Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

বিগত বটবৃক্ষ

তামিল অস্তিত্ব তাঁহার রাজনীতির প্রধানবিন্দু। তাই করুণানিধিকে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয়তায় বিশ্বাসী নেতাদের অন্যতম পথিকৃৎ বলা চলে। পেরিয়ার ই ভি রামস্বামী এবং সি এন আন্নাদুরাই-এর মতাদর্শে দীক্ষিত, স্বঘোষিত নাস্তিক ও পশ্চাৎপদ গোষ্ঠীর ক্ষমতায়নে সক্রিয় এই নেতার সঙ্গে কংগ্রেসি ও বামপন্থীদের স্বাভাবিক মৈত্রী, কিন্তু জাতীয় স্তরে আদানপ্রদানের সময়ে তামিল স্বকীয়তার তাসটি খেলিতে তিনি কখনও ভুলিতেন না।

শেষ যাত্রায় মুথুভেল করুণানিধি।

শেষ যাত্রায় মুথুভেল করুণানিধি।

শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০১৮ ০০:৪০
Share: Save:

আজীবন বহু চিত্রনাট্য লিখিয়াছেন মুথুভেল করুণানিধি। তাহার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠটি সম্ভবত দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কজ়গম বা ডিএমকে নামক দলটির রাজনৈতিক জীবন। ১৯৪৯ সালে, স্বাধীনতার ঠিক পরই, দ্রাবিডর কজ়গম দল হইতে বাহির হইয়া নূতন দল ডিএমকে তৈরির সময় তিনি স্থির করেন, দ্রাবিড় আন্দোলনের মূল কথাটিকে রাজনৈতিক চর্যার মধ্যে আনিতে হইবে। সেই বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করিয়াই অতঃপর তামিল সত্তাবোধকে রাজনীতির অঙ্গনে মেলিয়া ধরার প্রয়াস, জাতীয় মঞ্চে তামিল ভাষাকে তুলিয়া ধরার জন্য সংগ্রাম, শ্রীলঙ্কায় তামিল অধিবাসীদের অধিকার সমর্থন। ‘তামিল ইলম’ বলিয়া যদি কিছু থাকে, তাহা হইলে করুণানিধি তাহার প্রধান মুখপাত্রদের এক জন। তামিল যে দিন ‘ক্লাসিকাল’ ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি (২০০৪) লাভ করিল, তাহা এক অর্থে করুণানিধির রাজনীতির শিখরবিন্দু। জীবনের শেষ পর্বটিতে তাঁহার এই গৌরব অবশ্য কিছু ক্ষুণ্ণ হয়— এক দিকে কট্টর তামিল জাতীয়তাবাদীরা তাঁহার মধ্যে তামিল গৌরবসুরক্ষার প্রমাণ খুঁজিতে থাকেন, অন্য দিকে দিল্লিতে তিনি এলটিটিই-র প্রতি সহানুভূতিপরায়ণ বলিয়া দুর্নাম কুড়ান। ত্রিশঙ্কু নেতা তখন অনশনে বসিয়া এলটিটিই-সহানুভূতির প্রমাণ রাখেন ও কেন্দ্রীয় সরকারের সামান্য প্রতিশ্রুতির সুতা আঁকড়াইয়া দ্রুত অনশন ভাঙিয়া জাতীয় রাজনীতিতে নিজের প্রাসঙ্গিকতা ফিরান। সব মিলাইয়া ভারতীয় রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্ব তাঁহার জীবন কাহিনিতে আদ্যন্ত প্রোথিত।

তামিল অস্তিত্ব তাঁহার রাজনীতির প্রধানবিন্দু। তাই করুণানিধিকে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয়তায় বিশ্বাসী নেতাদের অন্যতম পথিকৃৎ বলা চলে। পেরিয়ার ই ভি রামস্বামী এবং সি এন আন্নাদুরাই-এর মতাদর্শে দীক্ষিত, স্বঘোষিত নাস্তিক ও পশ্চাৎপদ গোষ্ঠীর ক্ষমতায়নে সক্রিয় এই নেতার সঙ্গে কংগ্রেসি ও বামপন্থীদের স্বাভাবিক মৈত্রী, কিন্তু জাতীয় স্তরে আদানপ্রদানের সময়ে তামিল স্বকীয়তার তাসটি খেলিতে তিনি কখনও ভুলিতেন না। দিল্লির শাসকদের তাই সর্বদা তাঁহার বিষয়ে সতর্ক সচেতন থাকিতে হইত। দুইটি মুহূর্ত এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়। এক, শাসক কংগ্রেসের মিত্র হইয়াও ইন্দিরা গাঁধীর জরুরি অবস্থার বিরোধিতা করিয়া নিজের রাজ্যে বিপন্ন হইয়া পড়েন করুণানিধি, তাঁহার সরকার ফেলিয়া দেওয়া হয়। দুই, আইপিকেএফ যে সময় শ্রীলঙ্কায় প্রবল দাপট দেখাইতেছে, তখন রাজীব গাঁধীর শ্রীলঙ্কা-নীতির সর্ববৃহৎ সমালোচক হইয়া ওঠেন করুণানিধি। একষট্টি বৎসরে তেরো বার তামিলনাড়ুর বিধানসভা ভোটে লড়িয়া যিনি এক বারও পরাজিত হন নাই এবং পাঁচ বার মুখ্যমন্ত্রী হইয়াছেন, তাঁহার নিকট রাজ্যের স্বার্থ সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ নিশ্চয়, কিন্তু সেই প্রাদেশিক স্বার্থটি কী ও কেমন, তাহার রূপায়ণও তিনি স্বয়ং করিয়াছিলেন। পরবর্তী কালে বিভিন্ন রাজ্যের প্রাদেশিক নেতারা অনেকাংশেই তাঁহার উত্তরসূরি।

সর্বশেষে একটি কথা। করুণানিধি পুরাদস্তুর রাজনীতিক ছিলেন, রাজনীতির খাতিরে অনেক সমঝোতা করিয়াছেন, তাঁহার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগও কম ওঠে নাই, বিরুদ্ধ পক্ষ এম জি রামচন্দ্রন ও জয়ললিতার মতো তিনিও ফিল্ম-জগতের গরিমা ও গ্ল্যামারকে রাজনীতিতে যথেষ্ট কাজে লাগাইয়াছেন। কিন্তু একটি বিষয়ে করুণানিধি আজীবন দৃঢ় ও নিশ্চিত পদচারণ করিয়াছেন, তাহা তামিল সমাজের বহুত্ববাদে বিশ্বাস রাখা, এবং তৎসূত্রে পশ্চাৎপদ ও সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলির সুরক্ষায় মনোযোগ দেওয়া। কাবেরী দিয়া এত জল চলিয়া যাইবার পর আজও তাই ডিএমকে-র প্রতি মুসলিম ও পশ্চাৎপদ মানুষের সমর্থন অকুণ্ঠ। এই দিক দিয়া দেখিলে, কেবল তামিল জনসাধারণের কাছে নহে, বৃহত্তর ভারতের কাছেও করুণানিধি এক বিগত যুগের বটবৃক্ষ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE