নেতাজির জ্যেষ্ঠভ্রাতা শরৎচন্দ্র বসুর পৌত্র, চন্দ্রকুমার বসু একটি টুইটে লিখিলেন, গাঁধীজি যখন শরৎচন্দ্র বসুর উডবার্ন পার্কের বাড়িতে আসিতেন, তিনি ছাগদুগ্ধ পান করিতে চাহিতেন। হিন্দুদের রক্ষক গাঁধীজি সেই দুগ্ধ খাইয়া ছাগলকে মাতা মনে করিতেন। তাহা হইলে হিন্দুরা ছাগমাংস খাইবার অভ্যাস ত্যাগ করুক। বলা বাহুল্য, গোমাংস লইয়া ভারতীয় জনতা পার্টির অত্যুগ্র হইহইকে ব্যঙ্গ করিয়াই এই টুইট। অচিরেই ইহার বিপক্ষে তথাগত রায় টুইট করিলেন, গাঁধীজি কখনওই ছাগকে মাতা মনে করিতেন না। হিন্দুরা কেবল গরুকেই মাতা ভাবিয়া থাকেন। ইহার পরেও টুইট-যুদ্ধ কিছু ক্ষণ চলে, কিন্তু আমরা এই প্রাথমিক ও অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশে নজর দিতে পারি। ছাগলকে সাধারণত অবজ্ঞা করা হয়, ধ্বনিগত মিল থাকিবার ফলে তাহাকে পাগলের সহিত এক পঙ্ক্তিতে বসিতে হয়, তাহাকে নির্বোধ বলিয়াও প্রচার হয়। কিন্তু উহা মূঢ়গণের অভ্যাস। পুরাণজ্ঞ হইলে, প্রকৃত ভক্ত হিন্দু হইলে, কদাপি তাহা করা চলে না। মনে রাখিতে হইবে, ছাগলের নাম অজ। অর্থ: যে জন্মে না, জন্মরহিত, জন্মশূন্য। অর্থাৎ, স্বয়ং ঈশ্বর। ব্রহ্মার এক নাম অজ, বিষ্ণুরও। ফলে অজকে অপমান করার অর্থ ঈশ্বরকেই অপমান। ঈশ্বর আমাদিগের মাতা, পিতা, পিতৃব্য, সকলই। তাই অজ আমাদের মাতা নহে, ইহা বলা নাস্তিকতার সমান। তথাগতবাবু এক টুইটে লিখিয়াছেন, গাঁধীজির প্রিয়তম শিষ্য নেহরুও ছাগমাংসাহারী। কিন্তু তাহাতে কী প্রমাণ হয়? গাঁধীজির পারিষদবর্গ কী করিতেন, তাহা তো তাঁহার ভাষণ নহে। তাঁহার জীবনই তাঁহার বাণী। গাঁধীর জীবনকে তাঁহার চলমান মতামতপুঞ্জ ও নীতিরাশি বলিয়া ধারণা করিলে, অবশ্যই বুঝিতে হইবে, গাঁধী যাহার দুগ্ধ পান করিতেন, তাহাকে নিশ্চয় মাতা জ্ঞান করিতেন। আর জাতির জনক যাহাকে মাতা ভাবিতেন, সে মাতা না হইলেও, পিতামহী তো বটে। ইহাও মনে রাখিতে হইবে, দক্ষযজ্ঞবিধ্বংসের কালে ব্রহ্মা মেষের রূপ ধরিয়া পলায়ন করেন, সেই হইতে মেষের নাম অজ। আর সাদৃশ্যবশে ছাগের নামও অজ। তাহা হইলে অজ ব্রহ্মার সমান। ব্রহ্মাকে খাইয়া ফেলা যাহাদের অভ্যাস, তাহারা তো মহাপাপী।
কিন্তু গুরুতর তথ্য হইল, ইক্ষ্বাকুবংশীয় রঘুর পুত্র দিলীপ, দিলীপের পুত্র অজ। অজর পুত্র দীর্ঘবাহু, দীর্ঘবাহুর পুত্র প্রজাপাল, প্রজাপালের পুত্র দশরথ। আর দশরথের পুত্র যে রাম, ইহা কে না জানে। অর্থাৎ, অজ না থাকিলে রামই থাকিতেন না। আর রাম না থাকিলে বিজেপি থাকিত কি? কাহাকে লইয়া তাহারা কোটি স্বরযন্ত্র বিড়ম্বিত করিয়া নারা তুলিত, কাহার ছবি লইয়া আসমুদ্রহিমাচল দাপাইত, কাহার উপাসনাস্থল গড়িবার আকাঙ্ক্ষায় দাঙ্গা বাধাইত, কাহার মান রক্ষার ছলে অন্য সম্প্রদায়ের জীবন অতিষ্ঠ করিয়া তুলিত? বিজেপি কখনওই মনে করে না, রাম মহাকাব্যের চরিত্র। তাহারা মনে করে, রাম ইতিহাসের অংশ, বাস্তবেই তিনি ছিলেন। তাহা হইলে অজও বাস্তবে ছিলেন। সেই অজর নামে যে পশুর নাম, তাহাকে খাইবার অর্থ তো নিজ পরমতম আরাধ্যের পূর্বপুরুষকে ভক্ষণ! বিজেপি হইব আর পুরাণ জানিব না, ইহা ভয়াবহ পাপ। কারণ পুরাণেই ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ মনীষা সন্নিহিত, পুরাণ বলিয়াছে বলিয়াই নিশ্চিত প্রমাণিত হইয়া যায় গণেশের প্লাস্টিক সার্জারি হইয়াছিল, কিংবা সঞ্জয় টেলিভিশনে কুরুক্ষেত্র দেখিতে দেখিতে ধারাবিবরণী করিতেন। অজ ব্রাহ্মমুহূর্তে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, তাই ব্রহ্মার নামানুসরণে নামকরণ হইয়াছিল। আবারও প্রমাণিত হইয়া যাইল, ছাগলকে খাইলে তাহা ব্রহ্মাকে এবং রামের পূর্বপুরুষকে একযোগে খাওয়া। অর্থাৎ, দ্বিগুণ পাপ।
অতএব ছাগকে খাওয়া পরিহার করিলেই চলিবে না, এত দিন ধরিয়া অনুতাপবিহীন ভাবে খাইয়া আসিবার জন্য অনতিবিলম্বে ক্ষমা চাহিয়া মহাযজ্ঞ করা আবশ্যক। হায়, হীন উদরের প্ররোচনায় এত দিন ধরিয়া ধর্মনিষ্ঠ হিন্দু জাতি এ কী করিয়াছে! প্রতি রবিবার যে প্রাণীকে কাটিয়া খাইয়াছে, সে স্বয়ং ঈশ্বর, কোনও মতানুযায়ী একাদশ রুদ্রের অন্যতম, কাহারও মতে এক প্রাচীন রাজা, যিনি স্বাধ্যায় প্রভাবে স্বর্গগমন করিয়াছিলেন। তাহার আহার করিলে পুরাণের ভূর্জপত্রগুলিকেই চর্বণের সমান অপরাধ হইবে। কাহারও ফ্রিজ়ে ছাগমাংস থাকিলে তাহাকে অবিলম্বে টানিয়া বাহির করিয়া গণপ্রহার করাই কি হিন্দুদের পরবর্তী পবিত্র কর্ম নহে?
যৎকিঞ্চিৎ
ক’বছর আগে স্বাধীনতা দিবস মানে ছিল দিনমান বিছানায় গড়াগড়ি, দুপুরে জমিয়ে মাংস, টিভিতে ‘রোজা’। অর্থাৎ, অফিস হইতে স্বাধীনতা। এখন, স্বাধীনতার সপ্তাহ জুড়ে সব দোকানে সাংঘাতিক ছাড়, প্রকাণ্ড ক্যাশব্যাক। পাঁইপাঁই দৌড়োও বা মোবাইলে ঝুঁকে পড়ো, হুড়মুড়িয়ে কেনো সস্তায় আটা ময়দা ফ্রিজ় ল্যাপটপ হাফপ্যান্ট তেরঙা টি-শার্ট। অর্থাৎ, বেশি দাম হইতে মুক্তি। আগে স্বাধীনতা ছিল আলস্যের উদ্যাপন, এখন নিলাজ লোভের। অচ্ছে দিন আসন্ন?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy