Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

শতবর্ষ পরও সমান প্রাসঙ্গিক

সওগাত পত্রিকা কী ভাবে তিন দশকব্যাপী সময়ে বাংলার সাহিত্যজগতে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছিল, গত কাল সে কথা আলোচনা করেছি (‘‘চমকে উঠেছিলেন সম্পাদক’’, ২৮-৮)।

নাসিম-এ-আলম
শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

সওগাত পত্রিকা কী ভাবে তিন দশকব্যাপী সময়ে বাংলার সাহিত্যজগতে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছিল, গত কাল সে কথা আলোচনা করেছি (‘‘চমকে উঠেছিলেন সম্পাদক’’, ২৮-৮)। তবে এই পত্রিকা শুধু সাহিত্য-রচনা প্রকাশ করেই তার কর্তব্য শেষ করেনি, বরং বিভিন্ন সংখ্যায় দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন বিষয়ে বলিষ্ঠ অবস্থানও নিয়েছে। পত্রিকাটির লক্ষ্য ছিল পূর্ণ স্বাধীনতা, এ বিষয়ে একটি সংখ্যার সম্পাদকীয় প্রবন্ধে মন্তব্য করা হয়, ‘‘ভারতকে ইংরাজ রাজ্যের লেজুড় করিয়া রাখিতে গিয়া কমনওয়েলথের দোহাই দিয়া লাভ কি? প্রত্যেক জাতির যদি আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার থাকিয়ে থাকে, তবে স্বাধীনতা লাভেরও অধিকার আছে।’’ বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক থেকে পঞ্চম দশক পর্যন্ত বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে ‘সওগাত’ সম্পাদক দেখেছেন কৃষকের দারিদ্র ও দুর্দশা। তখনও গ্রামাঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ছিল না, চাকরিজীবীর সংখ্যাও ছিল অতি অল্প। কৃষিই ছিল মুখ্য জীবিকা। ‘সওগাত’-এ এ বিষয়ে অনেকগুলি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য: পল্লিমঙ্গল, বাংলার কৃষি-শিল্প সমস্যা, সঙ্কটে মন্বন্তর, মন্বন্তরের শিক্ষা প্রভৃতি। ‘বাংলার কৃষি-শিল্প সমস্যা’ শীর্ষক প্রবন্ধে বাংলার গ্রামীণ মানুষের দারিদ্র নিরসনের জন্য তিনটি উপায় নির্দেশ করা হয়। সেগুলি যথাক্রমে প্রকৃত শিক্ষার ব্যবস্থা, কৃষি ও কৃষকের উন্নতি এবং বাণিজ্য ও শিল্পের উন্নতি। একটি প্রবন্ধে শওকত ওসমান লেখেন, ‘‘আমাদের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মূল কথা জীবন শিল্প গঠন, যে জীবন শিল্প সমাজকে ললিত কলার মর্যাদায় উন্নীত করবে, জনগণকে সাহায্য করবে।’’

‘সওগাত’ যে লক্ষ্যে প্রথম থেকে শেষ অবধি অবিচল ছিল, তা হল স্ত্রীশিক্ষা ও নারী-স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন। সচিত্র মাসিকপত্রটির প্রথম সংখ্যায় ইতিহাসখ্যাত মহিলাদের ছবি মুদ্রিত হয়। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের কবিতা প্রথম পাতায় ছাপা হয়। এ রকম লেখকসূচির থেকে দু’রকম ইঙ্গিত পাওয়া যায় বলে সমালোচকদের ধারণা। প্রথমত নারীর স্বাধীন ব্যক্তিত্বের স্বীকৃতি, দ্বিতীয়ত হিন্দু-মুসলমানের মিলন কামনা, সমালোচকের ভাষায়: ‘‘উদার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং উদ্যম।’’ স্ত্রীশিক্ষা প্রসঙ্গে ‘সওগাত’-এ অজস্র প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। জনৈক লেখিকার মন্তব্য, ‘‘স্ত্রীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে এই বিংশ শতাব্দীতেও আমাদের দুর্ভাগা সমাজ সজাগ হতে পারছে না। এই শিক্ষা যে মেয়েদেরকে তথা সমাজকে কতখানি উন্নতির পথে এগিয়ে নিয়ে যায়, তা তাঁরা ভেবে দেখছেন না।’’ ‘সওগাত’-এ মেয়েদের জন্য পৃথক বিভাগ: জেনানা মহফিল, মহিলা সংখ্যা, মহিলা সওগাত প্রকাশ করতে থাকেন সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন। ১৯২৯ থেকে ১৯৪৫, ষোলো বছরে ছ’টি মহিলা সংখ্যা প্রকাশ করা হয়। ১৯৪৭-এ ‘সওগাত’-এর তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত মেয়েদের নিজস্ব পত্রিকা ‘বেগম’। সম্পাদক ছিলেন সুফিয়া কামাল। দ্বাদশ সংখ্যা থেকে সম্পাদক হন মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিনের মেয়ে নূরজাহান বেগম। সহ-সম্পাদক লায়লা সামাদ। ১৯৫০-এ ‘বেগম’ স্থানান্তরিত হয় ঢাকায়। তিন বছর পশ্চিমবঙ্গ থেকে ‘বেগম’-এর ছত্রিশটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। তৈরি হয় ‘বেগম ক্লাব’, যার সভাপতি শামসুন্নাহার মাহমুদ। প্রবীণ লেখিকা, সমাজসেবী ও নবীন লেখিকারা বিভিন্ন অধিবেশনে মিলিত হতেন। ‘বেগম’ পত্রিকার কলকাতা বিদায়ের ক্ষণটিকে স্মরণীয় করতে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, সেখানে গান গেয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও তালাত মামুদ।

‘সওগাত’-এর উদারপন্থী আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সে সময়ে অনেকগুলি পত্রিকা প্রকাশিত হতে শুরু করে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘তরুণপত্র’ (বৈশাখ ১৩৩২), ‘অভিযান’ (ভাদ্র ১৩৩৩), ‘শিখা’ (চৈত্র ১৩৩৩), ‘জাগরণ’ (বৈশাখ ১৩৩৫), ‘সঞ্চয়’ (ভাদ্র ১৩৩৫), ‘জয়শ্রী’ (১৩৩৭) প্রভৃতি। এদের লক্ষ্য ছিল হিন্দু-মুসলমান ঐক্য, দেশের স্বাধীনতা, নারীর শিক্ষা, সার্বিক সামাজিক উদারতা। অন্য দিকে মোহাম্মদ আবদুর রশিদ সিদ্দিকি সম্পাদিত ১৯২১-এ মেয়েদের পত্রিকা ‘আন্বেসা’। ১৯৩২-এ জাহানারা বেগম চৌধুরীর সম্পাদনায় ‘রূপরেখা’, ১৯৩৩-এ হাবিবুল্লাহ বাহার ও শামসুন্নাহার সম্পাদিত মাসিক ‘বুলবুল’ এবং ১৯৪২-এ সুলতানা বেগমের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘জাগরণ’। এরা বলিষ্ঠ কণ্ঠে মেয়েদের সমস্যা ও উত্তরণের কথা বলত।

বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করি বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে এ সব পত্রপত্রিকা কত স্পষ্ট স্বরে মেয়েদের সমস্যা, স্বাধীনতা ও সামাজিক সুরক্ষা নিয়ে কথা বলেছে, অথচ আজ এত দিন পরে সেই সমাজভাবনা কোথায় যেন অন্তর্হিত। বিশেষত এ পারের বাঙালি সংখ্যালঘু মেয়েরা এখন শিক্ষায় কিছু সাফল্য পেয়েছে, চাকরি পাচ্ছে, তবু নিজেদের কথা মাথা উঁচু করে বলার সাহস চোখে পড়ে না।

‘সওগাত’ প্রথম প্রকাশের শতবর্ষ এ বছর, শতবর্ষ আগে সওগাত ও তার লেখক-লেখিকারা যে আদর্শে বিশ্বাস করতেন সেই আদর্শ আজও সমান প্রাসঙ্গিক। ‘সওগাত’-এর মতো পত্রিকা আজও সমান ভাবে প্রয়োজনীয়। (শেষ)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE