে আসে মার্কিন বাহিনী, বাগদাদ পর্যন্ত গিয়ে সাদ্দামকে ক্ষমতাচ্যুত না করেই। পুত্র প্রেসিডেন্ট বুশ জুনিয়র পরে বাবার এই পদক্ষেপকে ঐতিহাসিক ভুল ঘোষণা করে ‘ভুল’কে ‘ঠিক’ করতে ইরাক অভিযান করেন। বাবা বুশ ছিলেন মাটিতে পা রাখা কূটনীতিক। সাধে কি তাঁকে ‘কনজ়ারভেটিভ উইথ আ স্মল সি’ বলা হয়!

ব্যক্তিগত ভাবে সোভিয়েত পতনের ‘কৃতিত্ব’ বুশের নয়। সোভিয়েতের পতনের পিছনে ছিল কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরীণ সঙ্কট। প্রতিরক্ষা খাতে অত্যধিক ব্যয়ে অর্থনীতির চাকা থমকে গিয়েছিল। আফগানিস্তানে যুদ্ধে আমেরিকার সাফল্যের পরে সোভিয়েতের ছোট প্রজাতন্ত্রগুলি বিদ্রোহ শুরু করেছিল। ১৯৮৫-তে এসেছিলেন সংস্কারমুখী গর্বাচভ। তাঁর আমলের অন্তিম পর্যায় রুশ জনতার স্মৃতিতে যেন ‘কেবল বৈঠক আর চুক্তির কাল’। বুশের আমেরিকা দ্বারাই প্রায় চালিত হতে শুরু করেন গর্বাচভ।

সন্দেহ নেই, বুশের আমলই একমেরু দুনিয়ার নির্মাণকাল। পানামার ‘অপারেশন জাস্ট কজ়’, মার্কিন সহায়তায় সেনানায়ক মানুয়েল নরিয়েগাকে সরিয়ে গণতান্ত্রিক পথে নির্বাচিত নেতা গিলের্মো এনদারা প্রেসিডেন্ট পদে বসতে পারেন। এমনকী, বিল ক্লিন্টনের জয় ঘোষণার পরেও কার্যনির্বাহী বা ‘লেম ডাক’ প্রেসিডেন্ট হিসেবে সোমালিয়ায় ‘অপারেশন রেস্টোর হোপ’ শুরু করেছিলেন বুশ।

বিদেশনীতির সাফল্যে আস্থা রেখেই ১৯৯২-এ ভোট লড়লেন বুশ। এবং ডুবলেন। কারণ, দেশের অর্থনৈতিক মন্দা। তেল রফতানিকারী দেশগুলির জোট ‘ওপেক’-এর সহসদস্য কুয়েতে সাদ্দামের আক্রমণের ফলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম এক ধাক্কায় বেড়ে গিয়েছিল। আবার, ঠান্ডা যুদ্ধের অবসান হওয়ায় প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় অনেকটা কমে গিয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্ত এবং পারস্য উপসাগর শান্ত— মার্কিন ঘরোয়া রাজনীতিতে বিদেশনীতির প্রাসঙ্গিকতা তখন কতটুকু?

আসলে, নেতা হিসেবে রিপাবলিকান পূর্বসূরি রেগন কিংবা ডেমোক্র্যাট উত্তরসূরি ক্লিন্টনের সঙ্গে বুশের তফাতটা চোখে পড়ার মতো। রেগন ‘ভিশন’ দিতেন। আর বুশ বলতেন, ‘ভিশন’ ব্যাপারটা তাঁর ঠিক আসে না। বিল ক্লিন্টন নাকি ভোটাদের বাড়িতে পৌঁছতেন। বুশ জনতার সঙ্গে মিশছেন, এমন ছবি অপরিচিত। ঠিক কেমন ছিলেন তিনি, তাঁর কথাতেই পরিষ্কার। শেষ পর্যন্ত যাঁর শাসনকালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্ব রাজনীতির দীর্ঘ অস্থিরতা পেরিয়ে আমেরিকা হয়ে উঠল একমেরু বিশ্বের একক মেরু, সে বিষয়ে বুশের নিজের প্রতিক্রিয়া কী?— “আমি ঠিক আবেগপ্রবণ মানুষ নই।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE